মিলেনিয়ামের শুরু থেকে মোবাইল ফোন আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। এরপর প্রযুক্তির উন্নতির মধ্য দিয়ে সবার হাতে এসেছে স্মার্টফোন। প্রথমে শুধুমাত্র যোগাযোগের জন্য ব্যবহার করা হলেও পরবর্তীতে এটি বিনোদন মাধ্যম হয়ে ওঠে। তবে বর্তমানে এমন কোনো কাজ নেই, যা মোবাইল ফোন দিয়ে সম্পন্ন করা যায় না। এর পিছনে নিয়ামক হিসেবে আছে ইন্টারনেটের সংযুক্তি। মোবাইল ফোন অনেক দিক থেকে আমাদের জীবন অনেক সহজ করেছে। তবে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে এর অতিরিক্ত ব্যবহার অনেকের ক্ষেত্রে আসক্তিতে পরিণত হয়েছে। এই আসক্তি থেকে জন্ম নিয়েছে ভয়ানক মানসিক ব্যাধি ‘নোমোফোবিয়া’।
নোমোফোবিয়ার ব্যবচ্ছেদ
ফোবিয়া শব্দটির সঙ্গে এমরা কম-বেশি সবাই পরিচিত। এটি এসেছে গ্রিক শব্দ ফোবোস থেকে। এর অর্থ ভয়- এমন কোনো জিনিস যা চোখের সামনে দেখলে বা কোনো ঘটনা ঘটলে মনের মধ্যে উদ্বেগ বা ভয় সৃষ্টি হয়। যেমন, অনেকে উচ্চতা ভয় পান, কেউ ভয় পান পানিতে নামতে। কারও কারও আবদ্ধ ঘরে দমবন্ধ হয়ে আসে। কোনো নির্দিষ্ট পোকামাকড় বা প্রাণীর প্রতিও ভয় থাকে অনেকের। এখন মোবাইল ফোন কাছে না থাকার আতঙ্ক বা ভয় দেখা যাচ্ছে অনেকের মধ্যে। একেই নোমোফোবিয়া (Nomophobia) বলে, নো মোবাইল ফোন ফোবিয়া (No Mobile Phone Phobia) শব্দগুলোর সংক্ষিপ্ত রূপ।
যদিও এখন পর্যন্ত নোমোফোবিয়াকে সর্বশেষ প্রকাশিত মানসিক রোগের চিকিৎসার সর্বজনীন অভিধান ‘ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিক্যাল ম্যানুয়াল অফ মেন্টাল ডিজঅর্ডার’-এ মানসিক ব্যাধি হিসেবে নিবন্ধন করা হয়নি। তবে এই নিয়ে অনেক বছর ধরেই গবেষণা চলছে। ২০০৮ সালে প্রথম ইউকে পোস্ট অফিস এ নিয়ে গবেষণার প্রস্তাব দেয়। এর জন্য তারা ইউগভ নামের একটি ব্রিটিশ আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট-ভিত্তিক বাজার গবেষণা এবং ডেটা অ্যানালিটিক্স ফার্মকে নিয়োজিত করে। গবেষণায় দেখা গেছে যে ব্রিটেনে প্রায় ৫৩ শতাংশ মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে যখন তাদের মোবাইল ফোন হারায়, ব্যাটারি বা ক্রেডিট ছাড়ায়, বা কোনো নেটওয়ার্ক কাভারেজ থাকে না। এই গবেষণায় মোট ২,১৬৩ জন মানুষ অংশগ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে প্রায় ৫৮ শতাংশ পুরুষ এবং ৪৭ শতাংশ নারী তাদের মোবাইল ফোনে বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে অতিরিক্ত মানসিক চাপে ভুগে থাকেন। তাদের এমন আতঙ্ক বা উদ্বিগ্ন থাকার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল, মোবাইল ফোন ব্যবহার না করার সময়ে পরিবার বা বন্ধুদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা।

৫৮ শতাংশ পুরুষ এবং ৪৭ শতাংশ নারী তাদের মোবাইল ফোনে বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে অতিরিক্ত মানসিক চাপে ভুগে থাকেন। ছবিঃ অনলি মাই হেলথ
তবে বর্তমান সময়ের ব্যাপারটা কিছুটা ভিন্ন। মোবাইল ফোনের প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরতা, একাকিত্ব ইত্যাদি কারণে নোমোফোবিয়া দেখা দেয়। আরেকটি ব্যাপার না বললেই নয়। ইউটিউব শর্টস, ফেসবুক রিলস, খুদেবার্তা আদান-প্রদান, গেমিং ইত্যাদিতে মানুষের মস্তিষ্ক থেকে ডোপামিন বা হ্যাপি হরমোন নিঃসরিত হয়। মোবাইল ফোন বন্ধ থাকলে, হারিয়ে গেলে বা নেটওয়ার্কের বাইরে থাকলে অনেকে এই ‘সুখানুভূতির অভাবে’ আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, নোমোফোবিয়া এতটাই শক্তিশালী হতে পারে যে, এতে আক্রান্ত ব্যক্তি কখনোই তাদের ফোন বন্ধ করেন না।
নোমোফোবিয়ার কিছু সাধারণ লক্ষণ রয়েছে। যেমন-
১। কখনোই ফোন বন্ধ না করা এবং মিসড মেসেজ, ই-মেইল বা কলের জন্য ক্রমাগত ফোন চেক করা।
২।পর্যাপ্ত চার্জ থাকার পরও বারবার ফোনে চার্জ দেওয়া, যেন ফোন বন্ধ না হয়ে যায়।
৩। খাবার খেতে খেতেও আপনি ফোন ব্যবহার করেন।
৪। মোবাইল ফোন কখনোই হাতছাড়া না করা। এমনকি ওয়াশরুমেও আপনি ফোন নিয়ে যাওয়া।
এই কাজগুলো ঠিকভাবে করতে না পারলে মানসিক লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়। যেমন- মোবাইল ফোন থেকে দূরে সরে গেলে হঠাৎ মনে ভয়, দুশ্চিন্তা কিংবা হতাশা ভর করা। দীর্ঘ সময় ব্যবহার না করলে আতঙ্কিত হয়ে যাওয়া বা মানসিক চাপ অনুভব করা।
সাধারণত কোনো ভীতিকর পরিস্থিতিতে মানুষ যেসব শারীরিক লক্ষণ প্রকাশ করে থাকে, এই রোগের চরম অবস্থায় গেলে সেগুলোও প্রকাশ পায়। যেমন- হঠাৎ কাঁপতে শুরু করা কিংবা স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস বাধাগ্রস্ত হওয়া। এছাড়া জ্ঞান হারিয়ে ফেলা অথবা কোনো আবহাওয়াগত কারণ ছাড়াও ঘামতে থাকা এই রোগের শারীরিক লক্ষণগুলোর মধ্যে অন্যতম। মূলত, একজন আক্রান্ত মানুষের শারীরিক লক্ষণগুলো নোমোফোবিয়ার মানসিক পরিস্থিতির জন্য উদ্ভূত হয়ে থাকে।
মুক্তির উপায়
নোমোফোবিয়ায় আক্রান্ত হলে সাইকোলোজিস্টদের সহায়তায় বিভিন্ন থেরাপির মাধ্যমে নোমোফোবিয়ার চিকিৎসা করা যায়। বিভিন্ন থেরাপির মধ্যে রয়েছে কগনিটিভ বিহেভিরাল থেরাপি, এক্সপোজার থেরাপি।
এছাড়াও সাপোর্ট গ্রুপের মাধ্যমে এই ভয় কাটানোর চেষ্টা করা যায়। এ ধরনের গ্রুপে একই ভয়ে আক্রান্ত ব্যক্তিরা নিজেদের ভয়কে জয় করার অভিজ্ঞতা শোনান। উৎসাহিত করেন অন্যদেরও ভয় থেকে বেরিয়ে আসতে। নোমোফোবিয়া শারীরিক সমস্যা তৈরি করলে সাইকিয়াট্রিস্টের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ গ্রহণ শুরু করা উচিৎ।

মোবাইল ফোন বন্ধ থাকলে, হারিয়ে গেলে বা নেটওয়ার্কের বাইরে থাকলে অনেকে ‘সুখানুভূতির অভাবে’ আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। ছবিঃ ডাল-ই
নোমোফোবিয়া প্রতিকার ও প্রতিরোধে নিজেদেরও কিছু ছোট ছোট পদক্ষেপ নিতে হবে। মোবাইল ফোন ব্যবহারে কিছু লক্ষ্য নির্ধারণ করা যেতে পারে। যেমন-
১। নিজের জন্য একটি স্ক্রিনটাইম বরাদ্দ করুন যে সময়ের বাইরে আপনি ফোন ব্যবহার করবেন না।
২। অপ্রয়োজনীয় অ্যাপগুলোর নোটিফিকেশন বন্ধ করে রাখুন। কারণ, এসব নোটিফিকেশন আপনার মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটায়।
৩। ঘুমানোর অন্তত এক ঘণ্টা আগে ফোন বন্ধ করে রাখুন এবং বিরামহীনভাবে ঘুমান।
৪। ফোনে বারবার সময় দেখার বদলে হাতঘড়ি ব্যবহার করুন।
৫। ফোনের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে বেশি বেশি সময় কাটান, বই পড়ুন বা পছন্দের কোনো সৃজনশীল কাজে নিজেকে যুক্ত করুন।