Home মতামত ডিম পাড়ে হাঁসে, খায় বাগডাশে

ডিম পাড়ে হাঁসে, খায় বাগডাশে

রহমান মৃধা
১০৫ views

‘ডিম পাড়ে হাঁসে, খায় বাগডাশে’— ডিম নিয়ে বাংলায় প্রচলিত এ ধরনের প্রবাদ-প্রবচনের কমতি নেই। ডিম নিয়ে শুধু যে ফেসবুকপাড়া সরগরম তা নয়, হাঁটতে-চলতে পাড়ার মুদি দোকানে, বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে আলোচনা-বচসায় কান পাতলে ডিমের প্রসঙ্গ শোনা যাবেই। তাতে ক্রেতা সাধারণের দীর্ঘশ্বাসের পাল্লাটাই যে ভারী। পাল্লা দিয়ে বাজারে ডিমের দাম রকেট-গতিতে বেড়ে চলেছে।

কয়েক দিনের ব্যবধানে ডিমের দাম ডজনে বেড়েছে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। মানে প্রতিটি ডিমে বেড়েছে চার থেকে পাঁচ টাকা। মূল্যস্ফীতির সমস্যা এখন সারা বিশ্বে। এরপরও আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে ডিমের ডজন এখন বাংলাদেশি মুদ্রায় ৭৫ টাকা। প্রশ্নটা তাই স্বাভাবিকভাবেই উঠছে, ভারতে এক ডজন ডিম যদি ৭৫ টাকা হয় তাহলে বাংলাদেশে ১ ডজন ডিম ১৯০ টাকা কেন?

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করেছে সিন্ডিকেট চক্র। এখন দেশ চালাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু পেছন থেকে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে ওই একই সিন্ডিকেট চক্র। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রতিবাদ করলে না হয় গুলি খাওয়ার ভয় ছিল। এখন তো সেটা নেই। তাহলে মানুষ কেন এখন প্রতিবাদী হয়ে উঠছে না। কারণ কি?

কথায় আছে— যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ। গত সাড়ে ১৫ বছর ধরেই দেশে নিত্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়-ক্ষমতার মধ্যে নেই। কীভাবে মানুষের দিন যাচ্ছে তা কেবল সাধারণ মানুষই জানেন। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে বলেছিল, প্রতিটি সেক্টরে সংস্কার ও নিত্যপণ্যের দাম মানুষের নাগালে আনাই তাদের প্রধান কাজ হবে। মানুষ আশান্বিতও হয়েছিল। মানুষ আশা করেছিল, অন্তর্বর্তী সরকার অবশ্যই মধ্যম আয়ের মানুষের দিকে তাকাবে। কিন্তু সে আসায় গুঁড়েবালি। অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নিলো। উপদেষ্টা পরিষদ গঠন হলো। কিন্তু নিম্নআয়ের মানুষের জন্য কিছুই করল না। কই গেল তাদের আশার বাণী?

যতই দিন যাচ্ছে সব কিছুর দাম বাড়ছেই। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী নানা অজুহাতে নিত্যপণ্যের দাম বাড়াচ্ছে। কোনো সরকারই অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভাঙতে পারছে না। তাদের খুঁটির জোর কোথায়? আওয়ামী সরকার তো নয়ই, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও বাজার সিন্ডিকেটকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। যে ডিম নিম্নআয়ের মানুষের ক্রয়-ক্ষমতার মধ্যে ছিল, সেই ডিমের দামও এখন আকাশচুম্বী। মুরগির ডিমের ডজন এখন ১৮০ থেকে ১৯০ টাকা। হাঁসের ডিমের ডজন ২০০ টাকার উপরে।

ডিম পাড়ে হাসে

পাল্লা দিয়ে বাজারে ডিমের দাম রকেট-গতিতে বেড়ে চলেছে

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত মানুষের জীবনযাত্রা সহজ করে দেওয়া। মানুষের যাতে ক্রয়ক্ষমতা ও আয়-রোজগার বাড়ে, সেটার ওপর জোর দেওয়া। জীবনযাত্রার ব্যয় কমিয়ে মান বৃদ্ধি করতে পারলে সমাজে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়ত। পেঁয়াজ, রসুন, মটর ছোলা, চাল, গম, আলু, মসুর ডাল, ভোজ্যতেল, চিনি, আদা, হলুদ, শুকনা মরিচ, ডাল, ভুট্টা, ময়দা, আটা, লবণ, গোলমরিচ, এলাচ, দারুচিনি, লবঙ্গ, খেজুর, তেজপাতা ও ফলফলাদিসহ সব ধরনের পণ্য বর্তমানে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে।

দিন যত যাচ্ছে, জীবনযাত্রার ব্যয় তত বাড়ছে। কিন্তু ব্যয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আয় বাড়ছে না। ফলে সংকট দেখা দিচ্ছে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারে। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় চাহিদায় কাটছাঁট করেও সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ।

গত কয়েক বছর বাংলাদেশের সর্বসাধারণের পাতে ডিম সাধারণ একটা পদে পরিণত হয়েছে। আমরা ডাল-ভাতের বদলে ডিম-ভাত খেতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশের মানুষ বছরে গড়ে ১০৪ দশমিক ২৩টি ডিম খায়। স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য একজন মানুষকে বছরে গড়ে ১০৪টি ডিম খাওয়াকে উঁচুমানের হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অবশ্য পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ডিম খাওয়া জাতি হলো মেক্সিকান ও জাপানি। একজন মেক্সিকান বছরে গড়ে ৩৬৮টি ও একজন জাপানি গড়ে ৩৩৭টি ডিম খায়। উন্নয়নশীল দেশগুলোয় বছরে গড়ে ডিম খাওয়ার সংখ্যা ২০০। সে তুলনায় আমাদের ডিম খাওয়ার গড় অবশ্য কম।

তবে ডিম খাওয়ার সংখ্যা বাড়ায় জাতিগত স্বাস্থ্য-সুবিধা আমরা পেতে শুরু করেছি। বাংলাদেশে খর্বাকার শিশু জন্মের হার প্রায় ১০ শতাংশ (৪১ শতাংশ থেকে এখন ৩১ শতাংশ) কমে গেছে। এ ক্ষেত্রে ডিমের একটা বড় অবদান তো রয়েছেই। অন্তঃসত্ত্বা মা ও শিশুর প্রয়োজনীয় পুষ্টির চাহিদার অনেকটা পূরণ হচ্ছে ডিমে। মাথাপিছু প্রোটিন গ্রহণের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের পেছনের সারির একটি দেশ। বিশ্বে প্রোটিন গ্রহণের বার্ষিক গড় যেখানে ৪৮ দশমিক ২ কেজি, সেখানে ২০১৬ সালের তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেটা মাত্র ৪ কেজি।

বৈশ্বিক গড় খাদ্যের গুণগত মান ও খাদ্য নিরাপত্তার বিচারে বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তার যে সূচক, তাতে ১১৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৭ তম। বাংলাদেশে বিদ্যমান তীব্র আয় বৈষম্য পরিস্থিতি আরও খারাপ করে তুলেছে। মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য সুষম খাদ্য প্রয়োজন। আর সুষম খাদ্যের জন্য প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য প্রতি কেজি ওজনের বিপরীতে ১ গ্রাম প্রোটিন প্রয়োজন। শিশুদের জন্য প্রয়োজন প্রতি কেজি ওজনের বিপরীতে ২ গ্রাম। প্রোটিনের এত ঘাটতির পরও এ দেশের মানুষের প্রতিদিনকার প্রোটিনের যোগানের একটা অংশ ডিম থেকে পূরণ হয়।

বাংলাদেশে যাদের বয়স পঞ্চাশের কোঠায় এবং যাদের শেকড় গ্রাম-মফস্বল শহরে, তারা কয়েক দশক পেছনে ফিরে যেতে পারেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রতিদিনের পাতে ডিম খাওয়ার ব্যাপারটা কল্পনার বাইরের একটা বিষয় ছিল। আবার আস্ত ডিম খাওয়ার ব্যাপারটাও বেশ বড় একটা প্রাপ্তির মতো ছিল। অনেক বাড়িতে ডিম রান্নার পর খুন্তি কিংবা সুতা দিয়ে কেটে দুভাগ করে দুজনের পাতে তুলে দেওয়া হতো। সেই অতীত আমরা পেছনে ফেলে এসেছি।

আমাদের এখন বেশ বড়সড় পোলট্রি শিল্প। দেড় লাখের বেশি খামার রয়েছে। মুরগি ও ডিম উৎপাদন করে কয়েক লাখ মানুষের জীবিকা হচ্ছে। বছরে ডিমের বাজারও প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকার। উদ্যোক্তাদের বেশিরভাগই তরুণ ও ছোট উদ্যোক্তা। প্রতিদিন গড়ে সাড়ে তিন থেকে চার কোটি ডিম উৎপাদিত হয়। অথচ সেই ডিমের বাজারে আগুন। বর্তমানে তথ্য-প্রযুক্তির যুগে এসেও একটা ডিম কেটে দুই ভাগ করে খাওয়ার অবস্থা। তাই ডিমের দাম ঊর্ধ্বগতির কারণে ঢালিউডের একজন নায়ক জনগণকে এক সপ্তাহ ডিম না খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন।

আসলে ডিমের দাম বাড়বে না কেন? পোলট্রি ফিডের বাজারেও সিন্ডিকেট। মুরগি ও ডিমের এত বড় বাজার গড়ে উঠেছে, কিন্তু সহায়ক শিল্প গড়ে তোলার খুব একটা উদ্যোগ নেই। বর্তমানে ডিমের দাম এতটা বেড়ে যাওয়ার কারণ হলো সম্প্রতি পোলট্রি ফিডের দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। সে কারণে ছোট খামারিদের অনেকে মুরগি পালন বন্ধ রেখেছেন। চাহিদা আর যোগানের বড় একটা ঘাটতি তৈরি হয়েছে। পোলট্রি ফিডের দুটি বড় উপাদান ভুট্টা আর সয়াবিন। ভুট্টার কিছুটা দেশে উৎপাদন হলেও সয়াবিন আমদানিনির্ভর। ভুট্টার সবচেয়ে বড় উৎপাদক রাশিয়া ও ইউক্রেন। ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি ও লোডশেডিংয়ের কারণেও উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। পরিবহনের ভাড়াও বেড়েছে।

প্রশ্ন হলো— এত সব কারণ থাকা সত্ত্বেও ডিমের দাম এতটা বেড়ে যাওয়ার কোনো যৌক্তিকতা আছে কি? তাই অবধারিতভাবেই সিন্ডিকেটের কারসাজির প্রসঙ্গ আসছে। মাছ-মাংসের যে দাম, তাতে এতদিন ডিম ছিল মানুষের সাধ্যের মধ্যে। সেই ডিমও এখন দামি। খাদ্য নিয়ে সাধারণ মানুষের দুশ্চিন্তার অন্ত নেই।

সপ্তদশ শতকের বাঙালি কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যের বিখ্যাত উক্তি— ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’। খেয়া পারাপারের মাঝি ঈশ্বরী পাটনি অন্নদার কাছে তার সন্তানের মঙ্গল কামনায় এই প্রার্থনাই করেছিলেন। বাঙালি মায়েদের চিরকালীন প্রত্যাশা, তার সন্তান যেন অন্তত দুধ-ভাত খেয়ে বেড়ে উঠতে পারে। একবিংশ শতকে এসে সেই দুধে-ভাত অনেকাংশেই ডিমে-ভাতে রূপান্তরিত হয়েছে। এই উচ্চমূল্যের বাজারে আমাদের সন্তানেরা কি ডিমে-ভাতে টিকে থাকতে পারবে— বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দেশবাসীর এই প্রশ্ন।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

আরও যা পড়তে পারেন

কমেন্ট করুণ