‘একজন নারী কি পোশাক পরেছে তা কারও মনে না থাকলেও তার ব্যবহৃত সুগন্ধির স্মৃতি মানুষ দীর্ঘদিন ভুলতে পারে না।’— ক্রিস্টিয়ান ডিওর
সুগন্ধির উৎপত্তির ক্ষেত্রে বিভিন্ন তত্ত্ব রয়েছে, তবে সাধারণত মেসোপটেমীয়, পারসিক এবং মিশরীয়দের বিশ্বের প্রথম সুগন্ধি নির্মাতা হিসাবে সমানভাবে উল্লেখ করা হয়।
মিশরীয়রা প্রায় ৪০০০ বছর আগে ধর্মীয় অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে দাফনের প্রস্তুতি, এমনকি প্রতিদিনের পোশাকেও সুগন্ধি ব্যবহার করতো। তারা মনে করতো, সুগন্ধি হলো সূর্য দেবতার ঘাম। তাই এটির ব্যবহার একটি পবিত্র গুণ হিসেবে বিবেচিত হতো। মিশরীয়দের মতে, নেফারটাম নামে একজন সুগন্ধির দেবতা ছিলেন যিনি পদ্ম ফুলের তৈরি পোশাক পরতেন। বর্তমানে পদ্ম ফুল বহুল ব্যবহৃত সুগন্ধি তৈরির উপাদানগুলোর মধ্যে একটি।
পার্সিয়ানরাও সুগন্ধির দারুণ ভক্ত ছিল এবং এটি তাদের রাজনৈতিক মর্যাদার প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হতো। তারা এতটাই সুগন্ধি ব্যবহার করতো যে ভিন্টেজ পারসিক পেইন্টিংয়ে দেখা যায় রাজারা পারফিউমের বোতল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
ব্যাবিলন ছিল একটি প্রাচীন শহর যা দক্ষিণ মেসোপটেমিয়ার কাছে ইউফ্রেটিস নদীর তীরে অবস্থিত। বর্তমানে এটি ইরাকের অংশ। পৃথিবীর প্রথম রসায়নবিদ তাপপুতি বেলাতেকালিমের জন্ম এখানেই। আর বিক্রিয়ায় পারদর্শী এই নারী প্রথম যে দ্রবণটি তৈরি করেন তা হলো সুগন্ধি। বিভিন্ন ফুলের নির্যাস, তেল ও সুগন্ধি আঠা দিয়ে তিনি এটি তৈরি করেছিলেন।
পারফিউম বোতল থেকে আসা মিষ্টি সুবাস শুধুই একটি ঘ্রাণ নয়, এটি ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে নারীদের জীবনের পরিবর্তনের একটি নীরব প্রমাণ। বিংশ শতাব্দীর বিশের দশক থেকে একবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত বিভিন্ন সুগন্ধি সমাজে নারীদের ক্রমবর্ধমান ভূমিকা, তাদের আকাঙ্ক্ষা এবং তাদের সামাজিক রীতিনীতির প্রতিফলন ঘটিয়েছে। চলুন জেনে নেই সমাজের সাথে কীভাবে যুগে যুগে সুগন্ধির পরিবর্তন হয়েছে।

১৯২১ সালে চিরতরে পারফিউমের বিশ্বকে বদলে দেয় ‘শ্যানেল নম্বর ফাইভ’।
বিংশ শতাব্দীর ‘সুগন্ধি বিপ্লব’
১৯২১ সালে একটি বিপ্লবী সুগন্ধি চিরতরে পারফিউমের বিশ্বকে বদলে দেয়, নাম ‘শ্যানেল নম্বর ফাইভ’। এই আইকনিক ঘ্রাণের পিছনে মাস্টারমাইন্ড ছিলেন কোকো শ্যানেল।
‘শ্যানেল নম্বর ফাইভ’র আগে মেয়েদের পারফিউম ভারী ফুলের ঘ্রাণযুক্ত ছিল, যার উদ্দেশ্য ছিল পুরুষদের আকৃষ্ট করা। এরপর শ্যানেল একটি সুগন্ধি তৈরি করতে চাইল যা আধুনিক নারীসত্তাকে ধারণ করে। বিংশ শতাব্দীর নারীরা স্বাধীন, পরিশীলিত এবং আত্মবিশ্বাসী। তিনি বিখ্যাত পারফিউম প্রস্তুতকারক ‘আর্নেস্ট বো’র সাথে মিলে অনেকগুলো সুগন্ধির একটি সিরিজ তৈরি করেছিলেন। পরবর্তীতে শ্যানেল সিরিজের পঞ্চম নমুনাটি বাজারজাত করার জন্য নির্বাচন করে যা আজ বিশ্বে ‘শ্যানেল নম্বর ফাইভ’ নামে সুপরিচিত।

নারীত্বের প্রতীক গোলাপী রঙের মোড়কে বাজারে আনা হয় ফুলের ঘ্রাণযুক্ত পারফিউম।
যুদ্ধ-পরবর্তী কমনীয়তা: ঐতিহ্যে প্রত্যাবর্তন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীতে বিষণ্নতা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য সুগন্ধির মাঝেও পরিবর্তন আনা হয়। চিরাচরিত নারীত্বের প্রতীক গোলাপী রঙের মোড়কে বাজারে আনা হয় ফুলের ঘ্রাণযুক্ত পারফিউম। আগের দশকের শক্তিশালী, ভারী পারফিউমের পরিবর্তে হালকা সুবাসের সুগন্ধি জনপ্রিয় হতে থাকে। মজার ব্যাপার হলো, তখনকার পারফিউমের বিজ্ঞাপনগুলোর প্রধান লক্ষ্য ছিল পুরুষ ক্রেতারা। সেই সময় বিজ্ঞাপনগুলো এমনভাবে তৈরি করা হতো যাতে পুরুষরা নারীদের উপহার দেওয়ার জন্য এই সুগন্ধিগুলো কিনে।

সত্তরের দশকের পরিবেশগত সচেতনতার প্রভাব পড়ে সুগন্ধির ওপর, জনপ্রিয়তা পায় আর্থি স্মেল।
নারীবাদী যুগের বিদ্রোহের ঘ্রাণ
১৯৬০ ও ৭০-এর দশকে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের সময় সুগন্ধির জগতে ঘটে আরেক বিপ্লব। ঘাস, খড়, মাটির মতো প্রাকৃতিক ‘আর্থি স্মেল’ যুক্ত হয় সুগন্ধিতে। এটা কিন্তু কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়। সত্তরের দশকে বিশ্বজুড়ে বৈশ্বিক উষ্ণায়ণ বা গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ে সবাই সচেতন হতে শুরু করে। এই পরিবেশগত সচেতনতার প্রভাব পড়ে সুগন্ধির ওপর। ‘আর্থি স্মেল’ এর পারফিউম বর্তমানেও ব্যাপক জনপ্রিয়।
নারী ক্ষমতায়নের যুগের দৃঢ় সুবাস
আশির দশকের সুগন্ধিগুলো ছিল নারীর ক্ষমতায়নের প্রতীক। বলা হয়ে থাকে, এ সময়ের নারীরা সাহসী, উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও ঐশ্বর্যময়ী। এই আধুনিক নারীরা যাতে সবার মনোযোগ ও আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়, এমন বিবৃতি প্রতিষ্ঠা করার জন্যই বোল্ড ঘ্রাণের সুগন্ধিগুলো তৈরি করা হতো।
একবিংশ শতাব্দী: অন্তর্ভুক্তির সুবাস
বর্তমানে সুগন্ধি আগের চেয়ে অনেক বৈচিত্র্যময় ও সমৃদ্ধ। এখন পারফিউম লিঙ্গের ওপর ভিত্তি করে নয় বরং ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যাতে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় তা মাথায় রেখে তৈরি করা হয়। পারফিউম একাডেমির মতে, বর্তমানে ‘লাইফস্টাইল পারফিউম’ এর আবির্ভাব ঘটেছে। আধুনিক যুগের পারফিউম ব্র্যান্ডগুলো বিভিন্ন তারকাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে থাকে এবং তাদের জনপ্রিয়তা ও প্রচারণার ওপর অনেকাংশেই পারফিউমের বাজারমূল্য নির্ভর করে।
সময়ের সাথে পরিবর্তনশীল সমাজে সুগন্ধিতেও আসবে নানান সংযোজন। সুগন্ধি একটি ব্যক্তিগত অভিব্যক্তি। তাই নিজের ব্যক্তিত্বের সাথে মানাসই সুঘ্রাণযুক্ত পারফিউম ব্যবহার করাই শ্রেয়।