সালাদ-এই একটি শব্দে অনেকের চোখে ভেসে ওঠে এক বাটি তাজা রঙিন শাকসবজি আর স্বাস্থ্যসচেতনতার ছাপ। কিন্তু সালাদের ইতিহাস, গুরুত্ব ও জনপ্রিয়তা শুধু আধুনিক স্বাস্থ্যচর্চা বা ডায়েটের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়। বরং এর রয়েছে বহু শতাব্দীর ঐতিহ্য, নানা সংস্কৃতিতে প্রসার ও স্বাদের বৈচিত্র্য।
‘সালাদ’ শব্দটি এসেছে ল্যাটিন ‘sal’ অর্থাৎ ‘লবণ’ থেকে। প্রাচীন রোমানরা শাকসবজিতে লবণ, ভিনেগার ও তেল মিশিয়ে এক ধরনের ঠান্ডা খাবার তৈরি করত, যাকে তখন ‘herba salata’ বা ‘লবণযুক্ত শাক’ বলা হতো। মধ্যযুগেও ইউরোপে সালাদ খাওয়া হতো, তবে সেটা ছিল উচ্চবিত্তের খাদ্যতালিকায় সীমাবদ্ধ। রেনেসাঁ যুগে এসে সালাদে বৈচিত্র্য দেখা যায়-শুধু শাকসবজি নয়, যোগ হয় ফল, চিজ, বাদাম ও তেলজাতীয় উপাদান।
সম্প্রতি সিএনএন ট্র্যাভেল বিশ্বের সেরা ২৪টি সালাদের তালিকা প্রকাশ করেছে। চলুন সেই তালিকা থেকে বৈচিত্র্যময় ও কিছুটা স্বল্প পরিচিত ১০টি সালাদ সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক-
পাঞ্জানেল্লা সালাদ (ইতালি)
পাঞ্জানেল্লা শব্দটি এসেছে দুটি শব্দ থেকে- ‘পান’ অর্থাৎ রুটি এবং ‘জানেল্লা’ অর্থাৎ গভীর থালা বা বাটি। পাঞ্জানেল্লা সালাদ একটি ঐতিহ্যবাহী ইতালিয়ান সালাদ, যার মূল পরিচয় টাস্কানি ও উমব্রিয়া অঞ্চলে এর শিকড় গভীরভাবে গাঁথা, যেখানে কৃষক অতিরিক্ত বা শুকিয়ে যাওয়া রুটি ফেলে না দিয়ে তাজা সবজির সঙ্গে মিশিয়ে এই সালাদ তৈরি করতেন।

পুরনো রুটি দিয়ে তৈরি পাঞ্জানেল্লা সালাদ, ছবি : লাভ এন্ড লেমনস
১৬শ শতকের টাস্কানের বিখ্যাত কবি ব্রনজিনো পাঞ্জানেল্লার একটি সংস্করণের কথা তার কবিতায় উল্লেখ করেছিলেন। প্রাথমিকভাবে এতে কেবল রুটি ও পেঁয়াজ থাকত, পরে যোগ হয় টমেটো ও অন্যান্য মৌসুমি সবজি। এই সালাদ ছিল এক প্রকার ‘নো ওয়েস্ট’ রান্নার নমুনা—যেখানে শুকিয়ে যাওয়া রুটিকে নতুন জীবন দেওয়া হতো সতেজ সবজি ও ভিনেগার-অলিভ অয়েল ড্রেসিংয়ের মাধ্যমে।
নারাঙ্গি সালাদ (ভারত)
নারাঙ্গি’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘নারঙ্গ’ থেকে, যার অর্থ হলো কমলা বা সিট্রাস জাতীয় ফল। ভারতে কমলা বা কমলা রঙ বোঝাতে নারাঙ্গি শব্দটি ব্যবহৃত হয়। নারাঙ্গি সালাদ মূলত কমলার মতো এক ধরনের তাজা ও রঙিন ফল-সবজি দিয়ে তৈরি সালাদ, যা বিশেষ করে উত্তর ভারত, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানের হোটেল; আধুনিক রেস্টুরেন্টে পরিবেশিত হয়। এটি যেমন স্বাস্থ্যকর, তেমনি দেখতে দৃষ্টিনন্দন ও মুখরোচক।

উত্তর ভারত, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানের হোটেল ,আধুনিক রেস্টুরেন্টে পরিবেশিত সালাদ, ছবি: পন্ডিচেরি
মেচুইয়া (তিউনেসিয়া)
মেচুইয়া শব্দটি আরবি থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘গ্রিল করা’ বা ‘আগুনে পুড়িয়ে তৈরি’। মেচুইয়া সালাদ হলো তিউনিসিয়ার জনপ্রিয় সালাদ, যা ধোঁয়াটে স্বাদে ভরা; সাধারণত গ্রিল করা টমেটো, মরিচ, পেঁয়াজ ও রসুন দিয়ে তৈরি হয়। উপরে ডিম ও অলিভ দিয়ে সাজিয়ে পরিবেশন করা হয়। এটি গ্রীষ্মকালীন সালাদ হলেও অনেক সময় ঐতিহাসিক আরব নাস্তার প্ল্যাটার ‘মেজ্জে’ বা রমজানের ইফতার টেবিলেও পরিবেশন করা হয়।

তিউনেসিয়ান মেচুইয়া দেখতে অনেকটা আমাদের দেশের ভর্তার মতো, ছবি : ফ্রাসোঁয়া ল্যামবার্ট ডট ওয়ান
সোম তাম (থাইল্যান্ড)
সোম তাম হলো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় সালাদগুলোর একটি। এটি মূলত কাঁচা সবুজ পেঁপে, লেবুর রস, মাছের ঝোল, চিনি ও চিলির এক ঝাঁঝালো, টক-মিষ্টির দারুণ সুগন্ধিযুক্ত সালাদ। থাইল্যান্ডের রাস্তার খাবারের তালিকায় এটি অনন্য, যা বিশ্বজুড়ে এখন ‘থাই গ্রিন পাপায়া সালাদ’ নামে পরিচিত।
লাহপেট থক (মিয়ানমার)
বার্মিজ ভাষায় ‘লাহপেট’ মানে আঁচে ফার্মেন্টেড বা ম্যারিনেট করা চায়ের পাতা, আর ‘থক’ মানে সালাদ। এটি মিয়ানমারের ঐতিহ্যবাহী ও আইকনিক সালাদ, যেখানে মূল উপাদান হলো চায়ের পাতা। বিশ্বে খুব কম দেশেই চা শুধু পান করা নয়, খাওয়ার জন্য ব্যবহার হয়, আর মিয়ানমার সেই বিরল উদাহরণগুলোর একটি। এতে আরও থাকে ভাঁজা চিনাবাদাম, তিল, শুকনা চিংড়ি, ভাঁজা শিম, বাঁধাকপি। এদের সঙ্গে মেশানো হয় ফিশ সস ও লেবুর সালাদ ড্রেসিং।

বার্মিজ চা পাতার সালাদ, ছবি : ভিয়েত ওয়ার্ল্ড কিচেন
শপস্কা (বুলগেরিয়া)
শপস্কা সালাদ হলো বুলগেরিয়ার এক ঐতিহ্যবাহী, অত্যন্ত জনপ্রিয় ও জাতীয়ভাবে সমাদৃত সালাদ; যা মূলত গ্রীষ্মকালে পরিবেশন করা হয়। এটি খুব সহজ উপাদানে তৈরি হলেও স্বাদে অনন্য। শপস্কা সালাদকে অনেকেই বুলগেরিয়ার ‘কালার থ্রি’ অর্থাৎ জাতীয় পতাকার রঙ (সবুজ, সাদা, লাল)–এর প্রতিফলন বলেই মনে করেন।
হরিয়াতিকি (গ্রিস)
হরিয়াতিকি সালাদ হলো গ্রিসের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যবাহী সালাদ, যা সাধারণত আমরা ‘গ্রিক সালাদ’ নামে চিনি। এটি একেবারেই সরল উপাদানে তৈরি—কাঁচা টমেটো, শসা, পেঁয়াজ, জলপাই, ফেটা চিজ ও অলিভ অয়েল দিয়ে সাজানো এক সতেজ, পুষ্টিকর ও স্বাদে পরিপূর্ণ খাবার। গ্রিকদের প্রতিদিন দুপুরে বা রাতের খাবারে এটি থাকবেই, বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে।

হরিয়াতিকি ওরফে গ্রিক সালাদ, ছবি : সিরিয়াস ইটস
সুনোমোনো (জাপান)
সুনোমোনো হলো জাপানের ঐতিহ্যবাহী একটি হালকা ও সতেজ ভিনেগারমিশ্রিত সালাদ। সাধারণত এটি শসা, সামুদ্রিক খাবার (যেমন অক্টোপাস বা ক্র্যাব), ও সীউইড বা সামুদ্রিক শ্যাওলা দিয়ে তৈরি করা হয়। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো টক-মিষ্টি স্বাদযুক্ত। এটি সাধারণত ছোট পরিমাণে অ্যাপেটাইজার বা সাইড ডিশ হিসেবে পরিবেশন করা হয়।

জাপানিজ শসার সালাদ ‘সুনোমোনো’’, ছবি : জাস্ট ওয়ান কুকবুক
গাদো গাদো (ইন্দোনেশিয়া)
গাদো গাদো হলো ইন্দোনেশিয়ার এক ধরনের উষ্ণ বা ঠান্ডা সবজি সালাদ, যা ভিন্ন ভিন্ন সিদ্ধ সবজি, ডিম, টেম্পে (সয়াবিন কেক) ও কখনো নুডলস বা রাইস কেকের সঙ্গে বিশেষ ঘন পিনাট সস বা চিনাবাদামের চাটনি দিয়ে পরিবেশন করা হয়। এটি শুধু সালাদ নয়-একটি পূর্ণাঙ্গ, পুষ্টিকর ও ঐতিহ্যবাহী খাবার।
শিরাজি সালাদ (ইরান)
শিরাজি সালাদ ইরানের অন্যতম জনপ্রিয় ফ্রেশ সালাদ, বিশেষ করে গরমকালে খাবারের সঙ্গে এটি শরীর ঠান্ডা রাখে। সাধারণত এটি গ্রিলড মাংস বা ভারি ইরানি খাবারের সঙ্গে পরিবেশন করা হয়। এই সালাদের জন্ম ইরানের শিরাজ শহরে। এটি সাধারণত তাজা টমেটো, শসা, পেঁয়াজ, লেবুর রস ও শুকনো পুদিনা পাতার সংমিশ্রণে তৈরি হয়। এ সালাদ স্বাদে খুবই হালকা, টক-মিষ্টি ও সতেজ।