শিক্ষা, প্রযুক্তি, জীবনযাপন— যেকোনো বিচারেই জাপান বর্তমান বিশ্বের আধুনিকতম দেশ। এত আধুনিকতা সত্ত্বেও জাপানি জীবনধারায় হাজার বছরের পুরনো এমন কিছু ঐতিহ্য আছে যা তারা আজও মেনে চলে। এসব ঐতিহ্যবাহী রীতিনীতির অনেকগুলো আপাতদৃষ্টিতে অদ্ভুত মনে হলেও প্রতিটি কাজের পেছনেই আছে যুক্তি। চলুন নেওয়া জানা যাক জাপানিদের এমন কিছু রীতিনীতি যা আমরাও অনুসরণ করতে পারি।
টয়লেট পরিষ্কারে ভাগ্য পরিবর্তন
টয়লেট পরিষ্কার করা জাপানে খুবই ভালো অভ্যাস বলে বিবেচনা করা হয়। এটি তাদের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ এবং সামাজিক নিয়মের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। নিয়মিত টয়লেট পরিষ্কার করলে ‘উসুসামা মোয়ো’ নামের টয়লেট দেবতা অর্থনৈতিক সাফল্য এনে দেয়— এমনটাই বিশ্বাস করেন জাপানিরা। শুধু তাই নয়, তারা মনে করেন টয়লেট পরিষ্কার করা সৌভাগ্যও নিয়ে আসে।
জাপানি সংস্কৃতিতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং স্বাস্থ্যবিধির ওপর জোর দেওয়া হয়। একটি পরিষ্কার টয়লেট আপনার সামগ্রিক পরিচ্ছন্নতার ওপর ইতিবাচকভাবে প্রভাব ফেলতে পারে।
ফুরোশিকি (কাপড় মোড়ানো) ও মোত্তাইনাই (কোনো অপচয় নয়)
ফুরোশিকি হলো কোনো কিছু পুনর্ব্যবহারযোগ্য কাপড়ে মোড়ানো। এই পদ্ধতিতে উপহার র্যাপিং করা জাপানে প্রাচীনকাল থেকে অনুশীলন করা হচ্ছে। শুধু উপহার দেওয়ার জন্য নয়, ফুরোশিকি জিনিসপত্র মোড়ানো এবং বহন করার জন্যও বেশ উপযোগী। এর ফলে ডিসপোজেবল প্যাকেজিংয়ের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস পায়। ফুরোশিকি একই সাথে পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী।

ফুরোশিকি হলো কোনো কিছু পুনর্ব্যবহারযোগ্য কাপড়ে মোড়ানো
মোত্তাইনাই যেকোনো জিনিসের পুনর্ব্যবহারকে উৎসাহিত করে। অপচয় কমিয়ে এবং সম্পদের প্রতি সচেতন থাকার মাধ্যমে আপনি আরও পরিবেশবান্ধব ও মিতব্যয়ী জীবনযাপন করতে পারেন। যেমন- জাপানে অনেক বাড়িতে হাত ধোয়ার পানি বেসিন থেকে টয়লেটে পুনর্ব্যবহৃত হয়, অনেকে পুরানো কিমোনো দিয়ে তৈরি করা হয় স্কার্ফ। জাপানি রেস্টুরেন্টগুলোতে উদ্ভিদ বা প্রাণির প্রতিটি অংশ রান্না করার উপায় খুঁজে বের করেন বাবুর্চিরা, যাতে খাবারের অপচয় না হয়।
কোকোরো (মননশীলতা)
জাপানি সংস্কৃতি মননশীলতা এবং মুহূর্তে উপস্থিত থাকাকে মূল্য দেয়। অতীত নিয়ে চিন্তা আর ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তা— কোনোটাই সুফল বয়ে আনেনা। তাই যতটা সম্ভব বর্তমানকে উপভোগ করতে হবে। তাদের মতে, দৈনন্দিন রুটিনে মননশীলতার অনুশীলন চাপ কমাতে এবং মানসিক স্বাস্থ্য উন্নত করতে সহায়তা করতে পারে।
হারা হাচি বু (পরিমিত খাওয়া)
ভরপেট খাওয়াকে জাপানিরা নেতিবাচক চোখে দেখে। তাদের মতে, পেট ৮০ শতাংশ পূর্ণ হওয়ার পর আর খাওয়া উচিত না। এই অভ্যাস ভালো হজমে সাহায্য করে এবং অতিরিক্ত খাওয়া রোধ করে। এটি সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।

হারা হাচি বু (পরিমিত খাওয়া)
জাপানের অগিমী গ্রামে বসবাসকারীদের বলা হয় ওকিনাওয়ান। এরা ঐতিহ্যগতভাবে ‘হারা হাচি বু’ নীতি অনুসরণ করে। তাদের হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং ক্যান্সারের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগের হার কম। ‘হারা হাচি বু’ নীতিতে বিশ্বাসী ব্যক্তিরা তাদের খাবারের স্বাদ ও গঠনের দিকে মনোযোগ দেয়। তারা ধীরে ধীরে খেতে পছন্দ করে। এতে প্রতিটি কামড়ের স্বাদ আলাদাভাবে নেওয়া যায়। এর ফলে যেটুক খাওয়া হয় তা তৃপ্তি সহকারে খাওয়া হয় এবং অল্প খাবারেই পেট ভরে যায়।
ওসেক্কাই এবং ওমিয়াজ
জাপানিরা বিশ্বাস করে মাংস, মাছ, শাকসবজি ও ফলমূলে প্রাণ আছে। তাই আমাদের উচিত আহারের সব উপাদানের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা। আপনি যাই খান না কেন, আপনাকে অবশ্যই এটির জন্য কৃতজ্ঞ হতে হবে। জাপানে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সবচেয়ে সাধারণ উপায় হলো ‘আরিগাতো গোজাইমাস’ বা ‘আরিগাতো’ বলা।
‘ওসেক্কাই’ অনুশীলন করা উদারতা বা বিবেকবান হয়ে কাজ করাকে বোঝায়। জাপানি লোকেরা প্রায়ই কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উপায় হিসাবে অভিনব পদ্ধতি খুঁজতে থাকে। কখনও কখনও জাপানিরা শব্দের পরিবর্তে তাদের কর্মের মাধ্যমে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। উদাহরণস্বরূপ, কারও প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখানোর জন্য একটি প্রিয় খাবার রান্না করা, তারা একে নীরব প্রশংসা বলে।
উপহার দেওয়া, বা ‘ওমিয়াজ’ হলো কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একটি উপায়। সাধারণত তারা একে অন্যের বাড়িতে গেলে একটি ছোট উপহার নিয়ে যান। জাপানি সংস্কৃতিতে অতিথি আপ্যায়নের জন্য গ্রিন টি পান করতে দেওয়া হয়। কারও উপস্থিতিতে যে আপনি আনন্দিত তা প্রকাশ করার উপায় এটি।
ওয়্যারে তাদা তারু উ শিরু
‘ওয়্যারে তাদা তারু উ শিরু’ হলো ১৭ শতকে নির্মিত কিয়োটোর রায়ানজি মন্দিরের বেসিনে একটি শিলালিপি। আমরা প্রায়ই নিজের জীবনে যা নেই অন্যের জীবনে তা দেখে অসন্তুষ্ট বোধ করি। যা নেই তা নিয়ে আফসোস না করে, যা আপনার কাছে ইতিমধ্যেই আছে তাতে সন্তুষ্টি প্রকাশ করাই ‘ওয়্যারে তাদা তারু উ শিরু’র মূলমন্ত্র।
তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠা
জাপানিরা অনেক আগে থেকেই ঘুমাতে যাওয়া এবং তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠার এই অভ্যাসটিকে মূল্য দিয়ে আসছে। কারণ অতীতে জাপানিরা প্রতিদিন সকালে সূর্যের উপাসনা করত। তারা সর্বদা একটি দিন শুরু করত সূর্যকে সম্মান প্রদর্শন করে এবং সূর্যকে উদ্দেশ্য করে বলতো, সবসময় আমাদের দিকে তাকানোর জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
কিন্টসুগি বা অসম্পূর্ণতার সৌন্দর্য
কিন্টসুগি হলো ভাঙা মাটির পাত্রকে সোনার বা রৌপ্য বার্নিশ দিয়ে জোড়া লাগানোর ঐতিহ্যবাহী শিল্প, যা অপূর্ণতার সৌন্দর্যকে তুলে ধরে। কিন্টসুগির প্রথাটি এই ধারণাকে প্রতিফলিত করে যে কিছুই চিরকাল স্থায়ী হয় না। মূল্যবান ধাতু দিয়ে ভাঙা মৃৎপাত্র মেরামত করার প্রকৃত অর্থ হলো অপূর্ণতা বা দাগ আসলে সৌন্দর্য এবং শক্তির উৎস।

কিন্টসুগি হলো ভাঙা মাটির পাত্রকে সোনার বা রৌপ্য বার্নিশ দিয়ে জোড়া লাগানো
নিরন্তর উন্নতি ‘কাইজেন’
কাইজেনের জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান উন্নতির ওপর জোর দেয়। কাইজেন স্ব-উন্নতি বা ‘ভালোর জন্য পরিবর্তনে’র মানসিকতাকে উৎসাহিত করে, যা উল্লেখযোগ্য দীর্ঘমেয়াদী সুবিধার দিকে নিয়ে যেতে পারে।
বৈপ্লবিক কোনো পরিবর্তন চাওয়ার পরিবর্তে ‘কাইজেন’ ক্রমাগত ছোটমাপের উন্নতি সাধনে উৎসাহিত করে। সময়ের সাথে সাথে এই ক্রমবর্ধমান পরিবর্তনগুলো ভবিষ্যতের জন্য আরও বড় মাপের উন্নতির ভিত তৈরি করে।
বলা হয়, জাপানিদের জীবনের আপাত অদ্ভুত এই নিয়মগুলোর কারণেই তাদের সুস্থতার হার ও বেঁচে থাকার সময়সীমা সবচেয়ে বেশি। আসলেই কী এই নিয়মগুলো অদ্ভুত? নাকি অন্যরাই উল্টোরথে আছেন?