Home বাণিজ্য ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে যেসব কারণে

ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে যেসব কারণে

নিজস্ব প্রতিবেদক
২২ views

ব্যাংকিং খাতের প্রধান সমস্যা খেলাপি ঋণ বেড়ে প্রায় সোয়া চার লাখ কোটি টাকায় উঠেছে। এই অঙ্ক বাজেটের অর্ধেকেরও বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে নামে–বেনামে যে অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছে, তা এখন খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হতে শুরু করেছে। আবার ঋণখেলাপির নিয়ম আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করায় খেলাপি ঋণ বাড়ছে। যেসব ঋণ নবায়ন করা হয়, তার অনেকগুলো আদায় হচ্ছে না। অনিয়মের কারণে অনেক ঋণ খেলাপি করে দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতেই খেলাপি ঋণ বাড়ছে, যা সামনে আরও বাড়তে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংক রোববার রাতে খেলাপি ঋণের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি বছরের মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। তিন মাস আগে গত বছরের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা, যা ছিল মোট ঋণের ২০ দশমিক ২০ শতাংশ।

তার তিন মাস আগে গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের অঙ্ক ছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। জুন শেষে ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। মার্চ শেষে ছিল ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা, যা ওই সময়ের বিতরণ করা ঋণের ১১ দশমিক ১১ শতাংশ।

সে হিসাবে তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় পৌনে এক লাখ কোটি টাকা, ৭৪ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা। ছয় মাসের ব্যবধানে বেড়েছে ১ লাখ ৩৫ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা। আর এক বছরে বেড়েছে ২ লাখ ৩৮ হাজার ৩৯ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ পর্যন্ত বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৪১ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর শেষে যা ছিল ১৭ লাখ ১১ হাজার ৪০২ কোটি টাকা।

হিসাব বলছে, বিতরণ করা ঋণের চার ভাগের এক ভাগই খেলাপি হয়ে পড়েছে। ৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের জাতীয় বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। আর ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের বাজেট ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ শেষে রাষ্ট্র মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে মোট বিতরণ করা ঋণের মধ্যে খেলাপি ঋণের হার বেড়ে হয়েছে ৪৫ দশমিক ৭৯ শতাংশ, যা ডিসেম্বরে ছিল ৪২ দশমিক ৮৩ শতাংশ।

বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে ঋণের ২০ দশমিক ১৬ শতাংশ খেলাপি হয়ে পড়েছে, যা ডিসেম্বরে ছিল ১৫ দশমিক ৬০ শতাংশ।

মার্চ শেষে রাষ্ট্র মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ হচ্ছে তিন লাখ ১৯ হাজার ৭০৮ কোটি টাকা। আর বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণ ১৩ লাখ ১০ হাজার ৩৮৪ কোটি টাকা।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। এরপর থেকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলছে।

অর্থনীতিবিদরা অনেক দিন ধরেই বলে আসছেন, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ লুটপাট হয়েছে, যার একটা বড় অংশই বিদেশে পাচার হয়েছে।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র বের হতে শুরু করেছে। আর তাতে বেড়েই চলেছে খেলাপি ঋণ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “খেলাপি ঋণের কোনও তথ্য আমরা লুকিয়ে রাখব না। সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছানোর পর এটা আদায় জোরদারের মাধ্যমে কমানো হবে। খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করা হয়েছে। যে কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে।”

নতুন বিতরণ করা ঋণ যেন খেলাপি না হয় সে জন্য বিভিন্ন আইনি কঠোরতা আনার কথাও বলেছিলেন তিনি।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে প্রভাবশালীদের বড় অঙ্কের ঋণ দিতে নানা সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ কাগজে-কলমে কম দেখাতে নেওয়া হয়েছিল একের পর এক নীতি। সরকার পরিবর্তনের পর সেই নীতি থেকে সরে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ও সমালোচিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হওয়া ব্যাংকগুলো ঋণের প্রকৃত চিত্র দেখাতে শুরু করেছে। তাদের মধ্যে ইসলামী ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেশি বেড়েছে।

একইভাবে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণও বেশ বেড়েছে।

ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপ, এস আলমসহ আরও কিছু বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ঋণখেলাপি হয়ে পড়েছে। এতেও বেড়েছে খেলাপি ঋণ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, সরকার পতনের আগেই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের শর্ত মানতে গিয়ে গত বছরের মার্চ থেকে কৌশলে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর সুযোগ কমে এসেছে।

আবার তদারকি শিথিলতার কারণে এতদিন জালিয়াতি ও অনিয়মের মাধ্যমে বিতরণ করা ঋণ আর ফেরত আসছে না। সরকার পতনের পর এরই মধ্যে আওয়ামী লীগ ঘরনার ব্যবসায়ীদের অনেকেই পালিয়েছেন। এতে করে খেলাপি ঋণ আগামীতে আরও বাড়তে পারে বলে ব্যাংকারদের আশঙ্কা।

 

আরও যা পড়তে পারেন

কমেন্ট করুণ