অ্যাডভেঞ্চার করতে ভালোবাসেন এমন যে কারোর অ্যাডভেঞ্চারের তালিকায় যুক্ত হতে পারে নতুন এক সেতু। অবাক হচ্ছেন? ভাবছেন কেনই-বা একটা সেতুকে নিজের অ্যাডভেঞ্চারের তালিকায় যুক্ত করবেন? সম্প্রতি নির্মাণ সম্পন্ন ও উন্মুক্ত করা হয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম পায়ে চলা সেতু। নাম দেওয়া হয়েছে ৫১৬ আরৌকা (Aruca). কিন্তু সেতুটির বিশেষত্ব কী, সে সম্পর্কে আসুন জেনে নিই বিস্তারিত।
৫১৬ আরৌকা সেতুটির অবস্থান উত্তর পর্তুগালের আরৌকা জিওপার্কে। এটি পর্তুগালের রাজধানী লিসবন থেকে ৩০০ কিলোমিটার (১৮৬ মাইল) উত্তরে। কায়াকিং এবং নৌভ্রমণের জন্য এটি অত্যন্ত জনপ্রিয় এক স্থান। এ ছাড়া জিওপার্কটি প্রাকৃতিক পর্যটন এবং নানাবিধ অ্যাডভেঞ্চারমূলক কর্মকাণ্ডের জন্যও বিখ্যাত। এই আরৌকা জিওপার্কের পাইভা জর্জ নদীর গিরিখাত জুড়ে ঝুলন্ত সরু ফুটব্রিজটি নির্মাণ করা হয়েছে। দাবি করা হয়েছে এটিই বিশ্বের দীর্ঘতম পায়ে চলা সেতু বলে। চলতি বছরের ২ মে সেতুটি আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে উদ্বোধন করা হয়।
সেতুটি ঘিরে পর্যটকদের আগ্রহের কারণ এটি চমৎকার একটি ঝুলন্ত সেতু। পাইভা নদীর ১৭৫ মিটার ওপরে স্থাপন করা হয়েছে সেতুটিকে। এটি জিওপার্কের ৪১টি জিওসাইটের মধ্যে আগুয়িরাস পাহাড়ের জলপ্রপাত এবং পাইভা জর্জ অঞ্চলকে দারুণভাবে সংযুক্ত করেছে। রেকর্ড ভাঙা এ সেতুটি ৫১৬ মিটার (বা প্রায় ১ হাজার ৬৯২ ফুট) দীর্ঘ। আগে বিশ্বের দীর্ঘতম ঝুলন্ত পায়ে চলা সেতুর রেকর্ড ছিল সুইজারল্যান্ডের চার্লস কুইনন ঝুলন্ত ব্রিজের ঝুলিতে, যার কাজ শেষ হয় ২০১৭ সালে।

সেতুটি গ্রানাইট ক্লিফের মুখের সঙ্গে দুটি পাহাড়কে সংযুক্ত করেছে বিধায় পর্যটকেরা ভ্রমণের সময় আশপাশের প্রাকৃতিক জলপ্রপাতের সঙ্গে সবুজ পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে সহজেই। এটি সে দেশের জন্য একটি ঐতিহাসিক প্রতীকী স্থাপনা, যা আধুনিক প্রকৌশলেরও একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। সেতুটি মুক্ত অবস্থায় পাটাতন থেকে অর্ধবৃত্তের মতো ঝুলছে। দুই পাশে দুটি কংক্রিট টাওয়ার থেকে সংযুক্ত তার দিয়ে যুক্ত। টাওয়ারগুলো দেখতে উল্টো অ আকৃতির। ঝুলন্ত তারগুলো দুটি টাওয়ারের সর্বোচ্চ পয়েন্টে স্থাপন করা হয়েছে, যা সেতুর পাটাতনগুলোকে লম্বালম্বিভাবে স্থাপিত স্টিলের প্রসারযোগ্য তারের সঙ্গে আটকানো। হাঁটাপথটি মূলত ১২৭টি পাটাতনের সমষ্টি।
উঁচু পাহাড়ে ক্যানিয়নের ওপরে এই ধরনের প্রজেক্টকে বেশ কিছু প্রকৌশলগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। যেমন, উঁচুতে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকায় বাতাসের যথেষ্ট প্রভাব থাকে, যা চলাচলেও বেশ প্রভাব ফেলে। কখনো কখনো এই বাতাস এমন অবস্থায় গিয়ে পৌঁছায় যে সেতু বন্ধও রাখতে হয়। তাই কনস্ট্রাকশন বা ফাউন্ডেশনের ক্ষেত্রে বাতাসের দিকটি অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। এই ধরনের সেতু মাটি বা পানি দুইয়ের ওপরই হতে পারে। তাই ফাউন্ডেশন বা ভিত্তিতে মাটির অবস্থাও বিশেষ বিবেচনায় রাখা হয় যেন সেতু ভেঙে না পড়ে।
আরৌকা তৈরির প্রধান সুবিধা হলো এটি ব্যয়বহুল নয় ববং যথেষ্ট পরিবেশবান্ধব। অন্যান্য সাধারণ ব্রিজ তৈরির যে খরচ ডিজাইন, কনস্ট্রাকশন বা উপকরণের দিক দিয়ে এটা তেমন ব্যয়সাপেক্ষ নয়। এ ছাড়া এই ধরনের ব্রিজ তৈরিতে সাধারণত ওজনে হালকা উপকরণ ব্যবহার করা হয়। তাই এটা একদিকে যেমন নির্মাণব্যয় কমিয়ে দেয়, তেমনি ভারী যন্ত্রপাতি বা তেমন লোকবলের প্রয়োজন হয় না। এ ছাড়া যেকোনো উচ্চতায়, লম্বায় যেকোনো মাপে, স্বল্প উপকরণে, সাধারণ ডিজাইনে তৈরি করা যায়। এদিক দিয়ে চিন্তা করলে এটি যথেষ্ট জনবান্ধব সেতু।

পদচারী-সেতু অর্থাৎ গাড়ি চলাচলের সুবিধা না থাকায় এই দীর্ঘ পথ হেঁটে পাড়ি দিতে হয়, যার জন্য এই ধরনের সেতু সবার জন্য উন্মুক্ত করার সুযোগ কম। দুর্বল চিত্ত, শিশু, বৃদ্ধদের এই এটি এড়িয়ে যেতে বলা হয়। আর এই ধরনের সেতুতে হালকা উপকরণ ব্যবহার করা হয় বলে ভার বহনও গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। তাই বলা যায়, প্রজেক্টটি যথেষ্ট সীমাবদ্ধ। সুবিধা ও চ্যালেঞ্জের দিকগুলো বিবেচনা করে বলাই যায়, আরৌকা এক দিকে যেমন ইন্টারেস্টিং, তেমন আকর্ষণীয়। সব মিলে বলা যায়, আরৌকা আধুনিক প্রকৌশলের দারুণ এক উদাহরণ!
আরৌকা অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে ইনস্টিটিউট ফর রিসার্চ অ্যান্ড টেকনোলজিক্যাল ডেভেলপমেন্ট কর্তৃক নির্মিত। এটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ২ দশমিক ৩ মিলিয়ন ইউরো বা ২ দশমিক ৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ছয় বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য এটি উন্মুক্ত নয় এবং ভ্রমণের সময় একজন গাইড থাকা বাধ্যতামূলক। এ বছরের মে থেকে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হওয়া ঝুলন্ত ব্রিজটি ভ্রমণের জন্য আপনাকে খরচ করতে হবে ১০ থেকে ১২ ইউরো এবং স্থানীয় ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বুকিং করতে হবে। তো, যাবেন নাকি নতুন অ্যাডভেঞ্চারে?