Home সাহিত্য চলতে ফিরতে দরদীর দেখা

চলতে ফিরতে দরদীর দেখা

সুপ্রভা জুঁই
১৪০ views

”রুঁরুঁ র গল্প” পড়েছেন হুমায়ুন আহমেদের? ভুতের গল্প। ঐ যে এক অদ্ভুত কিসিমের লোক, রাতের স্টেশানে, এক ভদ্রলোককে, এক লাপাত্তা বাচ্চা ভুতের কথা বলছিলেন। মানে ভুতের বাচ্চাটা পথ হারিয়ে তার কাছে চলে এসেছিলো, এরপরে কি কি হলো সেইসব। ভদ্রলোক অদ্ভুত কিসিমের সেই  লোকটির কথা প্রায় বিশ্বাস করে ফেলছিলেন তক্ষুণি বেশ কিছু লোকজন হৈ চৈ করে এসে তাকে পাগল বলে ট্রেন থেকে ধরে নিয়ে চলে যায়। 

আমার সাথেও প্রায় কাছাকাছি এরকম একটা ঘটনা ঘটেছে। মাত্র কয়েকদিন আগের ঘটনা, এক সপ্তাহও হবে না। বাসে করে যাচ্ছি, উদ্দেশ্য এলিফেন্ট রোড। আমার ল্যাপটপটা সারাবো। লাঞ্চের সময়ে মিরপুর থেকে বের হই তাতে করে রাস্তা একটু ফাঁকা পাওয়া যায়। যদিও রোদটা মাথার ঠিক ওপরে থাকে। একটা সিট যোগাড় করে জানালা সামান্য খুলে বসে যাই। খানিক বাদে একজন বয়স্ক পুরুষ মানুষ উঠলেন। বিশাল লম্বা ও রোগা। পরণে লম্বা পাঞ্জাবি, লুঙ্গি আর মাথার টুপি। ঠোঁটের একদিক ঝুলে গেছে, হয়তো প্যারালাইসড। এই দৈহিক অবস্থায় এই ভরদুপুরে কড়ারোদে আশি ছুঁই ছুঁই কাউকে এভাবে বাসে দেখব ভাবিনি। তিনি কি করেন ভাবছিলাম। পরে অবশ্য জিজ্ঞেস করে জেনেছি ঝিগাতলার এক মাদ্রাসায় ত্রিশ বছর যাবৎ শিক্ষকতা করেছেন। খুব সম্ভবত পুত্র সন্তান নেই, দুটি কন্যা সন্তান রয়েছে যাদের মাঝে একজন মাদ্রাসার শিক্ষক। আমার পাশের সিটটি ফাঁকা থাকায় নির্দ্বিধায় সেখানে বসলেন এবং একেবারে শরীরের ছোঁয়া বাঁচিয়ে বিনয়ের সাথে বসলেন যেটা খুব কম মানুষ পারে। এভাবে প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট পার হলো। বাস তখন শিশুমেলা এসেছে। বয়স্ক মানুষটি একটু চিন্তিত হয়ে সাধ্য মতো চিল্লালেন, ‘‘এই সায়েন্স ল্যাব এলে আমাকে নামি দিও।’’ হেল্পার হেল্পসুলভ কণ্ঠে জানালেন, ‘‘ভাইবেন না মুরুব্বি নামায়ে দেবো।’’ আমি তাকে শান্ত করতে বলি, ‘‘আমি নিজেও ওখানেই নামবো, আমরা একসাথেই নামবো। আপনি চিন্তা করবেন না।’’ 

এই হলো শুরু। এই যে উনার প্রতি সামান্য আগ্রহ দেখালাম এখান থেকে উনি আমাকে কাছের একজন ধরে নিলেন আর শুরু করলেন গল্প! যেহেতু উনার আধা শরীর প্যারালাইসড ফলে তোতলানো স্বরে কথা শুরু করলেন,
– আপনি কি স্টুডেন্ট?
– জ্বি
– এদিকে কোথায় যাচ্ছেন? কলেজে?
– এই কম্পিউটার সারাবো।<br< – ও।

কয়েক সেকেন্ড নীরবতা, আমি বাইরে তাকিয়ে আছি। আমার আগ্রহ আছে কি নেই তাতে পাত্তা না দিয়ে উনি গল্প শুরু করলেন। 

কয়দিন আগে কুয়াকাটা গেছিলাম বুঝছেন, সাগরে সূর্যাস্ত দেখতে। এত সুন্দর! একাই বের হয়ে গেছিলাম বাসা থেকে। কারণ কি, ওদের বললে ওরা তো আমাকে যেতে দিবে না। বাসা থেকে সকালে বের হয়েছি, সদর ঘাটে। যেয়ে বললাম, আমি কুয়াকাটা যাবো। তো ওরা বলল, কুয়াকাটায় নাকি একবারে লঞ্চ যায় না। আমাকে আগে বরিশালে নেমে সেখান থেকে আবার যেতে হবে। তো রাতে লঞ্চে উঠলাম, ওখান থেকে বরিশাল যাব। সেখান থেকে কুয়াকাটা। তারপরে দেখলাম, সমুদ্রে সূর্যাস্ত। এত সুন্দর! এই দেখতে দেখতে রাত হয়ে গেলো বুঝছেন। আমার কাছে যা টাকা ছিলো সব তো শেষ। তো একজন বলল, ‘‘মুরুব্বি এইখানে রাত ১২টার পরে থাকতে দেবেনা। আপনি মসজিদে যান’’। আমি মসজিদে গেলাম। সেইখানে আবদুল্লাহ বলে একজন ছিলো। মসজিদে আজকাল কাউকে থাকতে দেয় না বুঝছেন। কিন্তু আবদুল্লাহ বলল, ‘‘আপনি দেখতে অবিকল আমার বাপের মতন। আপনি রাতটা এখানেই থাকেন। আপনার কাছে কি বাড়ির কারো ফোন নম্বর আছে?’’ আমি বললাম, ‘‘হ্যাঁ আছে।’’ আব্দুল্লাহকে আমার মেয়ের ফোন নম্বর দেয়। আমি তো আর বুঝিনি ও কি করছে। আমি ঘুমাইছি। সকালে উঠে খাইছি মসজিদেরই পাশে এক হোটেলে। রুটি আর আলুভাজি। আবদুল্লাহই টাকা দিছে। হঠাৎ দেখি কি আমার বড় জামাই আর আমার ছোট ভাই হাজির, কি লজ্জা বলেন তো! তখন বুঝলাম আবদুল্লাহ আমার বাড়িতে ফোন দিছিলো। আবদুল্লাহ ফোন দিয়ে বলছিলো, আপনাদের কি কোনো বুড়া হারাই গেছে?

– জ্বি, আমার আব্বা হারাইছে।
– উনি এখন বরিশালে। আপনারা আসেন।
– বুড়াকে ছাইড়েন না, আমরা নিতে আসতেছি।

আমার wife এর সাথেও আবদুল্লাহ কথা বলছে বুঝলেন। আমি ওদের বলে আসিনি কারণ কি, ওদের বললে তো আমাকে আসতে দিবে না। কিন্তু আমার তো একটু ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগে। বাসায় সারাদিন বসে থাকতে কি ভালো লাগে বলেন? শেষ পর্যন্ত দেখা হলো কুয়াকাটায় সূর্যাস্ত। এখন বলেন, কেমন লাগলো আমার ভ্রমণ কাহিনী?

উনি আসলেও এক নাগাড়ে এত কথা বলেছেন। আমি মুচকি মুচকি হাসছি। লক্ষ্য করলাম বাসের আশে পাশের সিটেরও কয়েকজন হাসছেন। আমি বললাম, ‘‘জ্বি, খুবই ভালো লাগলো। আপনি এখন কোথায় গেছিলেন?’’ উনি বললেন, ‘‘মতিঝিলে। ওখানে আমার ভাস্তের বাসা।’’

খটকা লাগলো, কারণ এই বাসটা মিরপুর থেকেই ছাড়ে। উনি আবার বলা শুরু করলেন, ‘‘এই যে দেখেন রাস্তায় হারিয়ে যাব বলে আমার ঠিকানা লিখে দিছে।’’ বলে একটা কাগজের টুকরা দেখালেন, সেখানে একটা ঠিকানা লিখা। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘আপনি আজকে বলে বের হয়েছেন তো?’’ হাসিমুখে তিনি বললেন, ‘‘না। আমি বলি না। কারণ কি, বললে তো ওরা আমাকে বের হতে দেবে না। আমার একটু মাথার সমস্যা আছে। ল্যাবেএইডে ডাক্তার দেখাই। ফিস নেয় ৫০০ টাকা। মাঝে মাঝে মাথার মাঝে কেমন করে তখন এরকম বের হয়ে যাই বুঝছেন?’’

আমি এবারে মানুষটিকে ভালো করে দেখি। সে কি আসলেই ঘুরে এসেছে কুয়াকাটা? কি যেন একটা ধাক্কা দিলো আমাকে! আমি সেই সত্য পরখ করার কে! প্রতিনয়ত এই ব্যস্ত শহরের কোননা কোনো দুঃসংবাদ শুনতে শুনতে পাথর হয়ে গিয়েছি আমি। কুয়াকাটার সাগরে সূর্যাস্ত দেখিনি দেখার কোন ইচ্ছেও নেই। ইচ্ছেটা তৈরি করতে পারিনি। এই মানুষটি আমাকে বাঁচিয়ে দিলেন সেই মুহূর্তে, ম্যাজিশিয়ানের মতন ঘোর ভাঙ্গালেন।

ততক্ষণে সায়েন্স ল্যাব চলে আসলো বাস। তিনি ঝিগাতলা যাবেন। আমরা নামলাম। বিদায় নেইনি। তফাতে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে দেখছি তিনি কি করেন। রাস্তার ব্যস্ততা তাকে ভাবাচ্ছে কিন্তু তিনি অসহায় নন। রাস্তার ওপারে যেতে তিনি পারবেনই এনিয়ে তার কোনো দ্বিধা নেই। কিছুক্ষণ পর আমি-ই এগিয়ে গিয়ে তাকে রাস্তা পার করে দেই। আমি না দিলে অন্য কেউ করে দিত। কারণ পুরোটা সময়ে এবং গল্পেও তার বয়স এবং সারল্যের কারণে তিনি এদেশের মানুষের স্নেহ পেয়েছেন। 

উনাকে ধরে রাস্তা পার করাচ্ছিলাম। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘আপনি কোন দিকে যাবেন?’’ বললাম, ‘‘উল্টা দিকে।’’ শুনে উনি বেশ লজ্জায় পড়ে গেলেন। বললেন, ‘‘শোনেন আমার জন্য কষ্ট করতে হবে না।’’ উনাকে আস্বস্ত করে বললাম, ‘‘কিচ্ছু কষ্ট হচ্ছে না।’’

তাকে রিক্সায় উঠিয়ে দিলাম। রিক্সাওয়ালা আমার দিকে চেয়ে আছেন, ভাবছেন বুঝি ভাড়াও দিয়ে দিব। আমি তো তার অভিভাবক নই। তার কোনো অভিভাবকের দরকারই নেই। বার্ধক্য ছোঁয়া নুরুল আমিন আর যাই হোক অসহায় নন। হু, তার নাম নুরুল আমিন, মাদ্রাসার শিক্ষক। ত্রিশ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা তার। থাকেন ঝিগাতলা। তিনি সূর্যাস্ত দেখার স্বপ্ন রাখেন। স্বপ্ন দেখাতেই শেষ নয়, তা তিনি পূরণও করেন। ‘রিজনেবল’ বা ‘এফোর্ডেবল’ স্বপ্ন বলে তার কিছু জানা নেই। নুরুল আমিনের মাথায় সমস্যা। ল্যাবেইডে ডাক্তার দেখান, ফিস ৫০০ টাকা। তার মাথায় কেমন কেমন করলে তিনি বাসা থেকে চুপ করে বের হয়ে যান কারণ কি, বাসায় বললে তো তাকে ওরা কোথাও যেতে দেবে না…

আরও যা পড়তে পারেন

কমেন্ট করুণ