Home সাহিত্য শিলাইদহে জমিদারি নয়, ‘আসমানদারি’ এবং রবীন্দ্রনাথ

শিলাইদহে জমিদারি নয়, ‘আসমানদারি’ এবং রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথের ১৬৪তম আবির্ভাব তিথিতে কিছু কথা

সুপ্রভা জুঁই
২৪২ views

এই মুহূর্তে আমি ছেঁউড়িয়া থেকে লিখছি। কুষ্টিয়া ও কুমারখালীর সংযোগস্থল ছেঁউড়িয়া। ফকির লালন শাহ্‌ এঁর মাজার এই ছেঁউড়িয়াতেই। এখানে বসে বসেই মনে হচ্ছিল এইসব জায়গা এককালে রবীন্দ্রনাথের জমিদারির অন্তর্ভুক্ত ছিল। জমিদার প্রসঙ্গটার সাথে বাংলার মানুষের যে স্মৃতি জড়িত তা সুখকর নয়। জন্মসূত্রে প্রাপ্ত জমিদারির মাঝে থেকে বাংলার পল্লীসমাজ ও কৃষকের জন্য রবীন্দ্রনাথের ভাবনা নিয়ে নানান যুক্তিতর্ক রয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে রবীন্দ্রনাথের মরমি কবিতা, গান ও লেখনির একনিষ্ঠ পাঠক।

সিস্টেমে থেকে সিস্টেম বদলানোর বিষয়টি একটি বাস্তবতা। রবীন্দ্রনাথের মূল কাজ তাঁর ভাব ও ভাবের প্রকাশে। আমাদের অন্তর শীতল করে তাঁর পরম প্রার্থনার রচনাগুলি। এই বিপ্লবের সাথে কোনোকিছুরই তুলনা চলে না। তথাপি জাগতিক ক্ষেত্রেও তিনি তাঁর সেরাটা দিয়ে মানুষের অবস্থার উন্নয়নের চেষ্টা করেছেন। এই লেখায় আমি সেরকমই কয়েকটি দিক নিয়ে লিখব; যা বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার শিলাইদহের সাথে সম্পর্কিত। 

c 1

কুঠবাড়ির আগের ও পরের চেহারা

রবীন্দ্রনাথ ও জমিদারি বৈরাগ্য
তেল জলে একসাথে মেশে না। পদ্মফুল পানির উপরে এমনভাবে ভাসমান, যেন পানি তাকে দখল করতে পারেনি। একইভাবে রাজহাঁসও পানির মায়ার ঊর্ধ্বে যেয়ে চারণ করে। ঠিক সেই কারণে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস এর নামে ‘হংস’ কথাটি যুক্ত হয়েছে। পমহংসের প্রিয়পাত্র বিবেকানন্দ প্রায়ই তাঁকে রবীন্দ্রনাথের একটি গান শুনিয়ে ভক্তি জানাতেন। সেই গানটি হলো- 

তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা,

এ সমুদ্রে আর কভু হব নাকো পথহারা।

রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বলা মুশকিল যে তিনি বড় কবি, নাকি বড় মরমি। খলিল জিবরান, ফ্রেডরিখ নিৎসে এই কাতারে রবীন্দ্রনাথই আছেন। তিনি কেবল নিজের সম্পর্কে নয়, সমস্ত মানবকূলের চেতনা সম্পর্কে বলছেন। ঐ রাজহাঁস যা স্বসরতীর বাহন, ঐ পদ্মফুল, ঐ জল যেখানে তেল হয়ে ভেসে গোটা মানবমনের কথা প্রতিফলিত হলো যাঁর বাণীতে, তিনি সংসারে থেকেও তাই সবচেয়ে উঁচুমানের বৈরাগী। 

শিলাইদহ রবীন্দ্রনাথকে বিশেষভাবে ঋদ্ধ করেছিল বলে আমি মনে করি। এখানে নদীর ধারের জীবনযাপনের স্পষ্ট ছাপ তাঁর লেখার মাঝে দেখা যায়। শিলাইদহকে বলা হয় তাঁর আদি সাহিত্য তীর্থস্থান। এই অঞ্চলে তিনি এয়েছিলেন বাংলার চাষী, গৃহস্থ, শ্রমিক, বৈষ্ণব, বাউল, ফকিরদের মাঝে। বাংলামায়ের কোলের সন্তানদের নিবিড় সাহচর্য, প্রাচীন বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতি ও জীবনধারার আসল পরিচয় তিনি এখানেই পেয়েছেন। এখানেই তিনি দেখেছেন দীনদুঃখী অশিক্ষিত সরল সহজ অবহেলিত শোষিত নিরুদ্যম মাটির মানুষদের। তাঁর কথাসাহিত্যে ও কাব্যে এই চরিত্রগুলোই ফুটে উঠেছে। 

d

শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে মধ্যাহ্নভোজে জমিদার রবীন্দ্রনাথ

তিনি (সবুজপত্র, ১৩৩৩সাল) এর ভূমিকায় লিখছেন, ‘‘আমার জন্মগত পেশা জমিদারি। কিন্তু আমার স্বভাবগত পেশা আসমানদারি। এই কারণেই জমিদারির জমি আঁকড়ে থাকতে আমার অন্তরের প্রবৃত্তি নেই। এই জিনিষটার পরে আমার শ্রদ্ধার একান্ত অভাব। আমি জানি, জমিদার জমির জোঁক, সে প্যারাসাইট, পরশ্রিব জীব। আমরা পরিশ্রম না করে, কোনো উপার্জন না করে, কোনো যথার্থ দায়িত্ব গ্রহণ না করে ঐশ্বর্য ভোগের দ্বারা দেহকে অপটূ ও চিত্তকে অলস করে তুলি। যারা বীর্যের দ্বারা বিলাসের অধিকার লাভ করে আমরা সে জাতের মানুষ নই। প্রজারা অন্ন জোগায়, আর আমলারা আমাদের মুখে অন্ন তুলে দেয়- এর মধ্যে পৌরষও নেই, গৌরবও নেই।’’ 

ভাববাদ ও বস্তুবাদ, দুই জগতে সমানতালে কাজ করে যাওয়া মানুষটি হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এখানে দিনের বেলায় জমিদারির নানান হিসাব ও রিপোর্টের কাজগুলো দেখেশুনে এরপর লম্বা সময় চলত তাঁর জলনিবাস। দিনের ঘুম বলে তাঁর কিছু ছিল না। পদ্মা, চিত্রা, আত্রাই নানান ঘাটে ঘুরে বেড়িয়েছেন বোটে করে। ঘাটে ঘাটে বোট থামালে পল্লী রমণীরা শিশু কোলে আলাপবিলাপ করতেন রবীন্দ্রনাথের সাথে। কবি পরমানন্দে সেসব শুনতেন। এরমাঝে সাহিত্য সৃষ্টির কড়া তাগিদ এলে পদ্মার জনহীন কোনো কোলে বোট বাঁধা থাকত। প্রায় জ্যোৎস্না রাতে চরে ভ্রমণ করতে যেতেন তিনি। দীর্ঘকাল নৌকাবাসে প্রকৃতির নানারূপ যেমন দেখেছেন তেমনি মানুষেরও নানান রূপের সমঝদার হয়েছিলেন। শিলাইদহে ১৫ থেকে ৭৬ বছর বয়স পর্যন্ত মোট ৩০ বার তিনি হাজিরা দিয়েছেন। এই সময়কালে তিনি তাঁর জীবনের উল্লেখযোগ্য রচনাগুলো লিখেছেন।

সেগুলো হলো: গল্পগুচ্ছ (গল্প); চিরকুমার সভা, গোড়ায় গলদ, চিত্রাঙ্গদা, রাজা, অচলায়তন (নাটক); ছিন্নপত্র, ছিন্নপত্রাবলী, চিঠিপত্রি (পত্রাবলী); চোখের বালি, গোরা, ঘরে-বাইরে, চতুরঙ্গ (উপন্যাস); গীতাঞ্জলী, গীতিমাল্য, গীতবিতান (গান); মানসী, সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালি, কথা ও কাহিনী, ক্ষণিকা, নৈবেদ্য, খেয়া, বলাকা, কাহিনী (কাব্য); পঞ্চভূত, বিচিত্র প্রবন্ধ (প্রবন্ধ)।  

b

শিলাইদহে মহর্ষি দাতব্য চিকিৎসালয়

উপন্যাস ও গল্পগুচ্ছে প্রকাশ পায় রবীন্দ্রনাথের স্বদেশচিন্তা এবং গ্রামবাংলার মানুষের জীবনের প্রতিচ্ছবি। আর তাঁর গান ও কাব্যে দেখা যায় মরমি কবির চূড়ান্ত ভাব। তাঁর পত্রাবলীতে ফুটে উঠেছে প্রকৃতির এই অসম্ভব সৌন্দর্যকে কতটা হৃদয়ঙ্গম করার যোগ্যতা একটা মানুষের হতে পারে। শুধু তাইই নয়, সেই উপলব্ধির বর্ণনা কতটা চমৎকার হলে অবলীলায় খোদ প্রকৃতিকে ছাড়িয়েও যেতে পারে সেটা নিয়েও আমাদের আবেগ টালমাটাল হয়! 

e

শিলাইদহে কৃষদের সাথে জমিদার রবীন্দ্রনাথ

শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের আসমানদারি
মাত্র ২১ বছর বয়সে শিলাইদহে জমিদারি দায়িত্ব নিয়ে আসেন রবীন্দ্রনাথ। জমিদারদের যে বাস্তব রূপ, যা মূলত শোষণের এই প্রসঙ্গগুলো তাঁর মর্মমূলে আঘাত করে। জমিদারি প্রথা পছন্দ না করলেও তা উচ্ছেদ করতে অনাগ্রহী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি মনে করতেন, এতে করে নানান মধ্যপন্থীদের আগমন ঘটবে যা কৃষকদের জন্য আরও ভয়ানক হবে। বলা যেতে পারে, তিনি জমিদারির যে শক্তি ও প্রভাব সেটাকে কাজে লাগিয়ে গ্রামের মানুষের দুঃখ লাঘব করতে চেয়েছিলেন। এজন্য তিনি জমিদারদেরকে তাদের শোষকের ভূমিকা ছাড়তে আহ্বান করেছিলেন।

স্বদেশী সমাজ নির্মাণে কতগুলো কাজের পরিধি রবীন্দ্রনাথ ঠিক করেছিলেন। যেমন: পানীয়জলের সরবরাহ বৃদ্ধি, নদী ও খাল পুনঃখনন, পথঘাট নির্মাণ ও সংস্কার, কৃষি ও পশুপালন শিক্ষা, কৃষির জন্য আদর্শ খামার স্থাপন, দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধের জন্য ধর্মগোলা স্থাপন, আর্থিক-সামাজিক-জনসংখ্যা সম্পর্কিত পরিসংখ্যান সংকলন, শ্মশানের উন্নতি, বিরোধ মীমাংসা, শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনা, পাঠাগার, ক্রীড়স্থল ও ব্যায়ামাগার পরিচালনা, ব্যাংক স্থাপন ইত্যাদি। এমন কর্মকাণ্ডকে লোক দেখানো মনে হতে পারে। 

উনি বলছেন, ‘‘আমি ধনীর সন্তান, দরিদ্রের অভাব জানি না, বুঝিনে, পল্লী উন্নয়নের কোনো সন্ধানই জানিনে, এমন কথা আমি মেনে নিতে রাজী নই’’। (সম্ভাষণ, রবীন্দ্র রচনাবলী, চতুর্দশ খণ্ড, পৃ ৪০৪)

তিনি লিটিল রিপাব্লিকের ধারণা নিয়ে কাজ করছিলেন।

g

যে স্কুলের কাজ শুরু হয়েছিলো জমিদার রবীন্দ্রনাথের পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী’র হাত ধরে

শিলাইদহের কিছু উন্নয়নমূলক কাজ
১৩১১ সালে তখনকার মিনার্ভা রঙ্গমঞ্চে রবীন্দ্রনাথ বক্তৃতা দিলেন ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রসঙ্গে। সমাজকে পুনর্গঠন করতে পরামর্শ দিলেন পরানুবাদ, পরানুকরণ ছাড়তে হবে। দেশের নাড়ির সঙ্গে সবাইকে মিলতে হবে।

রবীন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন প্ল্যান করে গ্রাম উন্নয়নের কাজে নামবেন। এজন্য তথ্য সংগ্রহ করছিলেন। কিন্তু সমস্যার তীব্রতা দেখে তিনি আগেই কাজে নেমে পড়েন। তিনি শিলাইদহ থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত একটা রাস্তা নির্মাণ করেন যা ‘রবীন্দ্র সড়ক’ নামে পরিচিত। কুঠিবাড়ির কাছে ‘মহর্ষি দাতব্য চিকিৎসালয়’ উন্মুক্ত করেন গ্রামের মানুষদের জন্য। এলাকায় কিছু জলাশয় খনন করেন যাতে সকলের পানির যোগান হয়। এখানে তিনি একটি বালিকা বিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করেন। যার দায়িত্ব নিয়েছিল তাঁর পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী। ঐ অঞ্চলে সেটিই ছিল প্রথম বালিকা বিদ্যালয়। এখানে বর্ষাকালে ছাত্রীদের আনা-নেওয়ার জন্য নৌকার ব্যবস্থাও ছিল। 

পুত্র এবং জামাইকে বিদেশ থেকে কৃষিশিক্ষায় দক্ষ করিয়ে আনান। এরপর শিলাইদহে কুঠিবাড়ি সংলগ্ন প্রায় আশি বিঘা জমিতে আধুনিক কৃষি চর্চা করেন। জৈব সার, আধুনিক খামার পদ্ধতি, আধুনিক কৃষি সরঞ্জাম এমন নানান বিষয় নিয়ে এখানে কাজ করা হয়েছিল। এই কৃষি গবেষণাগারে কৃষকদের উৎসাহ দেওয়া হতো, তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগে এখানে ১৮৯৪ সালে কৃষি ব্যাংক স্থাপিত হয়েছিল; যা কৃষকদের জন্য বেশ সুবিধাজনক একটা ঘটনা ছিল। এখানে প্রথমবারের মতো রেশম চাষ করে গ্রামীণ মানুষদের আয় বৃদ্ধির প্রয়াসেও তিনি কাজ করেছেন। 

h

কবিকে প্রদত্ত উপহার: শিলাইদহের মহিলাদের তৈরি নকশি কাঁথা

জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং উত্তরাধিকার আইন ইত্যাদির কারণে কৃষকেরা খণ্ড খণ্ড হয়ে যাচ্ছিলেন। তাই স্বশাসিত গ্রামের ধারণায় সমবায় নিয়ে তিনি কাজ করা শুরু করেন। কুষ্টিয়ার পাশাপাশি লাহিনী গ্রামে বিভিন্ন পেশাজীবীকে নিয়ে একটি গুচ্ছগ্রাম গঠন করেন; যা বহুমুখী সমবায়ের সব থেকে উন্নত রূপ। জমিদারি প্রথা সংস্কার করে মণ্ডলী প্রথা প্রবর্তনে আগ্রহী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

শচীন্দ্রনাথ অধিকারী লিখছেন, ‘‘প্রতি মণ্ডলীতে মণ্ডলীর নায়েব পদে দু’জন হিন্দু এবং দু’জন মুসলমান সদস্য বা কর্মী নিযুক্ত হতেন। সপ্তাহে এক কি দু’বার মিলিত হয়ে তারা কাজের ব্যবস্থা করতেন। এর ফলে সদর শিলাইদহ কাছারির গুরুত্ব কমে গেল। বিভাগীয় কাছারিগুলোতে অনেক সেরস্তা গড়ে উঠল, তার ফলে মুসলমান কর্মচারীর সংখ্যা বাড়ল’’।

সালিশি বিচারের প্রবর্তন ঘটানোর ফলে অনেক মামলা-মকদ্দমার সহজ নিষ্পত্তি ঘটতে থাকে। নতুন সড়ক, অবকাঠামো সব মিলিয়ে শিলাইদহের চেহারাটাই বদলে যেতে লাগল।

একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর মণ্ডলী সম্পর্কে লিখছেন, ‘‘এখন আমার কাজ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেছে। আমাদের জমিদারির মধ্যে একটা কাজ পত্তন করে এসেছি। বিরাহিমপুর পরগণাকে ৫টা মণ্ডলে ভাগ করে প্রত্যেক মণ্ডলে একজন অধ্যক্ষ বসিয়ে এসেছি; এই অধ্যক্ষরা সেখানে পল্লী সমাজ স্থাপনে নিযুক্ত। যাতে গ্রামের লোক নিজেদের হিত সাধনে সচেষ্ট হয়ে ওঠে… পথ-ঘাট পরিস্কার করে, জলকষ্ট দূর করে, শালিসের বিচারে বিবাদ নিষ্পত্তি করে, বিদ্যালয় স্থাপন করে, জঙ্গল পরিষ্কার করে, দুর্ভিক্ষের জন্য ধর্মগোলা গড়ে তোলে ইত্যাদি সর্বপ্রকারে গ্রাম্যসমাজের হিতে নিজের চেষ্টা নিয়োগ করতে উৎসাহিত হয়, তারই ব্যবস্থা করা গিয়েছে। আমার প্রজাদের মধ্যে যারা মুসলমান তাদের মধ্যে বেশ কাজ অগ্রসর হচ্ছে, কিন্তু হিন্দু পল্লীতে বাধার অন্ত নেই’’। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পল্লী প্রকৃতি, পৃ ২২৬) 

i

পদ্মাবোটে চিত্রংকনরত নন্দলাল বসু ও মুকুল দে

রবীন্দ্রনাথ জানতেন কৃষি ব্যাংক করলেও ঋণ থেকে কৃষককে মুক্ত করতেই হবে। তাই শুধু চাষের উপর নির্ভরশীল না হওয়ার জন্য তিনি কুটিরশিল্পে এলাকাবাসীকে আগ্রহী করে তোলেন। একইসাথে কৃষিকে বহুমুখী করার পদক্ষেপও নেন। আলু, ভুট্টা, কপি, পাটনাই মটর, আখ ইত্যাদির চাষ শুরু করেন এবং কৃষকেরা কিছু ক্ষেত্রে এতে ভালো ফল পায়।     

উন্নয়ন এবং আনন্দ পাশাপাশি চললে কেবল তখনই তা টেকসই হতে পারে। তাই বাংলার লোকসংস্কৃতিকে উদ্ধারে ব্রতী হন তিনি। শিলাইদহে এক প্রকাণ্ড মেলা করার জন্য তিনি মেতে উঠেছিলেন।

তিনি বলতেন, ‘‘গাঁগুলো মরে গেছে, জাগাতে হলে বেশ বড় একটা মেলা করা দরকার’’। (শিলাইদহ ও রবীন্দ্রনাথ, শ্রীশচীন্দ্রনাথ অধিকারী)

যাত্রা, থিয়েটার, পাঁচালি, কবি তরজা, কীর্তন, বাউল সবাইকে নিয়ে সাতদিন ধরে নানান আয়োজন করা হলো। কামার, কুমোর, ছুতোর মিস্ত্রি, জোলা সবাইকে ডাকা হলো তাদের শিল্পসম্ভারে মেলা সাজাতে। লেঠেল ও কুস্তিগিরেরাও এলো। রবীন্দ্রনাথ নেপথ্যে থাকতেন আর কর্তৃত্ব ছিল গ্রামের লোকেদের হাতে। 

শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের জমিদারি প্রসঙ্গে কুষ্টিয়ার সন্তান এস.এম আব্দুর রহমান এর সাথে ছোট্ট আলাপ হয়। তিনি চট্টগ্রামের জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার এবং একাধারে একজন কবি ও বাচিক শিল্পী।

হ্যালো বাংলাদেশকে তিনি জানান, ‘‘রবীন্দ্রনাথ জমিদারি দায়িত্ব নিয়ে প্রথম শিলাইদহে আসেননি। পরে যখন দায়িত্ব নিয়ে এলেন তখনই শিলাইদহে ‘সাহা’ এবং ‘শেখ’ অর্থাৎ, হিন্দু-মুসলমানের জন্য পুণ্যাহ অনুষ্ঠানে আলাদা আসনের প্রথাটি ভেঙ্গে দেন। এভাবেই সবাইকে একসাথে বসাতে সক্ষম হলেন তিনি। এমনই অনেক প্রথাভাঙ্গার মতো কাজ তিনি করতে পেরেছেন। প্রথম এখানে কৃষি ব্যাংক স্থাপন এবং কৃষির আধুনিক প্রযুক্তির সাথে কৃষকদের পরিচিত করিয়েছিলেন তিনি।

এই এলাকার গতানুগতিক যে ফসল তার বাইরে অন্যান্য ফসলের সাথে কৃষকদের পরিচিত করালেও এই প্রকল্পে বিশেষ সাড়া পাননি। তিনি কৃষিতে একটা বিপ্লব ঘটাতে চেয়েছিলেন। তিনি একজন প্রজাভক্ত জমিদার ছিলেন। তারপরেও জমিদারি নিয়ে বিভিন্নরকমের সমালোচনা রয়েছে। সেইসময়ে কাঙ্গাল হরিণাথ তার ‘গ্রামবার্তা’ পত্রিকায় জমিদারির বিপক্ষে লেখালিখিও করেছেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কর্মকাণ্ড দেখলে বোঝা যায় কৃষকদের পক্ষেই রবীন্দ্রনাথের অবস্থান ছিল। 

j

ঠাকুর এস্টেটের কর্মচারীবৃন্দ

তাঁর লেখার উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি এবং উত্তরণও শিলাইদহেই ঘটেছে। বিশেষ করে পদ্মার সাথে তাঁর একটা নিবিড় সম্পর্ক ছিল। পদ্মার পানিতে তখন অনেক মাছ উঠত। বাড়তি কিছু মাছ নিয়ে জমির উর্বরতা বাড়াতে তিনি হাতেকলমে কৃষকদের জৈব সার বানাতে শিখিয়েছিলেন। সেই সময়ের অনুপাতে তাঁর চিন্তাভাবনা ছিল অনেক আগানো। বাংলাদেশে তারঁ জমিদারির মাঝে শিলাইদহ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, একইভাবে সাহিত্যের জন্যও এই ভূমির গুরুত্বই বেশি”।

রবীন্দ্রনাথের ঘরে-বাইরে উপন্যাসের ভিত্তিতে সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রটি কালজয়ী এক সৃষ্টিকর্ম। শিক্ষার অভাবে থাকা, খাদ্যের অভাবে থাকা মানুষদের জন্য হিতকর কিছু করার মাত্রা নির্ধারণ করাও একটা বিশেষ যোগ্যতার ব্যাপার। ‘স্বদেশী’ এবং ‘ডেস্ট্রাক্টিভ-স্বদেশী’ দুইটি চরিত্র যত সুন্দর করে এখানে চিত্রায়ন করা হয়েছে। তাতে বোঝা যায় রবীন্দ্রনাথের মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা না থাকলে এমন লেখনী সম্ভব হতো না। জমিদার নিখিলের হাঁটে প্রজাদের উদ্দেশে বিদেশি পণ্য বর্জন করে দেশি পণ্য বিক্রির জন্য উৎসাহিত করতে বক্তৃতা দিবেন স্বদেশী আন্দোলনের নেতা সন্দ্বীপ। অথচ তার দূরদর্শিতা নেই। অত দেশি পণ্যের সরবরাহ নেই। প্রয়োজন হলেও দরিদ্র মুসলমান প্রজাদের পক্ষে তাৎক্ষণিক পরিবর্তন আনলে না খেয়ে মরতে হবে। চলচ্চিত্রে তাদের দুজনের এই সংলাপটি দেখুন:

নিখিল: কিন্তু মনে রেখ সন্দ্বীপ, আমার প্রজাদের অধিকাংশই গরীব মুসলমান। তাদের উপরে কোনরকমের অত্যাচার হয় সেটা আমি চাই না। যদি দেখি সেটা হচ্ছে তাহলে কিন্তু আমি বাধা দিতে বাধ্য হব।

সন্দ্বীপ: তারা যদি আন্দোলনের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় সেটা তো আমি মেনে নিতে পারি না নিখিল। অনেক মুসলমান স্বদেশী মেনে নিয়েছে। 

নিখিল: তাদের জোর করে মানানো হয়েছে। 

সন্দ্বীপ: এখানেও হবে। 

শেষমেশ দাঙ্গা পরিস্থিতি হলে স্বদেশী নেতা ঠিকই যুক্তি সামনে ঠেলে অসহায় মানুষদের মাঝে বিভেদ ঘটিয়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু প্রজাভক্ত জমিদার ময়দানে যান প্রাণের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও। নিজের প্রাণের বিনিময়ে তার দায়িত্ব রক্ষা করেন। যদিও তার প্রজারা এর মানে কতটা বুঝেছে সে প্রশ্ন থেকেই যায়। নিখিল যেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথেরই আরেক রূপ! 

k

আসমানদারি রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহে থাকাকালীন স্বহস্তে রচিত কালজয়ী গান

রবীন্দ্রনাথ তাঁর এক চিঠিতে লিখছেন, ”আমার যৌবন পৌঢ় বয়সের সাহিত্য-রস-সাধনার তীর্থস্থান ছিল পদ্মাপ্রবাহচুম্বিত শিলাইদহ পল্লীতে”। ব্যাস, এই কথার মধ্য দিয়ে এবং এই লেখার যে প্রথম ছবি সেখানেই রবীন্দ্রনাথের জমিদারির মূল নির্যাসটি রয়েছে বলে পাঠক যদি মনে করেন আমি স্বার্থক।

তথ্যসূত্র:

১. শিলাইদহ ও রবীন্দ্রনাথ, শ্রীশচীন্দ্রনাথ অধিকারী

২. মূল বই: সাম্প্রতিক দৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথ; প্রবন্ধ: রবীন্দ্রনাথের কৃষি সমবার ও গ্রামন্নোয়ন চিন্তা, হাসনাত আবদুল হাই

৩. সমবায়ী রবীন্দ্রনাথ ও পল্লী উন্নয়ন, ড. আনোয়ারুল করীম

৪. পল্লী উন্নয়নে রবীন্দ্রনাথ, ড. আনোয়ারুল করীম

৫. রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে, এস.এম. আফজাল হোসেন

৬. শিলাইদহ কুঠিবাড়ি মিউজিয়াম

আরও যা পড়তে পারেন

কমেন্ট করুণ