Home লাইফস্টাইল মনের খোরাক ‘চা’

মনের খোরাক ‘চা’

তাসনিম তাবাসসুম
৯২ views

পানির পর বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় পানীয় কোনটি জানেন কি? উত্তর হলো— আড্ডায় বাঙালির প্রিয় অনুষঙ্গ ‘চা’। বিশ্বজুড়ে প্রতি সেকেন্ডে ২৫ হাজার কাপ চা পান করে মানুষ। ‘চা’কে বলা হয় ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে ঠাসা একটি মজার পানীয়। ব্রিটিশ রাজপরিবারের চা-অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে বাংলাদেশের রাস্তার জমজমাট টঙের দোকান পর্যন্ত চায়ের যাত্রাই তার জনপ্রিয়তার প্রমাণ দেয়।

সকালে ঘুম থেকে উঠেই ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে দিন শুরু করেন অনেকে। এরপর অফিসে কাজের ফাঁকে, বন্ধুদের আড্ডায়, সন্ধ্যার নাস্তায় চা ছাড়া চলেই না। কিন্তু চীনের চা এই বঙ্গদেশে এলো কীভাবে?

১৬৫০ সালে চীনে বাণিজ্যিকভাবে চায়ের উৎপাদন শুরু হয়। আর ভারতবর্ষে এর চাষ শুরু হয় ১৮১৮ সালে। এ সময় ভারতবর্ষের আসাম ও তৎসংলগ্ন এলাকায় চা চাষ শুরু হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ১৮২৮ সালে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার কর্ণফুলী নদীর তীরে চা আবাদের জন্য জমি বরাদ্দ হয়। কিন্তু বিভিন্ন কারণে চা চাষ বিলম্বিত হওয়ার পর ১৮৪০ সালে চট্টগ্রাম শহরের বর্তমান চট্টগ্রাম ক্লাব সংলগ্ন এলাকায় একটি চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়, যা কুন্ডদের বাগান নামে পরিচিত। ১৮৫৪ সালে, মতান্তরে ১৮৪৭ সালে সিলেট শহরের এয়ারপোর্ট রোডের কাছে মালনীছড়া চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়। মূলত, মালনীছড়াই বাংলাদেশের প্রথম বাণিজ্যিক চা বাগান।

নিছক সময় কাটানোর জন্যই চা পান করা হয়, তা নয়। চা পাতার আছে  অনেক গুণাগুণ। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে আমরা যে ‘স্ট্রেস কন্ডিশন’ বা মানসিক চাপে পড়ে যাই সেখান থেকে আমাদের শরীরের ভেতরে অক্সাইডস নামের এক ধরনের উপাদান সৃষ্টি হয়। চা এই চাপ প্রশমনে ভূমিকা রাখে।

গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন যারা অন্তত তিন কাপ চা পান করেন তাদের হতাশার ঝুঁকি, চা পান না করা ব্যক্তিদের তুলনায় ৩৭ শতাংশ কম থাকে।

চা পানের রীতি ভৌগোলিক অবস্থান ভেদে একেক দেশে একেক রকম। চলুন এমন কিছু ঐতিহ্যবাহী চা পানের রীতি সম্পর্কে জেনে নেই।

চীনের গংফু চা অনুষ্ঠান: একটি দক্ষ শিল্পকর্ম

চাইনিজ গংফু চা অনুষ্ঠান হলো চা প্রস্তুত ও পরিবেশনের একটি ঐতিহ্যবাহী রীতি। একটি ছোট ইজিং মাটির কাপে চা পরিবেশন করা হয়। এই আয়োজনে চা তৈরির প্রক্রিয়ার নান্দনিকতার ওপর জোর দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানটিতে সুনির্দিষ্ট কিছু ধাপ থাকে। যেমন— চা পাতা নির্বাচন করা এবং তা ধোয়া, টি পট ও কাপ গরম করা এবং একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে চা ঢালা। অনুষ্ঠানের লক্ষ্য হলো চায়ের বর্ণ, গন্ধ ও স্বাদকে সম্পূর্ণভাবে উপলব্ধি করা। এই পুরো প্রক্রিয়টি মনকে শান্ত করে ও মানসিক প্রশান্তি যোগায়।

জাপানি ‘ওয়ে অফ টি’

জাপানি চা অনুষ্ঠান, ওয়ে অফ টি নামেও পরিচিত। এই রীতি বা আচার বহু শতাব্দী ধরে চলে আসছে। জাপানিরা উৎসবমুখর পরিবেশে গ্রিন টি তৈরি এবং পরিবেশন করে। এই চা ‘মাচা টি’ নামে বহুল পরিচিত। চা অনুষ্ঠানটি সাধারণত একটি ঐতিহ্যবাহী জাপানি ঘরে সঞ্চালিত হয়। একজন চা মাস্টারের নেতৃত্বে করা হয় যিনি চা প্রস্তুত করেন এবং অতিথিদের আপ্যায়ন করেন।

TEA2

ব্রিটিশদের রাজকীয় বিকেলের চা ও আর্জেন্টিনার ইয়ারবা মেট।

ব্রিটিশদের রাজকীয় বিকেলের চা

বিকেলের চা একটি ব্রিটিশ ঐতিহ্য যা ১৯ শতকের শুরু থেকে প্রচলিত। এই আয়োজনে সাধারণত চা বা কফির সাথে পরিবেশিত স্যান্ডউইচ, স্কোন, পেস্ট্রির মতো হালকা নাস্তা থাকে। এই ঐতিহ্যের উৎপত্তি বেডফোর্ডের সপ্তম ডাচেস আনার হাতে। তিনি শেষ বিকেলে প্রায়ই ক্ষুধার্ত অনুভব করতেন এবং তার জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানাতেন। পরবর্তীতে এই বিকেলের চা নাস্তার অনুশীলন ব্রিটিশ সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলোর মাঝে জনপ্রিয় সামাজিক অনুষ্ঠান হয়ে ওঠে।

ইয়ারবা মেট: আর্জেন্টিনার জাতীয় পানীয়

ইয়েরবা মেট হলো একটি ঐতিহ্যবাহী দক্ষিণ আমেরিকার চা যা আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে এবং ব্রাজিলের কিছু অংশে বিশেষভাবে জনপ্রিয়। এটি আইলেক্স প্যারাগুয়ারিয়েনসিস উদ্ভিদের পাতা থেকে তৈরি করা। এই চা স্বাদে তেতো, তাই কফির পরিবর্তে খাওয়া যায়।

TEA3

তুরস্কের ব্ল্যাক টি ও মরোক্কোর বার্বার হুইস্কি

তুরস্কের ব্ল্যাক টি

সাধারণত কৃষ্ণ সাগর উপকূলে রাইজ প্রদেশে এই ‘ব্ল্যাক টি’র চাষ হয়। তুরস্কের চা সুঘ্ৰাণ ও গাঢ় রঙের জন্য পরিচিত। অনেক উঁচু থেকে চা ঢালা তুর্কিদের ঐতিহ্য ও উদারতার প্রতীক। এই চা ছোট টিউলিপ আকৃতির গ্লাসে গরম গরম পরিবেশন করা হয়।

এটি তারা সারাদিনই পান করে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বন্ধু ও পরিবারের সাথে আয়োজন করে এই চা পান করে তুর্কিরা। এই অভ্যাসটি এখন কম জনপ্রিয় কিন্তু এখনও কিছু জায়গায় এর প্রচলন আছে।

মরোক্কোর বার্বার হুইস্কি

মরক্কোর পুদিনা চা, যা বার্বার হুইস্কি নামেও পরিচিত। তাজা পুদিনা পাতা ও প্রচুর পরিমাণে চিনি দিয়ে গ্রিন টি তৈরি করা হয়। এই চা সাধারণত ছোট গ্লাসে এবং পেস্ট্রি বা মিষ্টির সাথে পরিবেশন করা হয়। পুদিনা চা তৈরি ও পরিবেশন মরোক্কোতে একটি শিল্প হিসেবে বিবেচিত হয়। আতিথেয়তার চিহ্ন হিসাবে পুদিনার  চা পরিবেশন একটি সাধারণ অভ্যাস।

TEA4

রাশিয়ান সামোভার ও ভারতের মাসালা চা।

রাশিয়ান সামোভার

সামোভার হলো একটি ঐতিহ্যবাহী রাশিয়ান চা তৈরির যন্ত্র, যা আজও ব্যবহৃত হয়। এটি একটি বড় ধাতব কলস যা কাঠকয়লা বা বিদ্যুৎ দ্বারা উত্তপ্ত করা হয়, যা সামোভার চা তৈরি ও পরিবেশন করতে ব্যবহৃত হয়। সামোভার চা বিকেলে বা সন্ধ্যায় খাওয়া হয় এবং সাথে থাকে মিষ্টি বা পেস্ট্রি।

ভারতের মাসালা চা

মাসালা চা বা মশলাযুক্ত চা সমগ্র ভারত এবং এশিয়ার বেশকিছু অংশে জনপ্রিয়। এটি দুধ ও চিনির সাথে আদা, এলাচ, দারুচিনি এবং কালো মরিচের মতো মশলার মিশ্রণ মিশিয়ে তৈরি করা হয়। সাথে যোগ করা হয় গরুর দুধ। এটি ভারতে একটি প্রধান পানীয় হিসাবে বিবেচিত হয়। সাধারণত দিনে একাধিকবার ভারতীয়রা মাসালা চা খেতে পছন্দ করে। অনেকে মন করেন এটির অনেক ঔষধি গুণাগুণ রয়েছে।

5tongtea

টংয়ের চা বাংলাদেশি সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।

বাংলাদেশের টংয়ের চা

টংয়ের চা বা রাস্তার পাশের স্টল থেকে পরিবেশিত চা বাংলাদেশি সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই ছিমছাম চায়ের দোকানগুলো একটি অস্থায়ী টিনের ঘরে তৈরি করা হয়। চায়ের সাথে এখানে পাওয়া যায় বিভিন্ন রকম বিস্কুট, মিষ্টি, কেক, কলা, রুটি। এখন টং দোকানে অপরাজিতা চা, তেতুলের চা, মরিচের চা, পনির চাসহ নানা স্বাদের চা পাওয়া যায়। তবে দুধ চা ও রং চা সাধারণত সব জায়গায় থাকে।

শহর কিংবা গ্রাম, বাংলাদেশের প্রতিটি কোণেই দেখা মিলে এই টং ঘর বা দোকানের। টং এমন একটি জায়গা গড়ে ওঠে যেখানে সমাজের সকল স্তরের লোকেরা চা খেতে ভিড় জমায়। গল্প-আড্ডায় টং মুখরিত থাকে সারাদিন, এমনকি রাতেও।

চায়ের প্রতিটি চুমুকেই একটি গল্প উন্মোচিত হয়। এক কাপ চা মনে যে প্রশান্তি এনে দেয় তা অতুলনীয়। এই কারণেই সুস্বাদু এই পানীয় সমগ্র বিশ্বজুড়ে সমাদৃত।

আরও যা পড়তে পারেন

কমেন্ট করুণ