বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে নজিরবিহীন দুর্নীতি, অনিয়ম, জালিয়াতি ও লুটপাটের মাধ্যমে দেশের ব্যাংক খাতকে ধ্বংস করা হয়। ক্ষতিগ্রস্থ ব্যাংকগুলো আমাতকারীদের টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হয়। ফলে ব্যাংকগুলোর প্রতি গ্রাহকদের অনাস্থা জন্মায়। অস্থিরতা ও আতংক বিরাজ করে পুরো আর্থিক খাতজুড়ে। গত বছর জুলাই অভ্যূত্থানের মধ্যদিয়ে দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার ব্যাংক খাতের আইনগত পরিবর্তন, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও আমানতকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধারে বিভিন্ন সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। এর অংশ হিসেবে ক্ষতিগ্রস্থ ব্যাংকগুলোর সম্পদের গুণগত পর্যালোচনা, ব্যাংকগুলোতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি এবং দেশ থেকে পাচার হওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে তিনটি টাস্কফোর্স গঠন করে সরকার।
ব্যাংক খাতে আইনগত সংস্কারের প্রথম উদ্যোগ হিসেবে সরকার সম্প্রতি ‘ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ-২০২৫’ প্রনয়ণ করেছে। এর উদ্দেশ্য হলো- মূলধন ঘাটতি, তারল্য সংকট, দেউলিয়াত্ব বা অস্তিত্বের সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোর জন্য সময়োপযোগী সমাধান এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। এর অধীনে ব্যাংক একীভূত, অধিগ্রহণ ও অবসায়নের সুযোগ রাখা হয়েছে। আইন প্রয়োগের প্রাথমিক ধাপ হিসেবে ক্ষতিগ্রস্থ ব্যাংকগুলোর সম্পদের মান যাচাইয়ে বিদেশি নিরীক্ষক দিয়ে নিরীক্ষা চলছে, যা অতি দ্রুত বাংলাদেশ ব্যাংক বরাবর চূড়ান্ত প্রতিবেন পেশ করবে।
পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষার্থে ‘ডিপোজিট ইন্স্যুরেন্স আইন (সংশোধনী)’ প্রণয়নের সুপারিশ করেছে। এ ছাড়া ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খারাপ ঋণ ও সম্পদ ব্যবস্থাপনায় একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্যে অর্থ মন্ত্রণালয় ‘বাংলাদেশ অ্যাসেট ম্যানেজম্যান্ট কোম্পানি আইন’-এর খসড়া সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। ব্যাংক মালিকানায় স্বচ্ছতা আনতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘আলটিমেট বেনিফিশিয়াল ওনার (ইউবিও)’ শনাক্তকরণ ও মালিকানা কাঠামো প্রকাশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিপত্র জারি করেছে।
সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে ‘ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ-২০২৫’ এর অধীনে ক্ষতিগ্রস্থ পাঁচটি ইসলামী ব্যাংক একীভূত করে একটি বৃহৎ ব্যাংক গঠন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগামী জুলাই থেকে শুরু করে ১৫ অক্টোবরের মধ্যে প্রাথমিক প্রক্রিয়া শেষ করার একটি রোডম্যাপও ঠিক করা হয়েছে। এই সময়ে ব্যাংকগুলোকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখে বিভিন্ন তথ্য যাচাইয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাঁচটি টিম কাজ করবে। এতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর প্রতিনিধিত্বও থাকবে।
সংবাদপত্রে বলা হয়েছে, নতুন এই ব্যাংকের যাত্রার শুরুতে মূলধন জোগান দেবে সরকার। ব্যাংকটির প্রধান কাজ হবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতে (এসএমই) অর্থায়ন করা এবং গ্রামীণ অর্থনীতিকে সক্রিয় করা। এই ব্যাংকের অনুমোদন (লাইসেন্স) দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর অধীনে এই পাঁচ ব্যাংকের আমানত ও সম্পদ স্থানান্তর করা হবে। এই প্রক্রিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে ঈদের ছুটির পরই শুরু হবে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত একীভূত হতে যাওয়া ব্যাংকগুলো হলো-ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক। এ পাঁচ ব্যাংকের মধ্যে এক্সিম ব্যাংকের মালিকানা রয়েছে আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম মজুমদারের। বাকি চার ব্যাংকের মালিকানা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘনিষ্ঠ এস আলম গ্রুপের মালিক সাইফুল আলমের। বিগত সরকারের সময়ে এসব ব্যাংক থেকে বিভিন্ন নামে-বেমামে অর্থ তুলে নেন মালিকগণ। এতে দুর্বল হয়ে পড়ে ব্যাংকগুলো।
প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, আইনগত প্রক্রিয়া হিসেবে প্রথম ধাপ শেষে ব্যাংকগুলোকে সাময়িকভাবে সরকারি মালিকানায় নেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই ব্যাংকগুলোর এমডিদের চুক্তি বাতিল হবে। বর্তমান পরিচালনা পর্ষদগুলো থেকে বাছাই করা সদস্যসহ বিভিন্ন খাতের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি সমৃদ্ধ পর্ষদ গঠন করা হবে, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্বিক দিকনির্দেশনায় পরিচালিত হবে।
অধ্যাদেশের আলোকে আগামী ১৫ অক্টোবরের পর প্রথমে এসব ব্যাংকের শেয়ার শূন্য করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর সাময়িক সময়ের জন্য ব্যাংকগুলো সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হবে। এ সময়ে প্রতিটি ব্যাংকের খারাপ সম্পদ ও ভালো সম্পদ আলাদা করা হবে। ভালো সম্পদগুলো এক ছাতার নিছে এনে ব্রিজ ব্যাংকের অধীনে দেওয়া হবে।
অধ্যাদেশে আরো বলা হয়েছে, ব্যাংকগুলো একীভূত হলেও এসব ব্যাংকের গ্রাহকদের লেনদেনে কোনো সমস্যা হবে না। আমানতকারীদের আমানত নিরাপদ থাকবে। তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নতুন ব্যাংকটির গ্রাহক হবেন। এ ছাড়া শীর্ষ পর্যায় ব্যতীত অন্য ব্যাংকাররা একীভূতকরণের প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত চাকরিতে বহাল থাকবেন। এ প্রক্রিয়া তিন বছর ধরে চলবে।
পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, সমস্যাগ্রস্থ এই পাঁচটি ব্যাংকের মোট আমানত ১ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা এবং ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৯২ হাজার ৭৮৬ কোটি টাকা। একিউআর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের ১ লাখ ৪৬ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা বা ৭৬ শতাংশ খেলাপি। এর মধ্যে ইউনিয়ন ব্যাংকের মোট ঋণের ৯৮ শতাংশ, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ৯৭ শতাংশ, গ্লোবাল ইসলামী ৯৫ শতাংশ, সোশ্যাল ইসলামী ৬২ শতাংশ এবং এক্সিম ব্যাংকের ৪৮ দশমিক ২০ শতাংশ ঋণ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। সারাদেশে এসব ব্যাংকের ৭৬০টি শাখা, ৬৯৮টি উপশাখা, ৫১১টি এজেন্ট আউটলেট এবং ৯৭৫টি এটিএম বুথ রয়েছে।
নতুন এই অধ্যাদেশে আরো বলা হয়েছে, মালিক পক্ষের দূর্নীতি ও অনিয়মের কারণে ভবিষ্যতে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এমন যে কোনো ব্যাংকে অস্থায়ী প্রশাসক নিয়োগ, বিদ্যমান শেয়ার ধারক বা নতুন শেয়ার ধারকদের মাধ্যমে মূলধন বাড়ানো এবং ব্যাংকের শেয়ার, সম্পদ ও দায় তৃতীয় পক্ষের কাছে হস্তান্তর করতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক। সুনির্দিষ্ট কারণ দেখিয়ে যেকোন ব্যাংকে অস্থায়ী প্রশাসক নিয়োগ দিতে পারবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কোনো ব্যাংকের শেয়ার, দায় ও সম্পদ তৃতীয় পক্ষের কাছে হস্তান্তর করতে পারবে। আমানতকারীর সুরক্ষাই এই অধ্যাদেশের উদ্দেশ্য।
কোন ব্যাংকে অনিয়ম সংগঠিত হলে বাংলাদেশ ব্যাংক অস্থায়ী ভিত্তিতে প্রকাশক নিয়োগ করতে পারবে। ব্যাংকের তারল্য পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য পৃথক তহবিল গঠন করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই তহবিলের মাধ্যমে ব্যাংকের দৈনন্দিন কার্যক্রম সচল রাখবে। অধ্যাদেশে ব্যাংক খাতের সংকট মোকাবিলায় ‘ব্যাংক খাত সংকট ব্যবস্থাপনা কাউন্সিল’ নামে ছয় সদস্যের একটি সংস্থা গঠনের বিধান রাখা হয়েছে।
অধ্যাদেশে সংকটাপন্ন ব্যাংকের স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ‘ব্রিজ ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। ব্রিজ ব্যাংক কৌশল সাধারণত তখন প্রয়োগ করা হয় যখন কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান আর্থিক সংকটে পড়ে এবং স্বাভাবিক কার্যক্রম চালাতে অক্ষম হয়। ব্রিজ ব্যাংকের মূল লক্ষ্য হলো ব্যাংকটির পুনর্গঠন, বিক্রয় বা স্থায়ী সমাধানের আগ পর্যন্ত এর কার্যক্রম সচল রাখা। এ ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা সরাসরি সরকার দ্বারা পরিচালিত হয়। এর মাধ্যমে ব্যাংকটির আর্থিক পুনর্গঠন, সম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং দায়বদ্ধতা নিষ্পত্তির জন্য প্রয়োজনীয় সময় পাওয়া যায়। নতুন ফান্ড গঠন, বিনিয়োগকারী আকৃষ্ট করা, ঋণ পুনরুদ্ধারসহ ব্যাংকের স্থিতিশীলতা আনয়নে এই ব্রিজ ব্যাংক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে ব্যাংক খাত সংস্কারের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তা জনমনে আশার সঞ্চার তৈরি করেছে। ব্যাংকগুলো পুনর্গঠনের পাশাপাশি আর্থিক খাতে মাফিয়া-লুটেরাদের শাস্তির আওতায় নিয়ে এসে আর্থিকখাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। ব্যাংক রেজুল্যশন আইন পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের মাধ্যমে ব্যাংকখাতে শৃঙ্খলা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। এতে ব্যাংক খাতে বিরাজমান অস্থিরতা দূর হবে এবং গ্রাহক ও আমানতকারীদের আস্থা ফিরে আসবে। একই সাথে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিবিড় তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশে একটি বৃহৎ ও শক্তিশালী ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হবে। ফলে দেশের মানুষের ইসলামী ব্যাংকিংয়ের প্রতি যে আগ্রহ তা অনেকাংশে পূরণ হবে।
লেখক: ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের হেড অব পাবলিক অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড ব্র্যান্ড কমিউনিকেশন্স। ইমেইল: hasan.khairul@ gmail.com