ষাটের দশকে আমেরিকান পুষ্টিবিদেরা দেখলেন ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী দেশগুলো; বিশেষত ইতালি ও গ্রিসের অধিবাসীদের মধ্যে হৃদরোগে মারা যাওয়ার হার আমেরিকা ও উত্তর ইউরোপের দেশগুলোর চেয়ে অনেক কম। তখন তাঁরা এ অঞ্চলের মানুষের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। গবেষকদের খুব বেশিদিন লাগেনি এটা বুঝতে যে, ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী দেশসমূহের ডায়েট সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যকর। তখন থেকে এই অঞ্চলের খাদ্যাভাসের প্রতি সবার আগ্রহ বাড়ে। এর নাম দেওয়া হয় মেডিটারেনিয়ান ডায়েট। বর্তমানে ফোর্বস, বিজনেস ইনসাইডার, ওয়ার্ল্ড রিপোর্টের ডায়েট র্যাঙ্কিয়ে এর অবস্থান এখন এক নম্বরে।
মেডিটারেনিয়ান ডায়েটের ইতিহাস হাজার বছর আগের। সে সময় ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী অঞ্চলের মানুষের খাদ্যাভ্যাস খুব সহজ-সরল ছিল। সেখানের জমিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেড়ে ওঠা কৃষিপণ্য যেমন, জলপাই, আঙ্গুর ও গম- এগুলো ছিল তাঁদের খাদ্যতালিকায়। খ্রিস্টপূর্ব নবম থেকে দ্বিতীয় শতাব্দীতে ভূমধ্যসাগরের তীরে ফিনিশিয়ান সাম্রাজ্যের শাসন ছিল। ঐ সময় লিবিয়াবাসীদের সঙ্গে ফিনিশিয়ানদের খুব ভালো বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। ইলিয়াড, ওডিসিখ্যাত হোমারের অনেক রচনায় তা উঠে এসেছে। লিবিয়া তখন গবাদি পশু, সংগৃহীত মাংস, দুধ ও নানারকম পনিরের জন্য বিখ্যাত ছিল। লিবিয়ান ব্যবসায়ীদের হাত ধরে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে প্রবেশ ঘটে।

৪০০ থেকে ৮০০ খ্রিস্টাব্দে এই অঞ্চল রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। তখন জার্মান, কেল্টিক বারবারিয়ানদের (বর্বরজাতি) অনেকবারই এই সাম্রাজ্য আক্রমণ করে। তখন তাঁরা নিয়ে আসতো বন্য শূকর, হাঁস, খরগোশ, ষাঁড় এবং বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি। খ্রিস্টাব্দ নবম শতাব্দীতে দক্ষিণ ইতালিতে আরবদের আগমন ঘটে। আরবরা ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের মানুষদের পরিচয় করিয়ে দেন, চাল, বাদাম (আমন্ড, পেস্তা), নানাজাতের লেবু, কাবলি ছোলা, দুরুম আটা (এটি দিয়ে পাস্তা তৈরি হতো), পালং শাক, বেগুন, আর্টিচোক এবং অবশ্যই জাফরন, লবঙ্গ, দারুচিনি ইত্যাদি মসলা। এভাবেই বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন জাতির মানুষদের দ্বারা সমৃদ্ধ হয়েছে মেডিটারেনিয়ান ডায়েট।
বর্তমানে এই খাদ্যাভ্যাস ব্যাপকভাবে উদ্ভিজ্জ নির্ভর। এতে স্বাস্থ্যকর চর্বি, আঁশ বা ফাইবার এবং পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাবার অন্তর্ভুক্ত থাকে। প্রচুর পরিমাণের শাকসবজি (বিশেষ করে টমেটো,বেগুন,আলু,ক্যাপসিকাম,জুকিনি,ব্রকলি, আর্টিচোক), ফলমূল এবং সামুদ্রিক মাছ, জলপাইয়ের তেল, শস্য-বীজ ও নানারকমের বাদাম ও ডাল জাতীয় উপাদান এই ডায়েটের আসল রসদ। পরিমিতভাবে খাওয়া যাবে পোল্ট্রি বা লিন মিট (মুরগি, হাঁস, কোয়েল, টার্কি) ডিম, পনির, দই। সামান্য পরিমাণে লাল মাংস খাওয়া যেতে পারে তবে সেটা মাসে এক থেকে দুইবারের বেশি নয়। এড়িয়ে যেতে হবে চিনিযুক্ত বেভারেজ, স্ন্যাকস ও অস্বাস্থ্যকর চর্বিসমৃদ্ধ খাবার।

গবেষণায় দেখা গেছে, ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী এলাকার মানুষেরা পৃথিবীর অন্য যেকোন অঞ্চলের বাসিন্দাদের থেকে অনেক বেশি স্বাস্থ্যবান। এই খাদ্যাভ্যাসের কারণে ইতালি ও গ্রীসের কিছু দ্বীপের মানুষের গড় আয়ু ১০০ এর কাছাকাছি। তাঁদের মধ্যে নানাধরনের লাইফস্টাইল ডিজিসে আক্রান্ত হওয়ার পরিমাণ অনেক কম। হৃদযন্ত্রের সুস্থতার জন্য এটি আদর্শ ডায়েট। এই ডায়েট ওজন কমানোর পাশাপাশি হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, টাইপ টু ডায়বেটিসের ঝুঁকি হ্রাস করে। শুধু তাই নয়। মেডিটারেনিয়ান ডায়েট বেশ সাসটেইনেবল বা টেকসই ও পরিবেশবান্ধব।