স্বর্ণকে বলা হয় ‘সেফ হেভেন’। এর মানে হচ্ছে বড় ক্ষতির আশংকা ছাড়া বিনিয়োগ করা যায় যেখানে। স্বর্ণে বিনিয়োগ সব সময়ই নিরাপদ। যদিও স্বর্ণের দামের সঙ্গে বিশ্ব অর্থনীতির গভীর সম্পর্ক রয়েছে। অনিশ্চয়তার সময় মূলবান ধাতুটির দাম বাড়ে। যত বেশি মূল্যস্ফীতি, তত বেশি স্বর্ণের মূল্যবৃদ্ধি হয়। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়েই স্বর্ণের দাম সবচেয়ে বেশি বাড়ে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়; অর্থাৎ ২০২০ সালের আগস্টের প্রথম সপ্তাহে বিশ্ববাজারে প্রতি আউন্স (৩১.১০৩৪৭৬৮ গ্রাম) সোনার দাম ২ হাজার ৭০ ডলার ছাড়িয়ে গেছে, যা ইতিহাসের সর্বোচ্চ।
দেশের বাজারে স্বর্ণের দাম প্রতিনিয়ত বাড়ছে। স্বাধীনতার পর গত ৫৩ বছরে স্বর্ণের দাম ৭৮০ গুণ বেড়েছে। ১৯৭১ সালে স্বর্ণের ভরি ছিল ১৭০ টাকা। সর্বশেষ চলতি বছরের ২২ সেপ্টেম্বর ২২ ক্যারেটের প্রতিভরি (১১.৬৬৪ গ্রাম) স্বর্ণের দাম বেড়ে দাঁডিয়েছে এক লাখ ৩৩ হাজার ৫১ টাকায়, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বহু মানুষ নিরাপদ ভেবে স্বর্ণে বিনিয়োগ করে যান। অর্থনীতিবিদদের মতে, বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বর্ণে বিনিয়োগ বেশ জনপ্রিয়, গয়না হিসেবে এবং স্বর্ণের বার—দুইভাবেই বাংলাদেশে এ বিনিয়োগ হয়। এর বড় কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশে পুঁজিবাজারে অনিশ্চয়তার কারণে মানুষের আস্থা অনেক কম। সে কারণে সাধারণ মানুষ স্বর্ণে বিনিয়োগ করেন। সাধারণ বিনিয়োগকারী অর্থাৎ স্বল্প আয়ের মানুষজনের কাছে স্বর্ণে বিয়োগের আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে, স্বর্ণের দাম বাড়লে বা কমলে তাতে আকাশ-পাতাল ফারাক হয় না। ফলে এটি ঝুঁকিমুক্ত।
এছাড়া অল্প শিক্ষিত বিনিয়োগকারীরা মনে করেন পুঁজিবাজার বা সঞ্চয়পত্রের মত মুনাফার হারের দিকে নজর রাখার দরকার থাকে না স্বর্ণে বিনিয়োগের বেলায়। তার বাইরে প্রয়োজনে স্বর্ণের একটি ব্যবহারিক উপযোগিতা রয়েছে, সেটাও এ খাতে বিনিয়োগ জনপ্রিয় হবার আরেকটি কারণ। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারের পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, স্বর্ণের চাহিদা সবসময় থাকে।

স্বর্ণে বিনিয়োগকে লাভজনক ও নিরাপদ বলে মনে করেন জুয়েলারি ব্যাবসায়িরা। তাদের মতে, স্বর্ণের গয়নার চেয়ে স্বর্ণের বার বা গোল্ডবারে বিনিয়োগ লাভজনক। কারণ হচ্ছে স্বর্ণের গয়না বিক্রি করতে হলে ২০ শতাংশ মূল্য কেটে রাখা হয়, আর বদল বা পরিবর্তন করলে ১০ শতাংশ কেটে রাখা হয়। কিন্তু গোল্ডবারে সেটা হবে না। অন্যদিকে, গোল্ডবার প্রতিদিন আন্তর্জাতিক বাজারের দর অনুযায়ী কেনাবেচা করা যায়।
সাধারণত গয়নার দোকানে গোল্ডবার কিনতে পাওয়া যায় না। বাংলাদেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লাইসেন্সপ্রাপ্ত ১৯জন বৈধ স্বর্ণ আমদানিকারক রয়েছেন, যাদের কাছ থেকে গোল্ডবার কেনা যায়।
বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম বাড়লে দেশেও দাম বাড়ে। দাম সমন্বয়ের কাজটি করে থাকে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি। ২০২০ সালে ভালো মানের; অর্থাৎ ২২ ক্যারেট এক ভরি (১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম) স্বর্ণের দাম ছিল ৬৯ হাজার ১৮৪ টাকা। চার বছর পর ২০২৪ সালে ভরিতে ৬৩ হাজার ১৮৪ টাকা বেড়েছে।
স্বর্ণের দাম বেড়ে যাওয়ায় যারা সিন্দুকে থাকা পুরোনো অলংকার বিক্রি করছেন, তারা ভালো মুনাফা পাচ্ছেন। সাধারণত পুরোনো অলংকার জুয়েলার্সে বিক্রি করতে গেলে প্রথমেই তারা সেটি কত ক্যারেটের, এ বিষয়ে নিশ্চিত হবে। তারপর অলংকারটির বর্তমান ওজন থেকে ২০ শতাংশ বাদ দিয়ে মূল্য নির্ধারণ করা হবে। ধরা যাক, ২০১৫ সালে ২২ ক্যারেটের এক ভরি ওজনের অলংকার কিনেছিলেন। তখন স্বর্ণের ভরি ছিল ৪৩ হাজার ১৪ টাকা। এখন সেটি বিক্রি করতে গেলে আপনি ১ লাখ ৬ হাজার ৪৪০ টাকা পাবেন। তাতে ভরিতে আপনার মুনাফা হবে ৬৩ হাজার ৪২৬ টাকা। ২০১৫ সালের আগে কেনা অলংকার বিক্রিতে মুনাফা আরও বেশি পাবেন। যদিও ২১ ও ১৮ ক্যারেটের অলংকার হলে মুনাফাও ভিন্ন হবে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির এক কর্মকর্তা বলেন, স্বর্ণ সব সময়ই নগদ টাকার সমতুল্য। কারণ, আপনি কয়েক ঘণ্টার মধ্যে নগদ টাকায় রূপান্তর করতে পারবেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্বর্ণের অলংকারে বিনিয়োগ করাই ভালো। কারণ, সাধারণ মানুষের জন্য স্বর্ণের বার কেনাকাটা করাটা খুব একটা সহজ নয়। বেশ কিছু ঝক্কি-ঝামেলা আছে।

জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাদের গহনা বিক্রি কমেছে। তবে যারা স্বর্ণকে নিরাপদ বিনিয়োগ মনে করেন, তাদের কাছে এর চাহিদা বেড়েছে। কারণ, স্বর্ণ তেল ও গ্যাসের মতো শেষ হয়ে যায় না। নানা হাত ঘুরে তা শেষ পর্যন্ত পৃথিবীতেই থাকে। তাই স্বর্ণের স্থায়িত্ব আছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বহু মানুষ নিরাপদ ভেবে স্বর্ণে বিনিয়োগ করে যান। স্বল্প আয়ের মানুষজনের কাছে স্বর্ণে বিনিয়োগের আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে, স্বর্ণের দাম বাড়লে বা কমলে তাতে আকাশ-পাতাল ফারাক হয় না। তাই স্বর্ণের বাজারের অস্থিরতা স্বত্বেও এখনও ভরসার আরেক নাম স্বর্ণ।
স্বর্ণের বিনিময়মূল্য আদিকাল থেকে স্বীকৃত। এর ব্যাবহারিক মূল্যও রয়েছে। তা ছাড়া বিশ্ব রিজার্ভের ইতিহাসের শুরু থেকেই স্বর্ণের রিজার্ভ হয়ে আসছে ব্যাংকগুলোতে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভসহ বিশ্বের সব কটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রার পাশাপাশি স্বর্ণ রিজার্ভ করে। অর্থনৈতিক মন্দা বা অন্য কোনো কারণে বিভিন্ন মুদ্রার অবনমন হলেও স্বর্ণের অবনমন খুব একটা হয় না। ফলে স্বর্ণের বিনিয়োগ অনেকটা নির্ভরযোগ্য। তাই স্বর্ণে বিনিয়োগ করতে মানুষ নিরাপদ বোধ করে।