প্রথম মার্কিন নাগরিক হিসেবে ক্যাথলিক ধর্মের শীর্ষ নেতা নির্বাচিত হয়েছেন পোপ লিও চতুর্দশ। ১৯৫৫ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে জন্মগ্রহণ করেন। এ ছাড়া তিনি ল্যাতিন আমেরিকার দেশ পেরুর নাগরিক। গত দুই দশক ধরে দুই দেশের (ডুয়েল সিটিজেন) নাগরিক থেকে মিশনারি ও বিশপের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
পোপ হিসেবে তিনি নতুন করে ভ্যাটিক্যান সিটি ও ক্যাথলিক চার্চের সর্বোচ্চ নেতা। ভ্যাটিক্যান হচ্ছে সার্বভৌম রাষ্ট্র। ১৯২৯ সালে ইতালি ও পবিত্র নগরীর মধ্যে এক চুক্তির মাধ্যমে ভ্যাটিকান স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পায়। এটি বিশ্বের সবচেয়ে ছোট দেশ।
মার্কিন নাগরিক হওয়া সত্বেও সার্বভৌম দেশ ভ্যাটিকেনের সরকার প্রধান হয়েছেন লিও। এক দেশের নাগরিক হয়ে আরেক দেশের সরকার প্রধান হওয়ার পর লিওর মার্কিন নাগরিক থাকতে পারবেন কিনা এই নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে নানা মহলে।
পোপ লিওর কি মার্কিন নাগরিকত্ব রাখার বৈধতা আছে?
বিদেশে সরকারের জন্য কাজ করা মার্কিনীরা তাদের নাগরিকত্ব হারানোর ঝুঁকিতে থাকে না। তবে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটের তথ্য বলছে, বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান বা পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী ব্যক্তিদের নাগরিকত্বের অবস্থা পর্যালোচনা করতে পারে পররাষ্ট্র দপ্তর।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, এই ধরনের বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইনের জটিল প্রশ্ন উত্থাপন করে, যার মধ্যে দায়মুক্তির বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

সাপ্তাহিক সাধারণ দর্শনে ভ্যাটিকানের সেন্ট পিটার্স স্কোয়ারে পোপ লিও চতুর্দশ, ছবি: এপি
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর পোপের মর্যাদা সম্পর্কে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। স্টেট ডিপার্টমেন্টের একজন মুখপাত্র বলেছেন, পররাষ্ট্র দপ্তর নাগরিকত্ব নিয়ে আলোচনা করে না।
বিদেশি নেতাদের কি মার্কিন নাগরিকত্ব রাখা উচিত? বিশেষ করে যখন তারা মার্কিন নাগরিক থেকেও অন্য দেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানের মতো নানান সুবিধা ভোগ করেন?
এই প্রসঙ্গে ১৯৮০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রীমকোর্ট এক আদেশে বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র তার বিদেশি নাগরিকদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিতে পারবে না যদি কেউ ইচ্ছে করে নাগরিকত্ব ত্যাগ না করেন।
পেনসিলভানিয়ার অঙ্গরাজ্যের টেম্পল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অধ্যাপক ও নাগরিকত্ব আইন বিশেষজ্ঞ পিটার স্পিরো বলেছেন, স্টেট ডিপার্টমেন্ট কখনই চায় না কেউ নাগরিকত্ব হারাক। যদি না কেউ নিজ থেকে তা ত্যাগ করেন।
পেরুর ন্যাশনাল রেজিস্ট্রি অফ আইডেন্টিফিকেশন অ্যান্ড সিভিল স্ট্যাটাসের রেজিস্ট্রি আর্কাইভের ডেপুটি ডিরেক্টর জর্জ পুচ বলেন, পোপ লিওর পেরুর নাগরিকত্ব ত্যাগ নিয়ে আইনের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। লিও ২০১৫ সালের আগস্টে নিয়ম-কানুন মেনে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেন।
প্রয়াত পোপ ফ্রান্সিস তাকে (লিও) বিশপ নিয়োগের মাস খানেক আগে তিনি নাগরিত্বের জন্য আবেদন করেন। নাগরিকত্ব পরীক্ষা ও টানা দুই বছর পেরুতে থাকার পাশাপাশি দেশের সব ধরনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এটা খুবই প্রসংশনীয় যে জন্মসূত্রে নাগরিক না হলেও পেরুর নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন।

সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, ছবি: কোয়ার্জ ডটকম
পেরুর সব প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক ৬৯ বছর বয়স পর্যন্ত ভোট দেয়া বাধ্যতামূলক। আগামী বছরের এপ্রিলে পেরুর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লিও ৭০ বছরে পদার্পন করবেন। তখন তার ভোট দেয়া বাধ্যতামূলক নয়।
পোপদের কি নিজ দেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করা বাধ্যতামূলক?
লিওর পূর্বসূরীরা পোপ হওয়ার পর তাদের নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছিল কী না স্পষ্ট নয়। ভ্যাটিকানও এই বিষয়ে তথ্য প্রকাশ করে না। তবে প্রয়াত পোপ ফ্রান্সিস ২০১৪ সালে তার নিজ দেশ আর্জেন্টিনার নাগরিকত্ব ত্যাগ করেন। পোপ নির্বাচিত হওয়ার এক বছর পর তিনি আর্জেন্টিনার নাগরিকত্ব ত্যাগ করেন।
জার্মানিতে জন্ম নেওয়া পোপ বেনেডিক্ট ও পোল্যান্ডে জন্ম নেওয়া পোপ জন পল নিজ নিজ দেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছে কিনা এই বিষয়ে কোনও তথ্য প্রকাশিত হয়নি।
নিউইয়র্কের সিরাকিউজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ও আমেরিকান ক্যাথলিক ধর্মের বিশেষজ্ঞ মার্গারেট সুসান থম্পসন লিও প্রসঙ্গে বলেন, পোপ লিও মার্কিন নাগরিকত্ব ত্যাগ করবেন কি না এই বিষয়ে স্পষ্ট বার্তা পাওয়া মুশকিল। তবে পোপ নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথম ভাষণে ইংরেজি ভাষার বদলে ইতালিয়ান ও স্প্যানিশ ভাষা ব্যবহার করেছেন। আমি মনে করি তিনি বৈশ্বিক ক্যাথলিক চার্চ হবেন। এই পজিশনে থেকে নিশ্চয়ই তিনি আমেরিকার প্রতিনিধিত্ব করবেন না।

সোমালিয়ার প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আব্দুল্লাহি মোহাম্মদ, ছবি: ফ্রান্স২৪ ডটকম
প্রশ্ন হচ্ছে সরকারের শীর্ষ পদে কী এর আগে কোনও মার্কিন নাগরিক ছিলেন? এর উত্তর হচ্ছে হ্যাঁ। এই সারিতে কয়েকজন বিশ্ব নেতা রয়েছেন, যারা মার্কিন নাগরিক হয়েও ভিনদেশে সরকার বা রাষ্ট্র প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন।
উদাহরণস্বরুপ বলা যায়, সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ১৯৬৪ সালে আমেরিকার নিউ ইয়র্ক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা-মা উভয়ই ব্রিটিশ। তরুণ বয়সেই বরিস জনসন যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগ করেন এবং ২০১৬ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পর মার্কিন নাগরিকত্ব ত্যাগ করেন। তিন বছর পর তিনি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।
মার্কিন নাগরিক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহি মোহাম্মদ ২০১৭ সালে সোমালিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। সোমালিয়ায় জন্ম নেয়া আব্দুল্লাহি ১৯৮৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে থিতু হন। ১৯৯০ সালে তিনি মার্কিন নাগরিক হন। সোমালীয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার দুই বছর পর মোহাম্মদ মার্কিন নাগরিকত্ব ত্যাগ করেন।
সোভিয়েত (বর্তমান রাশিয়া) দখলদারিত্ব থেকে বাঁচতে ভালদাস অ্যাডামকুসের পরিবার লিথুয়ানিয়া থেকে পালিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যান। এরপর তিনি মার্কিন নাগরিক হন। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার কয়েক বছর পর ১৯৯৮ সালে তিনি লিথুয়ানিয়ার প্রেসিডেন্ট পদে ফিরেন। নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি মার্কিন নাগরিকত্ব ত্যাগ করেন।
সূত্র: এপি