গত ১৭ দিন ধরে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) পদ শূন্য রয়েছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ৬টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের। গত ১৯ সেপ্টেম্বর সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক ও বিডিবিএলের এমডিদের নিয়োগ বাতিল করে পৃথক প্রজ্ঞাপন জারি করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। একইসঙ্গে ছয় এমডিকে সরিয়ে দেওয়ায় দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে ব্যাংকগুলোর সার্বিক কার্যক্রমে স্থবিরতা নেমে এসেছে। এসব ব্যাংকের নতুন চেয়ারম্যানরাও এমডি না থাকায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছেন না।
এদিকে এসব ব্যাংকের এমডি হতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন সরকারি ব্যাংকের অবসরে যাওয়া ও বর্তমান উপব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (ডিএমডি) কেউ কেউ। তবে তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে অর্থ পাচার ও বিভিন্ন ঋণখেলাপি গ্রুপের সঙ্গে সখ্যের অভিযোগ রয়েছে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের একটি সূত্র জানায়, সরকারি ব্যাংকগুলোর পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা নতুন করে সাজানো হচ্ছে। এ জন্য ব্যাপক রদবদল চলছে। আলোচ্য ছয় ব্যাংকের এমডি হওয়ার যোগ্য এমন ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সরকারি ব্যাংকের বর্তমান ও অবসরে যাওয়া ডিএমডিদের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের দক্ষ ব্যাংকারদের নামও ভাবা হচ্ছে। কারণ, সরকারি খাতে ব্যাংক চালানোর মতো দক্ষ ও সৎ ডিএমডির ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করা হয়।
ব্যাংক পাড়ায় চাউর আছে, সরকারি সাবেক আমলাদের এসব ব্যাংকের দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে। এছাড়া অবসরে যাওয়া সাবেক ডিএমডি ও এমডিদেরও এসব ব্যাংকে এমডি হিসাবে বসানো হতে পারে। সূত্র মতে, অন্তর্বর্তী সরকারের শুরুতে অস্থিতিশীল আর্থিকখাত ধীরে ধীরে স্বাভাবিক ধারায় ফিরছে।
বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুই বছর ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর (ডিএমডি) পদে দায়িত্ব পালন করেছেন এমন ব্যক্তিদের মধ্য থেকেই এমডি নিয়োগ দিতে হবে। এক্ষেত্রে বর্তমান অধিকাংশ ডিএমডিই সাবেক আওয়ামী সরকারের আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত। তারা কোনো না কোনোভাবে পতিত আওয়ামী সরকারের সুবিধাভোগী কিংবা ব্যাংক লুটের কার্যক্রমে সহায়তাকারী। সেক্ষেত্রে এমডি নিয়োগের ক্ষেত্রে নতুন সঙ্কট সৃষ্টি হতে পারে।
ডিএমডি পদে দায়িত্বরত একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদেরকে ব্যাংকগুলোর এমডি পদে নিয়োগ দিলে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হতে পারে। কারণ, গত আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে তাদেরকে বাধ্যতামূলক অংশগ্রহণ করতে হয়েছে।
আবার একাধিক ব্যাংকের কর্মকর্তা জানিয়েছেন, নতুন এমডি নিয়োগের ক্ষেত্রে যারা যে ব্যাংক থেকে মহাব্যবস্থাপক (জিএম) হয়েছেন তাদেরকে ওই ব্যাংকে নিয়োগ দেওয়া যথোপযুক্ত। কারণ, তিনি ওই ব্যাংকের আদ্যোপান্ত জানেন। ব্যাংকটিকে আরও কিভাবে ভালো করা যায় সেটা নিয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিতে পারবেন।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এখন ব্যাংকগুলো তাদের বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এমডিদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করলেও মন্ত্রণালয় থেকে ভারপ্রাপ্ত এমডি হিসেবেও কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি।
সূত্র জানায়, ৬টি ব্যাংকের সকল কার্যক্রমে স্থবিরতা নেমে এসেছে। যা পতিত হাসিনা সরকারের রেখে যাওয়া ভঙ্গুর আর্থিক খাতের জন্য আরও বিপর্যয় নিয়ে আসতে পারে।
সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় আছে বেসিক ব্যাংক ও জনতা ব্যাংক। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ শেখ আবদুল হাই বাচ্চু ২০০৯-১৪ সালে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকাকালে সেটিতে নজিরবিহীন অর্থ লুটপাটের ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় ও সরকারি বিভিন্ন সংস্থা সব জেনেও অনিয়ম ঠেকায়নি। ব্যাংকটির তখনকার এমডি কাজী ফখরুল ইসলামও ছিলেন এসবের সহযোগী। ব্যাংকটিতে এখনো ওই সব লুটপাটের ধকল চলছে। এটির ৬৫ শতাংশ ঋণ ইতিমধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে, যার পরিমাণ ৮ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা। বেসিক ব্যাংকের শেষ এমডি ছিলেন আনিসুর রহমান, যিনি যোগ দিয়েছিলেন ২০২১ সালের এপ্রিলে।
চরম নাজুক অবস্থায় আছে জনতা ব্যাংক। সাবেক চেয়ারম্যান আবুল বারকাত এননটেক্স গ্রুপকে অর্থায়ন করে প্রথমে ব্যাংকটিকে বিপদে ফেলেন। তাকে পরের চেয়ারম্যানরাও অনুসরণ করে গেছেন। ২০২০ সালের মার্চে দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলে জনতা ব্যাংকের সবচেয়ে বড় গ্রাহক বেক্সিমকো গ্রুপ ঋণ নিতে বেপরোয়া আচরণ শুরু করে। এর কর্ণধার সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। ফলে জনতা ব্যাংকে গ্রুপটির ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ২৫ হাজার কোটি টাকায়। এর মধ্যে করোনার পর নিয়েছেন ১২ হাজার কোটি টাকা। এই ঋণের বড় অংশ ইতিমধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে। গত জুনে ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণের হার দাঁড়ায় ৫২ দশমিক শতাংশ বা ৪৮ হাজার কোটি টাকায়, যা ইতিমধ্যে ৭০ শতাংশ ছাড়িয়েছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া ব্যাংকটিতে এস আলম গ্রুপের ঋণ প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। এ ব্যাংকে লম্বা সময় ধরে এমডি ছিলেন আবদুছ ছালাম আজাদ। ২০২৩ সালের এপ্রিলে যোগ দেন আবদুল জব্বার। তাকে সরিয়ে দেওয়ায় জনতা ব্যাংক এখন এমডি–শূন্য।
সূত্র জানায়, জনতা ব্যাংকের এমডি হতে অগ্রণী, রূপালী ও জনতা ব্যাংকের সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন ডিএমডি দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। তাদের অনেকেই আগে ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থায়নে ভূমিকা রেখেছেন। তাঁরাই এখন নতুন রাজনৈতিক পরিচয়ে এমডি হওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন বলে শোনা যায়।
অগ্রণী ব্যাংকে দীর্ঘ সময় অর্থনীতিবিদ জায়েদ বখত চেয়ারম্যান ও শামস উল ইসলাম এমডি ছিলেন। তাদের সময়ে দেওয়া ঋণ ইতিমধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে। গত জুনে ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণের হার ৩০ শতাংশ ছাড়ায়, যা পরিমাণে ২১ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। ২০২২ সালের আগস্ট থেকে ব্যাংকটির এমডির দায়িত্বে ছিলেন মো. মুরশেদুল কবীর। সম্প্রতি তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
এদিকে হলমার্ক কেলেঙ্কারি থেকে সোনালী ব্যাংক যে শিক্ষা নিয়েছে, তা ব্যাংকটির আর্থিক ভিত্তি মজবুত করতে ভূমিকা রেখেছে। ফলে ব্যাংকটি বড় ঋণ বিতরণে না ঝুঁকে ট্রেজারি ব্যবসায় মনোযোগ দিয়েছে। ফলে নতুন করে কোনো ঋণ খেলাপি হওয়ার ঝুঁকি কমেছে। ব্যাংকটির মোট ঋণের প্রায় ১৫ শতাংশ এখন খেলাপি, যা আগে হলমার্কসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের নামে গেছে। সম্প্রতি অপসারিত সোনালী ব্যাংকের এমডি আফজাল করিম ২০২২ সালের আগস্টে দায়িত্ব পেয়েছিলেন।
রূপালী ব্যাংকের ২৩ শতাংশ ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে, যার পরিমাণ ১০ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা। এই ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরও ২০২২ সালের আগস্ট থেকে দায়িত্বে ছিলেন। তাকেও সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।