ইরানে হামলার শুরু থেকে তেহরানের শাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার কথা বলেছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে একই কথা বলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পসহ তাদের বৈশ্বিক মিত্ররা। কিন্তু তাদের এই লক্ষ্য পূরণ কতটা সম্ভব? কী বলছে ইতিহাস?
লেখার শুরুতে একটু পেছনে ফিরে যায়। ১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধের প্রাক্কালে এক টেলিভিশন প্রতিবেদক মার্কিন কমান্ডার নরম্যান শোয়ার্জকফকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তিনি কি ইরাকের সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেবেন?
এই প্রশ্নের জবাবে নরম্যান শোয়ার্জকফ খুব সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়েছিলেন। তবে তা ছিল মনে রাখার মতো। তিনি বলেছিলেন, ‘বলা সহজ, তবে করা কঠিন।’
শোয়ার্জকফ জানতেন তিনি কী বলছেন। মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে তার জানাশোনা ছিল অন্যদের চেয়ে ভালো। শৈশবের কিছু সময় তেহরানে কাটিয়েছিলেন এই মার্কিন কমান্ডার। কুয়েতে সাদ্দামের পরাজয়ে তার অবদান ছিল বেশি। তিনি সেখানকার স্থলযুদ্ধে পুরনো কৌশল ব্যবহার করেছিলেন। কৌশলটি ছিল প্রাচীন কার্থেজীয় সেনাপতি হ্যানিবালের ক্যানাইয়ের যুদ্ধে (খ্রিস্টপূর্ব ২১৬) রোমানদের পরাজয়ের জন্য ব্যবহৃত ঘেরাও কৌশল।
আজ ইরান নিয়ে ‘শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন’ শব্দটি বারবার উচ্চারিত হচ্ছে নেতানিয়াহু, ট্রাম্পসহ তাদের বিশ্ব মিত্রদের মুখে। তবে এই কাজটি মোটেও সহজ নয়! শোয়ার্জকফের ভাষায়—‘বলা সহজ, করা কঠিন’। কারণ তাদের হাতে এমন কোনো সুইচ নেই, যেটি টিপলেই দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন হবে। তাদের মনে রাখতে হবে, ধ্বংস করা আর নতুন করে গড়ে তোলা এক জিনিস নয়।
‘শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তন’ কথাটির আড়ালে দীর্ঘস্থায়ী বিপর্যয় ও দুর্ভোগ লুকিয়ে থাকে। সেই দুর্ভোগ ভোগ করেন একটি দেশের সাধারণ মানুষ, যাদের শাসক হঠাৎ পরিবর্তিত হয়। পশ্চিমা সরকারগুলো ও জনগণ এসব শিক্ষা পেয়েছে চড়া মূল্য দিয়ে। যেমন, ২০০১ সালে আফগানিস্তান আক্রমণ ও ২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধ—এখনও মার্কিন রাজনীতিকে তাড়িয়ে বেড়ায়। ২০১০-১১ সালের ‘আরব বসন্ত’ ছিল সেই একই সরল বিশ্বাসের কফিনে আরেকটি পেরেক।
হয়তো নেতানিয়াহুর সাম্প্রতিক সামরিক অভিযান ইরানের পরমাণু ও সামরিক অবকাঠামোর ওপর গুরুতর ক্ষতি করেছে। তবে ইরান পাল্টা হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের গর্বের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করে ইসরায়েলে আঘাত হেনেছে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র। সুতরাং ইরানকে একেবারে ছোট করে দেখার কোনো কারণ নেই। দেশটি দীর্ঘদিন মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কবলে আছে। তবুও নিজেদের আত্মরক্ষায় যতটুকু করা সম্ভব তা তারা করেছে। যেটা মধ্যপ্রাচ্যের আর কোনো দেশের পক্ষে সম্ভব নয়।
সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ইসরায়েলের হামলায় ইরানে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। নেতানিয়াহু ও ট্রাম্প হয়তো এটাকে সুযোগ ভাবতে পারেন। আর রাজনীতি ও যুদ্ধ উভয় ক্ষেত্রেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করা গুরুত্বপূর্ণ। নতুন জার্মান সাম্রাজ্যের নায়ক বিসমার্ক মনে করতেন, সুযোগ নিতে পারাটা নেতৃত্বের চূড়ান্ত পরীক্ষাগুলোর একটি।
আমরা অনেকেই শেক্সপিয়রের জুলিয়াস সিজার নাটক দেখেছি। সেখানে ক্যাসিয়াস বলেন, ‘মানুষের জীবনের স্রোতে এক সময় আসে জোয়ার, যা ধরতে পারলে আসে সৌভাগ্য।’
নেতানিয়াহু ও ট্রাম্প হয়তো ভাবছেন তাদের সামনে এখন সেই সৌভাগ্য। কিন্তু এ কথা মনে রাখতে হবে, ক্যাসিয়াসের শেষ পরিণতি কী হয়েছিল। তিনি হেরে গিয়েছিলেন।
ইরানে শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন হলে সবচেয়ে সুবিধা হবে ইসরায়েলের। মধ্যপ্রাচ্যে তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার মতো আর কেউ থাকবে না। তবে রাশিয়ার জন্য খারাপ খবর হবে। কারণ তারা ইউক্রেন যুদ্ধে ইরানি ড্রোনসহ বিপুল পরিমাণ যুদ্ধসামগ্রী ব্যবহার করছে।
অন্যদিকে, শাসন ব্যবস্থা ধ্বংস মানেই সফলভাবে শাসন পরিবর্তন নয়। হতে পারে, ইসরায়েল (ট্রাম্পের সামরিক সহায়তা থাকুক বা না থাকুক) ইরানে এমন ক্ষতি করবে যে, সরকার কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়বে। কিন্তু তারপর কী হবে? ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্র কেউই ইরান দখল করে পরিচালনা করতে চায় না। যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চয়ই আফগানিস্তান, ইরাক ও লিবিয়ার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা ভুলে যায়নি। তাদের এটাও ভুলে গেলে চলবে না—এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বার্লিন নয়।
চলতি সপ্তাহে ইরানিদের উদ্দেশ্যে দেওয়া এক ভাষণে নেতানিয়াহু বলেছেন, নতুন ইরান গঠনের দায়িত্ব তাদেরই নিতে হবে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, ‘তাদের’ বলতে কে বা কারা?
ইসরায়েল সমর্থিত কোনো সরকার নিশ্চয়ই সেখানে টিকবে না। যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত এমন কোনো সরকার, যারা ট্রাম্পের সহচরদের ইরান লুটপাট করতে দেবে—তাও সফল হবে না। নেতানিয়াহু দাবি করেছেন, ইরানের ৮০ শতাংশ মানুষ বর্তমান শাসনের বিরোধী। তার কথা মেনে নিলেও এই মুহূর্তে ইরানের বিরোধী শক্তি ছায়ার আড়ালে, সংগঠিত নয়, বিভক্ত।
ইরান পরাজিত হলে দেশটি দুর্বল হয়ে পড়বে। কিন্তু দেশটি এখনো বিশাল ও গুরুত্বপূর্ণ একটি রাষ্ট্র। তারা প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ, বলা যায়— জ্বালানি শক্তির পরাশক্তি এবং এখনও যথেষ্ট সশস্ত্র। তাই ইরানের শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন যতটা সহজে চাওয়া যায়, ততটা সহজে করা যাবে না।
এটাও ভুলে গেলে চলবে না, ইরান এখনো একটি বিপ্লবী শাসনব্যবস্থা। তারা সবকিছু পাল্টে ১৯৭৯ সালে ক্ষমতায় এসেছিল। তারা সাধারণত অতিরিক্ত সন্দেহপ্রবণ, সহজে হাল ছেড়ে দেয় না। আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির সাম্প্রতিক ভাষণগুলোতেও সেটা স্পষ্ট হয়েছে। তাই ইসরায়েলের এই হামলায় হয়তো ইরানের ইসলামি প্রজাতন্ত্র দুর্বল হবে। তবে পুরোপুরি নতুন কিছু গঠন করা সহজ হবে না।
ইতিহাস বলছে, বিপ্লবী শাসন ব্যবস্থার পতন সাধারণত বিশৃঙ্খলভাবে হয়। যাদের সরানো কঠিন ছিল তাদের সরানো হয়। কিন্তু যারা তাদের জায়গা নেয়, তাদের কাজ আরও কঠিন হয়ে পড়ে। ভাবুন, ১৮১৫ সালের ফ্রান্স, ১৯৯১ সালের রাশিয়ার কথা।
জার্মানিকে নাৎসিবাদের ভয়াবহতা থেকে মুক্ত করতে ঐক্যবদ্ধ আন্তর্জাতিক কৌশল, মার্কিন অর্থসাহায্য, সামরিক দখল ও জার্মান প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বাস্তবধর্মী সমঝোতার দরকার হয়েছিল। ফল ছিল সম্মিলিত জয়। কিন্তু এটি ছিল ইতিহাসের ব্যতিক্রমী ঘটনা।
তবে ইরানের ক্ষেত্রে এমন কিছু ঘটার সম্ভাবনা হয়তো নেই। তাই সেখানকার শাসব ব্যবস্থা পরিবর্তনের কথা বলা যতটা সহজ, করাটা ঠিক ততটাই কঠিন হবে।
সূত্র : পলিটিকো, সিএনএন, ডিপ্লোম্যাট, নিউইয়র্কার