Home স্থাপত্য ও প্রকৌশল ‘ইসলামি স্থাপত্য’ আসলে কি?

‘ইসলামি স্থাপত্য’ আসলে কি?

সুপ্রভা জুঁই 
১৭৯ views

‘খানকা’ বা ‘মাজার’  এই শব্দগুলোর সাথে আমরা পরিচিত। খানকা হলো সূফী ও তাঁর অনুসারীদের মিলনস্থল। আর মাজার হলো একজন সুফী ব্যক্তির পার্থিব দেহাবশেষ রাখার স্থান, যাকে ঘিরে ভক্ত আশেকানদের নানা আয়োজন থাকে। খানকা কিংবা মাজারের স্থাপত্য গুনাগুণ নিয়ে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করতে গেলে ‘ইসালামি স্থাপত্য’ বিষয়টি চলে আসবেই। ভারতীয় অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ সোহেল হাশমি এনিয়ে চমৎকার আলাপ তুলেছেন। 

হাশমি বলছেন, ‘আর্চ’, ‘মিনার’ এবং ‘ডোম’ স্থাপত্যের এই তিন উপাদানকে ইসলামি স্থাপত্যের মূল গুণ হিসেবে ধরা হয়। ইসলামের বাণী সম্বলিত ক্যালিগ্রাফি, জ্যামিতিক নকশার জালি এমন অনেক কিছুকেই ইসলামী স্থাপত্য হিসেবে ধরা হয়।  

খ্রিষ্টের জন্মের ২০০ বছর আগে রোমানরা এই ‘আর্চ’ ও ‘ডোম’ প্রথম স্থাপত্যে এনেছিলো। ভোটাভুটির মাধ্যমে সিনেট নির্বাচনের ধারাও রোমানরাই প্রথম আনে। কাগজে কলমে সব সিনেটরদের সমান ক্ষমতা ও অধিকার দেওয়া হয়েছিল। ফলে তাদের জন্য যে কর্মক্ষেত্র হবে সেটিও সবাইকে যেন সমান করতে পারে এমনই একটি বৈশিষ্ট্যের দাবী রাখে। এমনকি সিজার ও ব্রুটাসও এই একই ডোমের নিচে কাজ করতেন।  এই সেক্যুলার চাহিদা থেকে ‘আর্চ’ ও ‘ডোম’ এলো কোনোপ্রকার পিলার ছাড়া। যেন সবাই সবাইকে দেখতে পান, এবং সবাই গোল হয়ে একসাথে মেঝের একই স্তরে বসতে পারেন। ফলে কেউ কারো থেকে উপরের স্তরে বসে আছেন স্থাপত্যের ডিজাইনে সেটা পরিকল্পিতভাবেই রাখা হয়নি। একই পদমর্যাদার শত্রু-মিত্র সকলেই এখানে একসাথে বসতেন, তর্ক করতেন, সিদ্ধান্ত নিতেন এবং এগিয়ে যেতেন। ফলে প্রথম গণতান্ত্রিক স্থাপত্য একেই বলা হয়।  

রোমান সাম্রাজ্য আসার আগে থেকেই রোমে জুডাইজম ছিলো। একজন ধর্মগুরু ও তাঁর অনুসারীরা মিলে এই ধর্ম পালন করার চল ছিলো যা খ্রিষ্ট ও ইসলাম ধর্মেও রয়েছে। আর্চ ও ডোমের সাথে পরিচিত হওয়ার সাথে সাথে তারা ঠিক করলেন এই স্থাপনা তারাও গ্রহণ করতে চান। কিছু সময় পর খ্রিষ্টের আবির্ভাব হয়। চার্চের স্থাপনাগুলোতেও এই ডোম ও আর্চ ব্যবহৃত হতে থাকে। এই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষে চলে আসে ইসলাম এবং তাদের স্থাপনাতেও আর্চ আর ডোম দেখা যায়। যদিও ইসলাম ধর্মের শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) নির্মিত মরুভূমির বুকে প্রথম মসজিদটি ছিলো মাটি দিয়ে তৈরি এবং এখানে কোনো আর্চ বা ডোম ছিলো না। 

1390a5963ef5749be51583f0e32733eb

হায়া সোফিয়া, ইস্তানবুল, ছবি: পিন্টারেস্ট

তাহলে প্রশ্ন হলো স্থাপত্যের গায়ে রোমান হরফে কিছু লিখলেই কি সেটা রোমান স্থাপত্য হবে? আরবিতে লেখা থাকলেই তাকে  ইসলামিক স্থাপত্য বলা হবে? স্থাপত্যের কি কোনো ধর্ম হতে পারে?

উত্তরটা খুবই সহজ, না পারে না। খ্রিষ্টীয়, হিন্দু, বুদ্ধিস্ট, ইসলামি স্থাপত্য বলে কিছু হতে পারে না। দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ডোম হলো ভ্যাটিকান সিটিতে, চার্চ সেইন্ট পিটার ব্যাসিলিকা। যেখানে পোপ সকলের উদ্দেশ্যে কথা বলেন। ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটল হিলের বিশাল ডোমটিও আমাদের চোখে পড়ে। এগুলোকে ইসলামি স্থাপত্য বলা হবে নাকি খ্রিষ্টীয়?  

ইস্তানবুলের হায়া সোফিয়া খুব জনপ্রিয় একটি মসজিদ। আসলে কিন্তু এটা গ্রীক অর্থডক্সরা নির্মাণ করেন চার্চ হিসেবে। বিশাল ডোম আর মিনার এই মসজিদে শুরু থেকেই ছিল। পরবর্তীতে রোমান ক্যাথলিক চার্চ হিসেবে রোমান ক্যাথলিক সম্প্রদায় এর দায়িত্ব নেয়। তাদেরকে পরাজিত করে বাইজেন্টাইন মুসলিমরা এবং তখন থেকে এই একই ভবনকে মসজিদ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। 

‘হিন্দু পিরিয়ড’, ‘মুসলিম পিরিয়ড’ এরপর ‘বৃটিশ পিরিয়ড’ এভাবে আমাদের ধারা নির্ধারিত হয়েছে। কিন্তু ‘বৃটিশ পিরিয়ড’ এর পরিবর্তে ‘খ্রিষ্টান পিরিয়ড’ নয় কেন? ‘খ্রিষ্টীয় স্থাপত্য’, এই বিষয়টার কোনো অস্তিত্বই নাই। তাহলে এই বিভাজন কেন হলো? সাম্রাজ্যবাদ কি আমাদের চেতনাকে ঔপনিবেশিক করে তুলল? ভাবটা এমন যে কেবল তারাই সেক্যুলার। এই বাক্সবন্দী চিন্তার মাঝে বিগত ২০০ বছর ধরে আমরা আছি আর একে অপরকে ঘৃণা করছি। কেবল হিন্দুত্ববাদ ও কেবল ইসলামের মাঝে নিজেদের আত্মপরিচয় খুঁজে মরছি। আরো নানা স্থাপত্যের ধারার নাম আমরা জানি যা একাডেমিক্যালি স্থাপত্যের ইতিহাসে আমরা পড়েছি যেমন: গথিক, ক্লাসিক, নিওক্লাসিক্যাল, রেনেসাঁ স্থাপত্যসহ নানা এলাকাভিত্তিক আন্দোলন। একইভাবে স্থাপত্যবিদ্যার পাঠ্যে আমরা মুঘল স্থাপত্য, বুদ্ধিস্ট স্থাপত্য, হিন্দু মন্দিরের স্থাপত্যও পড়েছি। সুতরাং, ইসলামি, হিন্দু ও বুদ্ধিস্ট স্থাপত্য বলতে কি বোঝায় তা নিয়ে এতদিন আমাদের যা বোঝানো হয়েছে তাকে ভেঙে নতুন করে ভাবার বিষয়টি আমাদের বিবেচনা করার খুব দরকার আছে।

আরও যা পড়তে পারেন

কমেন্ট করুণ