Home ফিচার সুফি ও স্থপতির চিন্তায় কবি নজরুলের সমাধি

সুফি ও স্থপতির চিন্তায় কবি নজরুলের সমাধি

বিশ্বাস করুন আমি কবি হতে আসিনি, আমি নেতা হতে আসিনি, আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম।

সুপ্রভা জুঁই
১৯৬ views

মরমি কবি কাজী নজরুল ইসলাম। কোথায় নেই তিনি! সাহিত্যের সর্বস্তরে যাঁর বিচরণ, কোন ফ্রেমে ফেলে তাঁকে পাঠ করবেন? বহুমাত্রিক এই চরিত্র তাই যেন অধরাই থেকে গেলেন। শিকল পরার ছল করে থাকলেন যিনি, তাঁকে আর কোন শিকলে বেঁধে আমরা বোধ করতে পারি!

কবি কে, কার আছে কবি হওয়ার যোগ্যতা? মহাভারত-এ বনপর্বে অগ্নির সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের পরিচয় করাতে গিয়ে ঋষি বলেছিলেন, ‘‘যে- অগ্নি আশ্রম রক্ষা করেন তিনি বৈশ্বানর; যে-অগ্নি বিবাহসময়ে বধূর সঙ্গে স্বামীগৃহে আসেন তাঁর নাম দক্ষিণ অগ্নি; যে-অগ্নি আত্মাকে দহন করে প্রজ্বলিত হন, তিনি কবি’’। কাজী নজরুল ইসলাম নিঃসন্দেহে সেই মানের একজন কবি।  

২৫ মে ছিল কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৬তম জন্মবার্ষিকী। একজন স্থপতি ও লেখক হওয়ায় সুফির চিন্তাকোণে মানুষের আত্মিক ‘সমাধি’ কেমন হয় এবং স্থপতির চিন্তায় নজরুলের সমাধি কেমন হয়েছে তা নিয়ে একধরণের বোঝাপড়ার চেষ্টা করছি এই রচনায়। 

N11 copy

মোহাম্মদের নাম জপেছিলি বুলবুলি তুই আগে…

সুফির চিন্তায় নজরুলের সমাধি
“সমাধি” একটি বাংলা শব্দ। ‘সম’ + ‘আধি’ = সমাধি, যার অর্থ এমন একটি অবস্থা যেখানে মন পূর্ণরূপে স্থির এবং আত্মা নিজেকে ব্রহ্মজ্ঞান বা ঈশ্বরচেতনার সঙ্গে অভিন্ন অনুভব করে। এর কাছাকাছি যে ধারণাটা ইসলামে আছে তা হলো, ‘ফানা’ এবং ‘বাকা’। ঠিক যেমন ‘সমাধি’তে ‘স্ব’ বিলীন হয়ে যায় তেমনি ‘ফানা’ অবস্থায় বান্দা সম্পূর্ণরূপে বিলীন হয়ে যায় আল্লাহ্‌র মাঝে। আর ‘বাকা’ হলো এরও উচ্চতর হাল। যেখানে অখণ্ড চেতনার অংশ হয়ে এক চিরস্থায়ী নিরাকার সত্তার প্রকাশ ঘটে। অত্যন্ত সুক্ষ্ম এ জগত যেখানে শুধু উচ্চ স্তরের সুফিরাই পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছেন।

‘ফানা’ তথা আমি বা অহমের বিলুপ্তি মানে হলো, আল্লাহর প্রেমে নিজের সত্তা, অহং, ইচ্ছা, এমনকি নিজ অস্তিত্ব পর্যন্ত মুছে ফেলা। এটি অনুভবের মৃত্যু, কিন্তু এখান থেকেই জন্ম হয় চিরন্তন সত্যের। এই যে সমাধি, এই হালের জন্যই কাজী নজরুল ইসলাম সুফিদের কাছে এত আদরের, এত শ্রদ্ধার।

N4 copy

কাজী নজরুল ইসলামের সমাধিসৌধ, ছবি: হ্যালো বাংলাদেশ

কাজী নজরুল ইসলামের ‘সমাধি’ চেতনার সুরটা ধরে দিতে সুফিভাবের বিশিষ্ট লেখক হিলালুজ্‌জামান হেলাল হ্যালো বাংলাদেশকে জানান, ”আমরা যেটাকে ‘সমাধি’ বলছি তা হলো আমাদের এই যে ইন্দ্রিয় কাঠামো আছে। এই ইন্দ্রিয় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও আমরা কিন্তু মরে যাব না, বেঁচে থাকব। তাহলে সেই বেঁচে থাকাটা কেমন হবে? বাইরের ইন্দ্রিয়গুলো অকেজো হয়ে গেলে ভিতরের কিছু ইন্দ্রিয় আছে সেগুলো সক্রিয় হয়ে উঠবে। এই অনুভব কেবল সেই ব্যক্তি উপলব্ধি করবেন যিনি সমাধিতে আছেন। তিনি কলবে এক বিশেষ অনুভূতির অধিকারী হবেন। বস্তুজগত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে উনি আত্মজগতে চলে গিয়েছেন। এই আত্মজগত বা আধ্যাত্মিক জগতে চলে যাওয়াটায় হলো সমাধি।

প্রত্যেকটা ইন্দ্রিয়ের উপর ‘লা’ (The No) এর বিস্তার হয়ে গেলে তখন বস্তুজগতের সাথে আমাদের যে লিংকিং পয়েন্ট, অর্থাৎ ইন্দ্রিয়জ কাঠামো তা অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে। তখনই ভিতরের সত্তা জেগে ওঠে। এটাই হলো পরম সত্তার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা। এটাই হলো প্রকৃত ‘আমি’। একজন মানুষ যখন সত্যিকার অর্থে আমিতে চলে যান তখন সেখানে আর কেউ থাকে না। চেতনার দিক থেকে এত উচ্চ পর্যায়ে আত্মিকভাবে চলে গেলেন যিনি তিনিই সমাধিতে আছেন। কিন্তু সমাজেও সক্রিয় আছেন। কাজী নজরুল ইসলাম সেই মানের একজন মানুষ।

তাঁর গানগুলো যদি আমরা লক্ষ্য করি দেখা যাবে সমাধিভাব কেবল ফুটে উঠেছে তা নয় বরং তাকে ছাপিয়েও এক লীলাময় অবস্থার তৈরি হয়েছে। ‘খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আনমনে…’ সেই মানের একটি গান এটি। ‘মোহাম্মদের নাম জপেছিলি বুলবুলি তুই আগে…’ গানটিতে যে উদাহরণ ও উপমার প্রয়োগ হয়েছে তা দেখে  মাঝে মাঝে শিউরে উঠি! মনে হয় পৃথিবীতে আর কেউ মোহাম্মদকে নিয়ে এভাবে বলতে পারেননি। ‘খোদার প্রেমের শরাব পিয়ে বেহুঁশ হয়ে রই প’ড়ে…’ একবার চিন্তা করুন তো এই ভাবের কথাটা। শ্যামা সঙ্গীতের কথা বলতে গেলে শেষ হবে না। ‘কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন…’ এখানে শ্যামা কে, কৃষ্ণ কে, এই প্রসঙ্গগুলো আমরা এখনো বুঝে উঠতে পারিনি।

N12 copy

সুফিভাবের বিশিষ্ট লেখক হিলালুজ্‌জামান হেলাল, ছবি: সুফিগুরু পারমার্থিক স্কুল

মানুষের ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব এবং সভ্যতার বিবর্তন গুলো বিষয় পরস্পর সম্পর্কিত। নজরুল তো বাস্তব জীবনে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন না। নজরুল একাধারে ছিলেন রাজনীতিবিদ, গায়ক, অভিনেতা। তিনি মুসলিম ছিলেন, কোরান পড়েছেন, আযান যেমন দিয়েছেন তেমনি হিন্দুদের সাধনা করেছেন। উনি যুদ্ধ পর্যন্ত করেছেন। 

নজরুলের জীবনীটা পড়লে দেখা যায় কি পরিমাণ কষ্টের মাঝ দিয়ে জীবন পার করেছেন। এটা ছিল এই অঞ্চলের মানুষের জন্য একটা প্রতীকী চরিত্র। এই সাধারণ মানুষদের প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনি। কেউ তাঁর বাণীতে যবন বলল, কেউ বলল কাফের। তিনি যে দুঃখ পেয়েছেন সেটা তাঁর ‘যদি আর বাঁশি না বাজে’ বক্তৃতায় স্পষ্ট টের পাওয়া যায়। ১৯৪১ সালে দেওয়া এই বক্তৃতাকে বলা হয় নজরুলের বিদায়ী স্বর। কারণ ১৯৪২ সাল থেকে তিনি নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। এই বক্তৃতার মধ্য দিয়ে তিনি যেন ঘোষণা দিয়ে চুপ হয়ে গেলেন’’।

স্থপতির চিন্তায় নজরুলের সমাধি
কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধিস্থলের ডিজাইনে স্থপতি মাজহারুল ইসলামের পাশাপাশি, স্থপতি এহসান খান সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। তার সঙ্গে কথা বলে কবি নজরুলের সমাধির বিস্তারিত ভাবনা জেনে পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি। 

স্থপতি এহসান খান ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত স্থপতি মাজহারুল ইসলামের সাথেই কাজ করেছেন। পরে আলাদাভাবে কাজ করেন। ১৯৯৮ সালে তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর এ.কে আজাদ চৌধুরী স্থপতি মাজহারুল ইসলামকে আমন্ত্রণ জানান। কেননা তিনি ঐ এলাকার মাস্টারপ্ল্যান করেছিলেন। সেই সাথে আর্ট কলেজ আর পাব্লিক লাইব্রেরি ডিজাইন করেছিলেন যার বর্তমান নাম ক্রমানুসারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ এবং ন্যাশনাল লাইব্রেরি। একদিকে লাইব্রেরি, অন্যদিকে চারুকলা, আর মাঝখানে একটা আর্কিটেকচার স্কুল প্রস্তাব করেছিলেন উনি সেই মাস্টারপ্ল্যানে। মাজহারুল ইসলামের সেই ড্রয়িংগুলো এখনো সংরক্ষিত আছে। মাজহারুল ইসলাম তাঁর সাথে স্থপতি এহসান খানকেও এই প্রকল্পের জন্য আহ্বান জানান।

এই জায়গাটার ড্রয়িং মাজহারুল ইসলামই প্রথম করেছিলেন। উনার করা মাস্টারপ্ল্যানের অনেক কিছুই হয়নি। ১৯৯৮ সালে এই সাইটে ছিল- নজরুলের মাজার, পাশে জয়নুল আবেদিন ও কামরুল হাসানের কবর এবং আরেকপাশে বুদ্ধিজীবীদের কবরস্থান। 

গণপূর্ত ও স্থাপত্য বিভাগ থেকে এই সমাধি চত্বরটির ডিজাইনের কাজটা করা হয়েছিল। তখন এই জায়গাটায় অনেক সুপারি গাছ ছিল। নজরুল গবেষক রফিকুল ইসলামসহ অতিথিরা ১৯৯৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে কবি নজরুল ইসলামের সমাধি ঘিরে রোপণ করেছিলেন সুপারি গাছের চারা। লক্ষ্য ছিল ১৯৯৯ সালে কবি নজরুলের জন্ম শতবর্ষ, ছয় বছরের মাথায় ১০০ গাছ বড় হবে। কারণ নজরুলের “চক্রবাক” কাব্যগ্রন্থে “বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি” পঙ্‌ক্তিতে ‘গুবাক’ শব্দটি সুপারি গাছকে নির্দেশ করে। কাজী নজরুল ইসলামকে এখানে শায়িত করার পিছনে অন্যতম কারণ ছিল তাঁর গান “মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই/ যেন গোরে থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই…” ফলে এটা ডিজাইন কন্সেপ্টের একটা জরুরি অংশ। 

pp 1

স্থপতি মাহজারুল ইসলামের নিজ হাতে আঁকা নজরুলের সমাধিসৌধের প্ল্যানের স্কেচ

সে সময় প্রধান সড়ক থেকে প্রবেশের জন্য একটা ছোট্ট গেট ছিল, কিন্তু সেটা বন্ধই থাকত। মানুষজন মসজিদের পাশের গেটটা ব্যবহার করত। একটা কংক্রিট পেভিং পেরিয়ে ইজিপ্টের মাজতাবার মত দেখতে একটা উঁচু কাঠামোয় নজরুলের কবরটা দেওয়া ছিল। অনেক উঁচুতে সিঁড়ি দিয়ে উঠে ফুল দিতে হত। তখন এই জায়গাটার ল্যান্ডস্কেপের কোনো ভাষা ছিল না। অপরিকল্পিতভাবে জায়গাটা পড়ে ছিল। জায়গাটার তত্ত্বাবধায়নও খুব একটা সুবিধার ছিল না। বছরে কয়েকটা দিবসে এই জায়গাটা ব্যবহৃত হত। 

তাই ১৯৯৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ঠিক করলেন এই সমাধিস্থলটাকে নিয়ে একটু কাজ করা হোক। তখন মাজহারুল ইসলাম সাইটের অবস্থাটাকে ধরে বেশকিছু স্কেচ করেন। বিশেষ করে বাগানের ধারণাটা উনি সুন্দর করে স্কেচ করেন। অনেক জায়গা তৈরি করেন। যেমন- অনুষ্ঠান কোথায় হবে, মানুষ কোথায় বসবে ইত্যাদি। কোন স্থানের পর কোন স্থান আসবে, সেগুলোর অনুভব এবং অভিজ্ঞতার ধারণা তৈরি করতে গিয়ে তিনি বাংলা চালের মতো একটা ফুটপাথের পাশে প্রবেশ প্রকোষ্ঠ প্রস্তাব করেন। এই ধারাবাহিকতায় কবরস্থানে ঢোকার আগে একটা ট্রান্সিশনাল বা রূপান্তরের স্পেস করতে চাইলেন। ল্যান্ডস্কেপে তিনি একটা বৃত্ত দিলেন এবং পানির আধার দিলেন যাতে একটা ট্রাংকুইলিটি বা শান্ত মনোভাব তৈরি হয়। আর সমাধিটিকে রিমডেলিং করে মাটির কাছাকাছি নিয়ে এলেন।

ছোট একটা সমাধি যার চারদিকে কতগুলো বেঞ্চ থাকবে। সবাই যেন সমাধির কাছে যেতে পারে, এবং বেঞ্চে বসতে পারে। স্থপতি মাজহারুল ইসলামের ধারণা ছিল মানুষ কবরের পাশে বসে দোয়া পড়বে, নজরুলকে স্মরণ করবে, তাঁর কবিতা পড়বে। আগের কবরের ডিজাইনে যেমন নজরুলকে অনেক দূরে রাখা হয়েছিল, সেখান থেকে নজরুলকে উনি মানুষের কাছে নিয়ে আসতে চাইলেন। সমাধির যে চিরবিশ্রামের ধারণা সেটা উনি তৈরি করেছিলেন। জায়গাটাকে কেবল দেখার স্থানের মাঝে উনি সীমাবদ্ধ করতে চাননি। 

N1 copy 1

স্থপতি এহসান খানের করা কবি নজরুলের সমাধিসৌধের প্ল্যান, ছবি: ই.কে আর্কিটেক্টস

মাজহারুল ইসলাম চেয়েছিলেন কবরের পিছনে একটা বড় দেয়াল হোক। ১৫ বা ২০ ফিট উচ্চতার একটা ইটের দেয়াল। পুরো চত্বরটাকে একটা ইটের চাদর ভাবা হয়েছিল। এখান থেকে কিছু সবুজ বেল্ট বের হবে। এখানেই নানা অভিজ্ঞতার স্পেসের মধ্য দিয়ে একটা পর্যায়ে এসে পিছনে এই ইটের দেয়ালটা হবে ব্যাকড্রপ। এই ব্যাকড্রপটাই মনুমেন্টের ধারণাটাকে লালন করবে। একটা দেয়াল, তার সামনে অনেক গাছ।

এই দেয়ালের দুই পাশে দুইটা প্রবেশদ্বার থাকবে যার মাঝে একটা দিয়ে প্রবেশ হবে, আরেকটা দিয়ে প্রস্থান। এর মাঝে উনি একটা গ্যালারি প্রস্তাব করলেন। এই জায়গাটা প্রায় ১৫ থেকে ২০ ফিট প্রশস্ত আর লম্বায় ব্যাকড্রপ দেয়ালের পুরোটা জুড়েই। এই গ্যালারিতে বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতি থাকবে, নজরুলের স্মৃতি থাকবে। মূলত এটা একটা প্রদর্শনীর স্থান বা যাদুঘরের মতো কাজ করবে। এখানে এসে মানুষ তাঁদের সম্পর্কে জানতে পারবে, সময় কাটাতে পারবে, একটু বসতে পারবে। এখানে কিছু টয়লেটের ব্যবস্থাও ভাবা হয়েছিল। 

তাহলে দেখা যাচ্ছে, মাজহারুল ইসলাম প্রধান সড়ক থেকে যাত্রা শুরু করে যাদুঘরে এসে সেটা শেষ করলেন। এরপর এ অনুযায়ী ড্রয়িং ও টেন্ডার হলেও কাজটা আর আগায়নি। ফান্ড বা বিভিন্ন জটিলতার কারণেই হোক কাজটা শেষ হলো না। ২০০১ সালে সরকার পরিবর্তন হলো। সব কাজ থেমে গিয়েছিল। 

এরপর ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার অনেক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র উন্নয়নের উদ্যোগ নেন। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ থেকে স্থপতি এহসান খানকে আবার ডাকা হয়। মাজহারুল ইসলাম তখন বেশ অসুস্থ। তিনি এহসান খান ও তার দলকে কাজটা আগাতে উৎসাহ দেন এবং প্রয়োজনে পরিবর্তন আনতে বলেন। 

N2 copy

স্থপতি এহসান খানের চিন্তায় কবি নজরুল সমাধিসৌধের কলামবিহীন ট্রাঞ্জিশনাল এন্ট্রি, ছবি: ই.কে আর্কিটেক্টস

প্রথম ব্রিফিং-এ স্থপতিদের জানানো হয়, পিছনে যে যাদুঘরটা ডিজাইন করা হয়েছিল সেটা এখন আর করা যাবে না। কারণ সেখানে কর্মচারীদের টিনের কিছু ঘরবাড়ি আছে যেগুলো আর সরানো যাবে না। এহসান খান অনুভব করেন এই জায়গাটার একটা বিরাট আবেদন না থাকলে এর যে প্রভাব তা বিস্তার লাভ করবে না। কতগুলো ডিজাইন নিয়ে তিনি কাজ করতে থাকেন। এবং শেষ পর্যন্ত ঠিক করেন যে পিছনে যে যাদুঘরটা ভাবা হয়েছিল সেটা যেহেতু হচ্ছে না তাহলে কাছাকাছি মানের কিছু একটাকে সামনে নিয়ে আসা যাক।

একটা প্রবেশের অভিজ্ঞতা, থ্রেশোল্ড ডিজাইন করা যাক। যেহেতু একটা ব্যস্ত রাস্তা থেকে প্রবেশ করতে হবে, ফলে ট্র্যাংকুইলিটি বা শান্ত ভাবটা তৈরি করার দরকার আছে। খালি ল্যান্ডস্কেপ দিয়ে এই জায়গার গুরুত্ত্বকে মেলে ধরতে পারার সম্ভব হচ্ছে না মনে করে তিনি একটা প্যাভিলিয়ন প্রস্তাব করেন। এই প্যাভিলিয়নটা যেমন একটা আসা-যাওয়ার পথ, তেমনি এটা একটা প্রদর্শনীর জায়গা হিসেবেও প্রকাশ পাচ্ছে। 

এখানে তিনটা প্রকোষ্ঠ ডিজাইন করা হয়েছে। একটা নজরুলের গ্যালারি, একটা জয়নুল আবেদিন ও কামরুল হাসানের গ্যালারি, আরেকটা বুদ্ধিজীবীদের গ্যালারি। ডানপাশে তথ্যকেন্দ্র এবং পিছনে রয়েছে টয়লেট।  

আগের ডিজাইনে করা পিছনের সেই বড় দেয়াল যেহেতু হচ্ছে না। তাই একটা ইটের প্রাচীর প্রস্তাব করা হয় যাতে একটা বাগানের ভাব তৈরি হয়। জায়গাটা উন্মুক্ত থাক; এটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চায়নি। বাস্তবতা বিচারে তাদের মনে হয়েছিল চারুকলার শিক্ষার্থীদের যে জীবনযাপন তাতে করে এখানে যেহেতু একটা মসজিদ আছে এবং সমাধিস্থল নিয়ে মানুষের যে আবেগ কাজ করে সেখানে সমস্যা হতে পারে। কিন্তু এই যোগাযোগটা তৈরি না করলে আবার স্পেসের কন্টিনিউটিও থাকে না। ফলে একটা জটিলতা থেকেই গিয়েছে।

N8 copy

কাজী নজরুল ইসলামের সমাধিসৌধে প্রবেশের অভিজ্ঞতা।,ছবি:ই.কে আর্কিটেক্টস

মাজহারুল ইসলামের ডিজাইন করা চারুকলা একটা গার্ডেন প্যাভিলিয়নের মতো। আউটডোর-ইন্ডোর একটা স্পেস থেকে আরেকটা স্পেসের প্রবাহ ঘটছে, কখনও গাছের ছায়া কখনও কংক্রিট স্ল্যাবের ছায়া। মাজহারুল ইসলামের এই থিমটাকে নিয়ে এহসান খান কাজ করলেন। তিনি কংক্রিট স্ল্যাব বানিয়ে তার নিচে কলাম দিয়ে একটা এন্ট্রি ট্রাঞ্জিশনাল স্পেস চিন্তা করলেন। কিন্তু এত ছোট জায়গায় গ্যালারি কি করে সংকুলান করা যাবে এমন একটা সমস্যা দেখা দিল। তখন এর নিচে থাকা কলামগুলোকে বাড়াবাড়ি মনে হয়েছিল তার। কলামবিহীন একটা কাঠামো প্রস্তাব করলেন তিনি।

যে তিনটা প্রকোষ্ঠ প্রস্তাব করেছিলেন সেগুলোই স্ট্রাকচারাল এলিমেন্ট হিসেবে কাজ করলো তখন। এর ভিতরে গ্লাসের কলাম দিয়ে একটা স্বচ্ছতা রাখা গেল। দেখলে মনে হয় একটা লাইট বক্সের উপরে ছাদটা আছে। গ্লাসটা কাঠের ফ্রেম দিয়ে ঘেরা একটা সফট প্যাভিলিয়ন হলো। মাজহারুল ইসলাম ১৯৫৩ সালে যা ডিজাইন করেছিলেন সেটার নির্যাস নিয়ে ২০০৮ এ এসে একই ভাষায় এখনকার সহজলভ্য প্রযুক্তি ও কাচামাল দিয়ে ডিজাইনটা করে মাজহারুল ইসলামকে শ্রদ্ধা জানালেন স্থপতি এহসান খান। 

চারুকলা ও মসজিদের সাথে একটা দৃশ্যগত যোগাযোগের জন্য সেমি-ট্রান্সপারেন্ট ইটের দেয়াল ডিজাইন করা হয়। বাকি ল্যান্ডস্কেপে মাজহারুল ইসলামের চিন্তারই প্রতিফলন আছে। তিন স্তরের স্পেস: প্রথমে এন্ট্রি সমাগমের জায়গা, তারপরে একটা আধ্যাত্মিক রূপান্তর হিসেবে বৃত্ত এবং পানির আধার, এবং সবশেষে নজরুলের সমাধি।

সমাধিটাকে নিচে নিয়ে আসাটার মাঝে মাজহারুল ইসলাম আসলে নজরুলকে ধরতে চেয়েছিলেন। নজরুল মানুষের কবি, সাম্যের কবি। তাঁর লেখায় ক্ষোভের প্রকাশ, প্রতিবাদের প্রকাশ, শোষণের বিরুদ্ধে মানুষের অধিকারের প্রকাশ হয়েছে। সকল শ্রেণির মানুষের কাছেই নজরুল অত্যন্ত আপন। তাই এই মানুষটাকে সবার কাছে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন তিনি।  

N9 copy

কলামবিহীন ছাদের নিচে প্রকোষ্ঠ ও এর অভিজ্ঞতা,ছবি:ই.কে আর্কিটেক্টস

এতে অবশ্য নজরুল একাডেমির অনেকে ভেবছিলেন নজরুলকে কোনোভাবে অশ্রদ্ধা করা হচ্ছে কি না। কাজটা করা সহজ ছিল না। একটা মব তৈরি হয়েছিল রীতিমতো। নজরুলকে জয়নুল আবেদিন ও কামরুল হাসানের সমকক্ষ বানিয়ে ফেলা হচ্ছে এমন জটিলতা হয়েছিল। যারা সমাধিস্থলের নতুন পরিকল্পনা করছিলেন তাদের নাস্তিক বানিয়ে দেওয়া হচ্ছিলো। কিন্তু ডিজাইনারদের পক্ষে এলেন খিলখিল কাজী, তিনি কাজী নজরুল ইসলামের নাতনি। আগের যে মাজতাবা আকৃতির সমাধিটা ছিল, যেখানে সিঁড়িতে উঠে সবাই ছবি তোলার জন্য হুলুস্থুল করত সেটা খিলখিল কাজীর খুব অপছন্দ ছিল। এটা একটা অসভ্য চর্চার মতো বিষয় হয়েছিল বলে তিনি মনে করতেন। 

কবরে না উঠে বরং মাটির কাছেই থাকা ভালো এটা মাজহারুল ইসলাম চিন্তা করলেন। যাতে করে নজরুলকে অনুভব করা যায়। নজরুলের সমাধিস্থলটা উনি একটা জমায়েতের জন্য চিন্তা করেছিলেন, অব্জেক্ট হিসেবে ভাবেননি। স্থপতি এহসান খান বলেন, ঐ জমায়েতের চিন্তাটা তারা আর করতে পারেননি। পরে এই উঁচু জায়গাটাকে কিছুটা ভেঙ্গে ডাবল স্টেজড মাজতাবা করা হলো। একটা কম্প্রমাইজ সল্যুশন বলা যেতে পারে। সব পক্ষই তাতে করে খুশি হলো।  

N13 copy

স্থপতি এহসান খান এবং স্থপতি মাজহারুল ইসলাম

সুফির চিন্তায় রওজা কেন জরুরী
‘রওজা’ অর্থ বাগান। ‘রওজাতুন নবী’, অর্থাৎ রাসূলের বাগান। বাগান তো ফুল ছাড়া হয় না। তাহলে এই ফুল আর ফুলের সুবাসে মোহিত হওয়ার যে স্থান সেটির মর্যাদা আমাদের বুঝতে হবে।  সুফিদের চিন্তায় রওজা বা ওলির মাজার শুধু একটি সমাধিস্থল নয়, বরং এক আধ্যাত্মিক কেন্দ্র। এখানে ওলির পার্থিব দেহাবসান ঘটলেও, তাঁর রূহ বা আত্মিক উপস্থিতি সক্রিয়। সুফিরা মনে করেন, যাঁরা আল্লাহর প্রেমে নিজেকে সম্পূর্ণ বিলীন করেছেন, তাঁদের রূহে এমন এক জ্যোতি থাকে যা মৃত্যুর পরও দুনিয়াতে রহমত হিসেবে উপস্থিত থাকে। এই কারণেই রওজা হয়ে ওঠে এমন এক জায়গা, যেখানে একজন সাধকের হৃদয় ঈশ্বরমুখী হতে পারে।

সুফি হিলালুজ্‌জামান হেলাল এ প্রসঙ্গে বলছেন, ‘‘সবকিছুর ক্ষেত্রেই একটা আনুষ্ঠানিকতা বা প্রতীকের তাৎপর্য থাকে। সামাজিক জীবন যাপনে সবক্ষেত্রেই আমরা সিম্বলকে মেনে চলি। মুসলমানেরা কাবার দিকে মুখ করে নামাজ পড়ে, এটা যেমন একটা সিম্বলিক বিষয়। তাহলে আমরা যাঁর সাথে চলেফেরা করলাম, যাঁকে কিছুটা মূল্য দিলাম, তাঁর দেহটা যেখানে থাকল সেটাতো আমাদের কাছে ওরকমই গুরুত্বপূর্ণ। কোনো কোনো মানুষ যাঁদের আমরা দেখা পাইনি কিন্তু তাঁদের মাজারটা রয়ে গেছে। ঐ একই সূত্রে, যেহেতু আমরা একটা পরম্পরার মাঝে আছি। অতএব, ঐ মাজারটাই আমার কাছে শ্রদ্ধার একটা প্রতীক। 

N10 copy

কাজী নজরুল ইসলামের সমাধিসৌধে উদযাপিত হচ্ছে নজরুলের জন্মদিন। ২৫মে, ২০২৫ ছবি: বিশ্ব সূফী সংস্থা

কিন্তু যারা আধ্যাত্মিকতার এমন একটা উপলব্ধিতে এসে যান তাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আরেকভাবে বোধে আসে। এই উপলব্ধিটা বলতে বোঝায় যাদের সেইরকম যোগাযোগের অবস্থাটা তৈরি হয়েছে যে তারা যখন  মাজারে যান তখন একটা জীবন্ত অনুভব তাদের মাঝে কাজ করে। যেটাকে ফায়েজ বলে, জাজবা বলে। উনাদের কাছে গেলে তখন ভক্তের ভিতরে আলোড়নটা অন্যদের চাইতে দ্রুততর হয়। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস কালীদেবীর মূর্তির কাছে গেলেই তার জাজবা এসে যেত। সেরকমই উঁচুমানের কোনো মানুষের কাছে গেলেই যদি তার সেই সেন্সিটিভিটি থাকে সেটা সক্রিয় হয়ে উঠবে। এটা একটা জীবন্ত ঘটনা। এটা কোনো মরা মানুষের ঘটনা নয়। এই অর্থে মাজার একটা জীবন্ত বিষয়, সবার কাছে নয়, কারো কারো আছে। যেহেতু জীবন্ত বিষয় তাই তার সাথে জীবন্ত আচরণ করা হয়। ফুলের মালা দিয়ে, ভক্তি করে, সম্মান দিয়ে, বাতি জ্বালিয়ে কিংবা আগরবাতি দিয়ে জীবন্ত বিবেচনা করেই তার সাথে থাকা হয়’’।  

কবি নজরুল লিখছেন, “পুবান হাওয়া পশ্চিমে যাও কাবার পথে বইয়া/ যাও রে বইয়া এই গরিবের সালামখানি লইয়া… … তোমার পানির সাথে লইয়া যাও রে আমার চোখের পানি/ লইয়া যাও রে এই নিরাশের, দীর্ঘ নিশাসখানি/ নবীজীর রওজায় কাঁদিও ভাই রে আমার হইয়া।।”

নজরুলের সমাধি নিয়ে কিছু প্রশ্ন
স্থপতি মাজহারুল ইসলামের মাস্টারপ্ল্যানে কি ছিল আর কেন বদল এলো? কারা নিল সেই সিদ্ধান্ত? চারুকলার কর্তৃপক্ষ কি চেয়েছিল শিল্পাচার্যের সমাধি এখানেই হোক, নাকি আলাদা কোনো জায়গার দাবী ছিল তাদের? আমি জেনেছি চারুকলার শিক্ষার্থীরা বিশেষ দিবসগুলোতে চারুকলার ভিতরের গেইট দিয়ে এই জায়গায় প্রবেশ করে। তারমানে এই চত্বরের যে মেইনগেট সেটা জয়নুল আবেদিনের চাইতেও বেশি নজরুল কেন্দ্রিক হয়েছে। ফলে অনুভূতিগুলো জটিল হয়ে যাচ্ছে। এখানে যারা শায়িত আছেন তারা কে ছোট, কে বড় এমন একটা দ্বন্দ এখানে প্রকট হয়ে উঠেছে। 

N3 copy

কবি নজরুলের সমাধিসৌধের নামফলক,ছবি: হ্যালো বাংলাদেশ

কাজী নজরুল ইসলাম যে মানের মানুষ সে হিসেবে এই জায়গাটা কতখানি তাঁর মর্যাদাকে তুলে ধরতে পারলো। এনিয়েও ভক্ত-অনুরাগীদের মাঝে নানান কথা আছে। যিনি গানের মধ্যে মসজিদের পাশে কবর দেওয়ার আকুতি জানালেন সেটা কি তাঁর বর্তমান সমাধিসৌধে করার সুযোগ আছে? যে কারণে চারুকলার শিক্ষার্থীদের জীবনযাপন প্রশ্নবিদ্ধ সেই একই কারণে সুফিদের জীবনযাপনও নিশ্চয় প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। এমনকি সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিয়েও এই চত্বরে বেশ জটিলতা আছে। মানুষের সংস্পর্শ থেকে বিচ্ছিন্নই থেকে গেল জায়গাটি। 

অথচ এখানে নানান কিসিমের মানুষের সমাগম হতে পারত। কেউ গান গাইত, কবর জিয়ারত করত, কবিতা আবৃত্তি করত, বসে থাকত কিন্তু এগুলো হলো না। নজরুলকে না বোঝার জায়গা থেকেই আজকের এই পরিণতি। আমাদের জানতে হবে যে মানবজাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের একজন তিনি, যিনি কেবল জাতীয় কবি নন, একজন বৈশ্বিক মানুষ। 

উনার বাস্তব জীবনের যে সংগ্রাম, হিন্দু-মুসলিমকে এক করার যে চেতনা সেটাকে এখানে আর উদযাপন করা যাচ্ছে না। এই ক্ষুদ্র পরিসর এবং আশপাশে যারা আছেন তাদের সবাইকে মিলিয়ে এটা একটা বুদ্ধিজীবীদের কবরে উপনীত হয়েছে। ফলে নজরুল এখানে প্রতিফলিত হননি। একইভাবে জয়নুল আবেদিনও হননি। নানা গুণী মানুষজনকে নিয়ে এই জায়গাটার চরিত্র কি হবে সেটা অপরিষ্কার থেকে গিয়েছে। 

নজরুলের লেখার মর্মার্থ বুঝতে, উদাহরণ উপমা বুঝতে যে ভাষাতাত্ত্বিক দক্ষতা দরকার সেটা আমরা করে উঠতে পারছি না। তিনি বাংলাদেশের জাতীয় কবি হলেও ডিজিটাল মাধ্যমে তাঁর সমস্ত লেখনী এবং জীবনীও আমরা সকলের জন্য সুন্দরভাবে তুলে ধরতে পারিনি। 

নরকে বসে যদি কেউ পুষ্পের হাসি হাসেন, তাহলে এর অর্থ আমরা কি ধরে নিব? বিদ্রোহী কবিতা দিয়ে উনার যে পরিচয়টা দাঁড়িয়েছে, হিন্দু-মুসলিমের যে মিলন উনি ঘটাতে চাইলেন, প্রেম ছড়াতে চাইলেন এগুলো আমরা বুঝতে পারলাম না। কিন্তু উনার সমাধিস্থলে এই বোঝাবুঝির একটা সুযোগ ছিল। তারপরেও বর্তমান ডিজাইনে যতটা সম্ভব নজরুলকে ধরার একটা চেষ্টা করা হয়েছে। বস্তুজগত থেকে মানুষকে ক্ষণিক স্থিরতা দেওয়া, মুক্ত হাওয়ায় বাগানের গাছপালা ফুল ও পানির মাঝে সমাধিটাকে যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে নানান প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও তা প্রশংসনীয়।

নজরুলের শেষ কথা এবং আমাদের প্রেমের দায়
রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে প্রায়ই বলতেন, “দেখ উন্মাদ, তোর জীবনে শেলীর মত, কীট্‌সের মত খুব বড় একটা ট্র্যাজেডি আছে। তুই প্রস্তুত হ!” সুফি হেলালের কথা শুনে আমি চট করে ‘‘যদি আর বাশী না বাজে’’ বক্তৃতাটা পড়ে নেই। শেষের কিছু অংশ আমার পাঠকদের না জানিয়ে পারছি না। তিনি বলছেন-  

”যদি আর বাঁশি না বাজে- আমি কবি বলে বলছিনে, আমি আপনাদের ভালবাসা পেয়েছিলাম সেই অধিকারেই বলছি, আমায় আপনারা ক্ষমা করবেন। আমায় ভুলে যাবেন। বিশ্বাস করুন আমি কবি হতে আসিনি, আমি নেতা হতে আসিনি, আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম। সেই প্রেম পেলাম না বলে, আমি এই প্রেমহীন নীরস পৃথিবী থেকে অভিমানে চির দিনের জন্য বিদায় নিলাম। 

যেদিন আমি চলে যাব- সেদিন হয়তো বড় বড় সভা হবে। কত প্রশংসা কত কবিতা হয়ত বেরুবে আমার নামে। দেশ-প্রেমিক, ত্যাগী, বীর, বিদ্রোহী বিশেষণের পর বিশেষণ! টেবিল ভেঙ্গে ফেলবে থাপ্পর মেরে বক্তার পর বক্তা। এই অসুন্দরের শ্রদ্ধা নিবেদনের শ্রাদ্ধ দিনে, বন্ধু তুমি যেন যেও না। যদি পার চুপটি করে বসে আমার অলিখিত জীবনের কোন একটি কথা স্মরণ করো। তোমার ঘরের আঙ্গিনায় বা আশপাশে যদি একটি ঝরা-পায়ে পেষা ফুল পাও সেইটিকে বুকে চেপে বলো- বন্ধু আমি তোমায় পেয়েছি”।

N6 copy

মরমি কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধি, ছবি: হ্যালো বাংলাদেশ

তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আর আমি জাগিব না
কোলাহল করি সারা দিনমান কারো ধ্যান ভাঙ্গিব না
নিশ্চল, নিশ্চুপ,
আপনার মনে পুড়িব একাকী
গন্ধ-বিধূর ধূপ।

আরও যা পড়তে পারেন

কমেন্ট করুণ