Home মতামত বিদায় হজের ভাষণে আমাদের করণীয়

বিদায় হজের ভাষণে আমাদের করণীয়

২৩৫ views

নির্দিষ্ট সময়ে ইহরাম অবস্থায় পবিত্র কাবা তাওয়াফ, আরাফাতের ময়দানে অবস্থানসহ আল্লাহর দেয়া আরো কিছু হুকুম কয়েকটি নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট নিয়মে পরিপালন করার নাম হজ। বায়তুল্লাহ পর্যন্ত সফর করার শারীরিক ও আর্থিক সামর্থ্যবান প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তির উপর জীবনে একবার হজ করা ফরজ। ইসলামের সর্বশেষ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর জীবনকালের শেষ হজ অনুষ্ঠিত হয় ১০ম হিজরীতে ৬৩২ খ্রিষ্টব্দে। এ সময় তিনি যে ভাষণ দিয়েছিলেন তা বিদায় হজের ভাষণ হিসেবে পরিচিত। মুসলমানদের করণীয় ও বর্জনীয় সকল দিকসহ চূড়ান্ত নির্দেশনা রয়েছে এই ভাষণে। আরাফার ময়দানে জাবালে রহমতের চূড়ায় দাঁড়িয়ে ১ লক্ষ ২০ হাজার লোকের সমাবেশে এ ভাষণ দিয়েছিলেন তিনি। ইসলামের পূর্ণতার ঘোষণা দেয়া হয় এই ভাষণে। যার সমর্থনে পবিত্র কুরআনের সূরা মায়িদার ৩ নম্বর আয়াত নাযিল হয়েছে। “আজ আমি তোমাদের ধর্মকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার নেয়ামতগুলোকে সুসম্পন্ন করলাম, আর ইসলামকে তোমাদের ধর্ম হিসেবে মনোনীত করলাম”। মুসলমানদের জন্য করণীয় নির্ধারণকারী এই ভাষণের শিক্ষণীয় ও অনুকরণীয় বিষয়গুলো তুলো ধরা হলোঃ
১. আল্লাহর কিতাব ও রাসুলের সুন্নাহ আকড়ে ধরা: রাসূল (সা:) বলেন, আমি শেষ নবী আমার পরে আর কোন নবী আসবে না। আমার সাথে ওহীর পরিসমাপ্তি হতে যাচ্ছে। হে মানুষেরা; আমি নিঃসন্দেহে তোমাদেরই মতো একজন মানুষ, তোমাদের ও আমার মধ্যে পার্থক্য হলো আমার নিকট ওহী আসে। আমারও মহান আল্লাহর নিকট ফিরে যেতে হবে। আমি তোমাদের জন্য দুইটি জিনিস রেখে যাচ্ছি। যতদিন তোমরা এ দুটি জিনিস আকড়ে থাকবে ততদিন তোমরা নিঃসন্দেহে পথভ্রষ্ট হবেনা। এর একটি হলো আল্লাহর কিতাব-আল কোরআন ও অপরটি রসুল (স:) এর সুন্নাহ।

২. পারস্পরিক নিরাপত্তা: তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্মান, তোমাদের সম্পদ পরস্পরের জন্য পবিত্র ও নিরাপদ। যেমন আজকের এ দিন (জুমার দিন), এই মাস (জিলহজ মাস), এই শহর (মক্কা শহর) পবিত্র। প্রাণ রক্ষার অধিকার বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন-‘কেসাস বিধির মধ্যে রয়েছে তোমাদের জীবনের নিরাপত্তা’ (সূরা বাকারা-১৭৯)। সম্পদ রক্ষার জন্য মহান আল্লাহ বলেন ‘তোমরা চোরের হাত কেটে দাও’। (সূরা মায়েদা-৩৮)। মান মর্যাদা রক্ষায় মহান আল্লাহ বলেন ‘ ব্যভিচারী নারী ও পুরুষের প্রত্যেককে ১০০ বেত্রাঘাত করো।
৩. মর্যাদার মাপকাঠি একমাত্র তাকওয়া: মহান রবের নিকট সর্বাধিক মর্যাদাবান তিনি যিনি অধিক তাকওয়াবান। এক দেশের মানুষের উপর অন্য দেশের মানুষের তথা অনারবের উপর আরবের এবং আরবের উপর অনারবের প্রধান্য পাওয়ার কোন কারণ নেই। তেমনি সাদার উপর কোন কালো কিংবা কোন কালোর উপর সাদার প্রধান্য নেই। সকল মানুষ এক আদম থেকে সৃষ্টি। আর আদম মাটি থেকে সৃষ্টি। মানুষ প্রধান্য পাবে একমাত্র তাকওয়ার ভিত্তিতে।

৪. সকল ধরণের সুদ নিষিদ্ধ: সুদের সকল প্রকার কারবার নিষিদ্ধ। জাহেলী যুগের সুদ পরিত্যাক্ত ও পরিত্যাজ্য। আমাদের সুদ সমূহের মধ্যে প্রথম যে সুদ আমি শেষ করছি সেটা হলো আব্বাস ইবনুল আবদিল মুত্তালিবের পাওনা সূদ। এ মর্মে কোরআনে এসেছে-“আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয় হালাল করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন।” (সূরা বাকারা-২৭৫)

৫. স্ত্রীদের সাথে উত্তম আচরণ: স্ত্রীদের সাথে সবসময় ভালো ব্যবহারের নির্দেশনা রয়েছে বিদায় হজের ভাষণে। স্ত্রীদের ওপর যেমন তোমাদের অধিকার রয়েছে, তদ্রƒপ তাদেরও তোমাদের ওপর অধিকার রয়েছে। স্ত্রীদের ওপর তোমাদের অধিকার হচ্ছে, তারা যেন নিজ স্বামী ছাড়া অন্য পুরুষের সাথে ভোগে লিপ্ত না হয়। যদি তারা তা করে তাহলে আল্লাহ পুরুষদের তাদের স্ত্রীদের প্রতি কঠোর হওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। শয্যা পৃথক করে, মৃদু প্রহার করে অথবা সতর্ক করে তাদের সঠিক পথে আনতে হবে। তাতে তারা বিরত হলে নিয়মমাফিক তাদের ভরণপোষণের প্রতি লক্ষ্য রাখবে ।

৬. নেতার আনুগত্য করা: নেতার আনুগত্য করো এবং তার কথা শ্রবণ করো যদিও তিনি হাবশী ক্রীতদাস হন। যতদিন পর্যন্ত কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে তোমাদের পরিচালিত করেন; ততদিন অবশ্যই নেতার কথা শুনবে, তার নির্দেশ মানবে ও তাঁর প্রতি অনুগত্য করবে। আর যখন আল্লাহর কিতাবের বিপরীতে যাবে তখন তার কথা মেনে নেয়া যাবে না এবং আনুগত্য করা যাবে না।

৭. অধিনস্তদের অধিকার সংরক্ষণ : হে মানব সম্প্রদায় কোন দুর্বল মানুষের উপর অত্যাচার করো না। গরীবদের উপর অত্যাচার করো না। সাবধান! কারো অসম্মতিতে কোন জিনিস গ্রহণ করো না। অধীনস্থদের সম্পর্কে সতর্ক হও; তোমরা নিজেরা যা খাবে তাদেরও তা খাওয়াবে, নিজেরা যা পরবে তাদেরও তা পরাবে। শ্রমিকের শরীরের ঘাম শুকানোর আগেই তার মজুরি পরিশোধ করবে।

৮. সর্বশেষ নবী: হে লোকসকল শুনে রেখ, আমার পরে কোন নবী নেই এবং তোমাদের পরে আর কোন উম্মত নেই। অতএব তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ইবাদত কর , রমজান মাসে সিয়াম পালন করো, সন্তুষ্টিসহ তোমাদের মালের যাকাত দাও, তোমাদের প্রভুর ঘরে হজ পালন করো; তোমাদের শাসকের আনুগত্য কর; তোমাদের প্রতিপালকের জান্নাতে প্রবেশ কর সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে।

৯. উত্তরাধিকার অংশ নির্ধারণ: হে লোকসকল, মহান আল্লাহ প্রত্যেক উত্তারাধিকারীর অংশ নির্ধারণ করে দিয়েছেন । অন্যদের জন্য এক-তৃতীয়াংশের অধিক ওসিয়ত করা বৈধ নয়। উত্তরাধিকারীর অধিকারসহ সকল নেয়ামত সম্পর্কে আমাদের সকলকে কিয়ামত দিবসে জিজ্ঞাসা করা হবে।

১০. ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক: প্রত্যেক মুসলমান ভাই ভাই। হে লোকসকল তোমরা সকলেই এক ভ্রাতৃত্বে বন্ধনে আবদ্ধ। সুতরাং কেউ কারো প্রতি অবিচার করো না। মুসলিম সেই ব্যক্তি যার জবান ও হাত থেকে তার ভাই নিরাপদ।
১১. প্রতিবেশীর অধিকারঃ প্রতিবেশীর অধিকার বিষয়ে সচেতন থাকতে বলা হয়েছে বিদায় হজের ভাষণে। রাসূল (সাঃ) বলেন ঐ ব্যক্তি মুমিন হতে পারে না যে দুবেলা পেট পূর্ণ করে আহার করে, আর তার প্রতিবেশী অনাহারে থাকে। ঐ ব্যক্তি মুসলিম হতে পারে না যখন সে নিজের জন্য যা পছন্দ করে, তা অন্যের জন্যেও পছন্দ করে না।

১২. ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কার: রাসূল (সাঃ) বলেন, সাবধান ; ধর্ম স¤পর্কে বাড়াবাড়ি করো না। এ বাড়াবাড়ির ফলে তোমাদের পূর্ববর্তী বহু জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে। তোমরা ধর্মভ্রষ্ট হয়ে পর¯পরের সংঙ্গে ঝগড়া ও রক্তপাতে লিপ্ত হয়ো না। এ মর্মে কোরআনে এসেছে-“ তোমাদের কর্ম ও কর্মফল তেমাদের জন্যে এবং আমার কর্ম ও কর্মফল আমার জন্য।” সূরা কাফিরুন-৬) । কুরআন ও হাদিসের আলোকে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দেয়া মুসলমানের দায়িত্ব।

১৩. ঘুষ নিষিদ্ধ করণ: কোন ফায়সালা নিজের পক্ষে নিতে উৎকোচ প্রদানকে ঘুষ বলে। ঘুষ গ্রহণ মহাপাপ। যাদের আমরা শাসনকার্যে নিযুক্ত করি, আমরা তার ভরণ পোষণের ব্যবস্থা করি। এরপরেও যদি সে অতিরিক্ত কিছু গ্রহণ করে তা ঘুষ বলে গণ্য হবে ।

১৪. দায়িত্বশীলতা: প্রত্যেক মানুষকেই মহান আল্লাহর সামনে এককভাবে ভালো মন্দের হিসাব নিয়ে হাজির হতে হবে । তোমরা সাবধান ; সেইদিন কেউ কারো সাহায্য করতে পারবে না।

১৫. পিতা-মাতার হক আদায়: হে লোকসকল, তোমরা জেনে রাখো তোমাদের মাতা-পিতার সন্তুষ্টিই আল্লাহর সন্তুষ্টি। মাতা-পিতার অন্তুষ্টিই আল্লাহর অসন্তুষ্টি। মাতা-পিতাই তোমার জান্নাত, তারাই তোমার জাহান্নাম। সুতরাং তাদের সাথে সদাচরণ করো। পবিত্র আল কোরআনে আল্লাহর ইবাদতের পরেই তাদের সাথে সদাচরণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমার রব নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর। তাদের মধ্যে একজন অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে ‘উহ’ শব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না, আর তাদের সাথে সম্মানজনক ভাষায় কথা বল। রহমের সাথে তাদের প্রতি বিনয়াবনত থেকো এবং বল, হে রব, তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমনিভাবে তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন। (বনী ইসরাঈল ২৩-২৪)

ইসলামী মৌলিক বার্তাগুলো বিদায় হজের ভাষণে হযরত মুহাম্মদ (স:) সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। এই চূড়ান্ত দিক নির্দেশনার আলোকে মহান আল্লাহর প্রতি আনুগত্য, তাঁর সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি, মানবজাতির ঐক্য, আধ্যাত্বিক ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টির মাধ্যমে নিজেদেরকে সত্যের সাক্ষ্যে পরিণত করতে হবে। নিজের বিশ^াসের পাশাপাশি দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ অর্জনের এই কাজকে সত্যায়ন করতে হবে। সুন্দর, নিরাপদ ও কল্যাণধর্মী সমাজ বির্নিমাণের সকল পাথেয় রয়েছে বিদায় হজের এই ভাষণে।

লেখক– মোঃ সাঈদ জুনাইদ
সার্টিফায়েড শরীয়াহ অ্যাডভাইজর অ্যান্ড অডিটর, আওফি, বাহরাইন
অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক পিএলসি

আরও যা পড়তে পারেন

কমেন্ট করুণ