অতীত ও বর্তমান বাস্তবতায় ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্তিবিরতি চুক্তি খুব দ্রুত করা সম্ভব হবে— এমন বিশ্বাস ছিল না লেবাননের অধিকাংশ মানুষের। এরপর যখন এই কাঙ্খিত সময় এলো, চুক্তির করার বিষয়ে উভয় পক্ষ সম্মত হলো। আর এক ঘণ্টা আগে বিষয়টি নিয়ে নিজের অনুভূতি কেমন ছিল তা একটি সম্মেলনে জানিয়েছিলেন দেশটির একজন শীর্ষ বিশ্লেষক।
তার মতে, যুদ্ধবিরতি চুক্তি যখন আলোর মুখ দেখল, এর আগের রাতে ঘুমাতে পারেননি। এটা ছিল অনেকটা ঈদের আগের রাতের মতো। আপনি যখন শিশু তখন আর ওই সময়ের জন্য তর সইবে না। আমার অবস্থাও তেমনি ছিল।
ইসরায়েলি বিমান হামলায় এরই মধ্যে মারা গেছে সাড়ে তিন হাজারের বেশি নাগরিক। সর্বত্র যুদ্ধের ভয়াবহতা। মানুষ বাড়িতে ফিরতে চাইছে। এমন পরিস্থিতিতে যুদ্ধবিরতি স্বস্তি ও আনন্দের খবর। প্রায় ১০ হাজার ঘর-বাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ আহত। ইসরায়েলের হামলা থেকে বাঁচতে ঘর-বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন প্রায় ১০ লাখ মানুষ। এমন নির্মম অবস্থার পরও ইসরায়েলের মধ্যে অনেকে আছেন, যারা ভাবছেন এতো ভালো সুযোগ পাওয়ার পরও হিজবুল্লাহর খুব বেশি ক্ষতি করা সম্ভব হয়নি। এ নিয়ে দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু উত্তরাঞ্চলের মিউনিসিপালটির প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ইসরায়েলের এই অঞ্চল পরিণত হয়েছে একেবারে ভুতুড়ে নগরীতে। যুদ্ধের কারণে এখনকার ৬০ হাজার নাগরিককে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল দক্ষিণে।
দেশটির ওয়াইনেট নিউজ ওয়েবসাইট প্রতিবেদন করেছে, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এটা কোনো বৈঠক ছিল না। এটা পরিণত হয়েছিল চিৎকার আর হট্টগোলের একটা ম্যাচ। অনেক কর্মকর্তারা হতাশা ব্যক্ত করে জানান, শত্রুদের জন্য খুশির বন্দোবস্ত করা হয়েছে। কিন্তু এখনকার নাগরিকদের তাদের বাড়িতে ফিরিয়ে আনার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।
সীমান্তবর্তী এলাকার মেয়র কিরিয়াট শমোনা জানান, যুদ্ধ বিরতির বাস্তবায়ন নিয়ে তার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এজন্য দক্ষিণ লেবাননে বাফার জোন প্রতিষ্ঠার দাবি করেন তিনি। ইসরায়েলি এক টিভি চ্যানেল ১২ যুদ্ধবিরতি নিয়ে একটি জরিপ চালায়। এতে জরিপে অংশে নেওয়াদের মধ্যে অর্ধেক অংশগ্রহণকারীর বিশ্বাস, হিজবুল্লাহ পরাজিত হয়নি। আর ৩০ শতাংশ মনে করে, যুদ্ধবিরতি ব্যর্থ হবে।
এর আগে ২০০৬ সালে লেবানন ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি করতে নিরাপত্তা পরিষদে ১৭০১ নামে প্রস্তাব পাশ হয়েছিল। এবার সেপ্টেম্বর মাসে ওই প্রস্তাব অনুযায়ী এবারও ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতির প্রস্তুতি নেয় আলোচকরা। তাতে হিজল্লাহ এবং সশস্ত্র বাহিনীগুলো সীমন্ত থেকে সরে যাবে। সেখানে দায়িত্ব নেবে শান্তিরক্ষীরা। অন্যদিকে পর্যায়ক্রমে সরে যাবে ইসরায়েলি সেনাও। ২০০৬ সালে যুদ্ধ থামলেও এসবের কিছুই হয়নি।
বরং নেতানিয়াহু হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসারুল্লাহকে হত্যার অনুমতি দেন। তার ব্যক্তিগত ফটোগ্রাফারের একটা ছবিতে এই বিষয়টি উঠে এসেছে। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকে আবারো বৃদ্ধাঙ্গলি দেখানো হয়। এই হত্যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এতে ফুঁসে উঠে হিজবুল্লাহ। সুযোগ কাজে লাগিয়ে ইসরায়েলি বাহিনী ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে হিজবুল্লাহর। এরপরও সংগঠনের সশস্ত্র যোদ্ধারা সীমান্তে প্রতিরোধ গড়ছে হামলাকারী সেনাদের বিরুদ্ধে। অবশ্য এটা এখন স্পষ্ট হয়ে গেছে, হিজবুল্লাহ এখন আর ইসরায়েলের জন্য বড় হুমকি নয়।

যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর বাড়িতে ফেরা এক শিশুর হাতে মৃত হাসান নাসারুল্লাহর ছবি। সূত্র: বিবিসি
যুদ্ধ থামানোর মাধ্যমে অবস্থান শক্ত করলেন নেতানিয়াহু
লেবাননে ইসরায়েলি বাহিনীর সাফল্য দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর হারানো অবস্থান দৃঢ় করতে বড় ভূমিকা রেখেছে। কারণ তার সময়টা ভালো যাচ্ছিল না। তবে এই যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে নিজের অবস্থানকে পুনপ্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। কারণ ইসলাইলের কাছে যতটা গুরুত্বপূর্ণ গাজা এবং দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূখন্ড, লেবনান ততটা নয়।
মূলত এই হামলার মাধ্যমে হিজবুল্লাহকে উত্তরাঞ্চলের সীমান্ত থেকে হটিয়ে নিজ দেশের নাগরিকদের ঘরে ফেরার ব্যবস্থা করাই ছিল মূল লক্ষ্য। ঘরে-বাইরে চাপে থাকা নেতানিয়াহু এমন সুযোগই খোঁজ ছিলেন। যা তিনি হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে অর্জন করেছেন। এজন্য সীমান্ত থেকে হিজবুল্লাহকে হটানোর সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে রাজি হয়ে যায় যুদ্ধবাজ এই প্রধানমন্ত্রী। এরপরও যদি আবার হিজবুল্লাহ হামলা করে তবে তারা যুক্তরাষ্ট্রের অনুমতি নিয়েই সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে।
কেন ইরানও রাজি হয় এই যুদ্ধবিরতিতে
লেবাননের মতো হিজবুল্লাহর প্রধান পৃষ্ঠপোষক ইরানও এই যুদ্ধবিরতি সমর্থন করে। কারণ হিজবুল্লাহর দরকার ছিল বড় আঘাতের পর একটা বিরতির। আর ইরানের প্রয়োজন ছিল ভূরাজনৈতিক যুদ্ধ থামানোর কৌশল। কারণ ইরানী জোট বা প্রক্সিরাও থামাতে পারছিল না ইসরাইলকে। এ ছাড়া হাসান নাসারুল্লাহর হত্যার প্রতিশোধ নিতে তেলআবিবে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পরও ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা যায়নি। বরং হিজবুল্লাহর সুড়ঙ্গ, অস্ত্রাগার এবং গুরুত্বপূর্ণ বহু শীর্ষ নেতাকে হত্যা করে ইসরাইল। তাই ক্ষয়ক্ষতি কমাতে ২০ বছর আগে ইসরায়েলের মতো অনিচ্ছাও সত্ত্বেও চুক্তির পক্ষে যায় ইরান।
ট্রাম্প, গাজা এবং ভবিষ্যৎ
লেবাননের যুদ্ধবিরতি গাজার ক্ষেত্রে তেমন প্রভাব ফেলবে না। কারণ গাজা একেবারে আলাদা। গাজা যুদ্ধের সঙ্গে ইসরায়েলি নিরাপত্তা এবং জিম্মি উদ্ধার জড়িত। এটা নেতানিয়াহুর জন্য রাজনৈতিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠারও মিশন। এছাড়া তার সরকার ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার স্বপ্ন পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছে। লেবানন যুদ্ধবিরতি একেবারে ভঙ্গুর। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানান, তিনি লেবাননে যুদ্ধবিরতি চান। তবে তার সঠিক পরিকল্পনা সম্পর্কে জানা যায়নি।
শঙ্কা বা প্রত্যাশার মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ অপেক্ষা করছে ট্রাম্পের সঠিক পরিকল্পনার। শতাব্দী ধরে আরব এবং ইহুদিদের মধ্যে চলা সংঘর্ষ থেকে বের হওয়ার পথ খোঁজছে সবাই। প্রত্যেক প্রজন্ম চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার অজুহাতে আবারও শুরু হয়েছে যুদ্ধ। যেখানে ইসরায়েল পুরোপুরি অস্বীকার করে ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব সরকার ও রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার দাবি। তাই লেবাননের যুদ্ধবিরতি হয়তো সাময়িক স্বস্তি, কোনো সমাধান নয়।
লেখক: জেরেমি বোয়েন, সাংবাদিক ও টিভি উপস্থাপক, বিবিসি থেকে অনুদিত।