Home বিশ্ব আকাশের ভূত : বি-২ বোমারু বিমান

আকাশের ভূত : বি-২ বোমারু বিমান

৫৪ views

ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় নিখুঁতভাবে হামলা করে আবারও আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের বি-২ বোমারু বিমান। তেহরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে এটি। হামলার পর সারা বিশ্বে এ মুহূর্তে আলোচনার কেন্দ্র রয়েছে মার্কিন এই বিমানটি। দেশটির মিজৌরি অঙ্গরাজ্যের ঘাঁটি থেকে উড়ে এসে হামলা চালায় বি-২ বিমান।

যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি বি-২ স্পিরিট (স্টেল্থ বোম্বার) একটি উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন কৌশলগত বোমারু বিমান; যা আকাশের ছায়া যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত। অত্যাধুনিক স্টেল্থ প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে এটিকে রাডারের মাধ্যমে শনাক্ত করা অসম্ভব। শত্রুপক্ষের প্রতিরক্ষা ভেদ করে গভীর লক্ষ্যবস্তুর ওপর আঘাত হানতে সক্ষম এই বোমারু বিমান।

আকাশের ভূত নামে পরিচিত এই বোমারু বিমানের দৈর্ঘ্য ২১ মিটার (৬৯ ফুট) এবং প্রস্থ ৫২.৪ মিটার (১৭২ ফুট)। এ ছাড়া এটির উচ্চতা ৫.১ মিটার (১৬.৮ ফুট)। এর ওজন প্রায় ৭১,৭০০ কেজি ও সর্বোচ্চ টেক-অফ ওজন প্রায় ১৭১,০০০ কেজি । আর গতিবেগ ১০১০ কিমি/ঘণ্টা (৬২৮ মাইল/ঘণ্টা) এবং রেঞ্জ (দূরত্ব) প্রায় ১১,১০০ কিমি। এ ছাড়া এর ক্রু সদস্য ২ জন (পাইলট ও কো-পাইলট)।

বোমারু বিমান

বার্কসডেল বিমান বাহিনী ঘাঁটিতে ফ্লাই করছে বি-১ ল্যান্সার, ছবি : সিএনএন

বহুল আলোচিত এই বিমানটি নির্মাণ করেছেন নরথ্রপ গ্রামেন। এটি শুধু প্রযুক্তির দিক থেকেই নয়, দামেও শীর্ষে। যার প্রতি ইউনিটের মূল্য ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি। মূলত পরমাণু হামলা চালানোর ক্ষমতা অর্জনের উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয় এই বোম্বারটি।

বি-২ বিমান প্রসঙ্গে প্রযুক্তি বিশ্লেষক রেবেকা গ্রান্ট বলেন,  ‘এটি সত্যিই একক ও অসাধারণ যুদ্ধ বিমান। যা ককপিট থেকে দেখলে মনে হয় যেন এক জীবন্ত সত্ত্বা। অনেকে বলে এর একটি নিজস্ব ব্যক্তিত্ব বা সত্ত্বা রয়েছে। তাই তারা বিমানের নামের সাথে ‘সে’ শব্দটি ব্যবহার করে।

১৯৮০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে চলমান স্নায়ুযুদ্ধ সময়কালে বি-২ স্পিরিট তৈরি করা হয়। এর মূল লক্ষ্য ছিল পারমাণবিক বোমা বহন করে রাডারে ধরা না পড়ে সোভিয়েত বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় আঘাত হানা। তবে ১৯৮৯ সালে এর প্রথম ফ্লাইটের কিছুদিন পরেই বার্লিন প্রাচীর ভেঙে পড়ায় স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটে এবং আজও রাশিয়ার আকাশে এই বিমানটি প্রবেশ করেনি।

যুদ্ধ বিমান

কেসি-১৩৫ স্ট্র্যাটোট্যাঙ্কার থেকে জ্বালানি গ্রহণ করছে একটি বি-২ স্পিরিট স্টিলথ বোমারু বিমান, ছবি : সিএনএন

সেই সময়কালে যদিও বি-২ স্পিরিট রাশিয়ায় প্রবেশ করেনি। তবে কয়েকটি যুদ্ধে অংশ নিয়েছে এটি। যার মধ্যে প্রথমটি মোতায়েন করা হয় ১৯৯৩ সালে মিজৌরির হোয়াইটম্যান এয়ারফোর্স ঘাঁটিতে। এটির প্রথম অপারেশনাল মিশন ছিল ১৯৯৯ সালের কোসোভো যুদ্ধ।

বি-২ এমন একটি যুদ্ধ বিমান যা পৃথিবীর যেকোনো স্থানে পৌঁছে আবার ঘাঁটিতে ফিরে আসতে পারে। এ ছাড়া মাঝপথে আকাশেই জ্বালানি ভরার সক্ষমতা রয়েছে এই বিমানের।

এই যুদ্ধ বিমানটির ডিজাইনের ধারণা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়নে দেখা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে নাৎসি জার্মানি ‘হরটেন হ ২২৯’ নামে এক ফ্লাইং উইং বিমানের পরীক্ষা চালায়, যার সঙ্গে বি-২ এর মিল রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রে এই বিমানটি নির্মাণের পেছনে অন্যতম পথপ্রদর্শক ছিলেন নরথ্রপ গ্রামেন। যিনি ১৯৪০ সালে ছোট স্কেলে ফ্লাইং উইং এবং ১৯৪৭ সালে ‘ওয়াইবি‑৪৯’ নামে জেট চালিত ফ্লাইং উইং তৈরি করেন। যদিও তা বাতিল হয়ে যায়, সেই গবেষণাই পরবর্তীতে বি-২ স্পিরিট তৈরির ভিত্তি হয়।

এই বিমানটি বর্তমানে মার্কিন বিমানবাহিনীর ৩টি কৌশলগত বোমারুর একটি এবং অন্য দুটি হলো ১৯৭৪ সালের বি-১ লেন্সার এবং ১৯৫০ এর দশকের বোইয়িং বি-৫২ স্ট্র্যাটোফোরট্রেস।

USb

যুক্তরাষ্ট্রের বি টু বোমারু বিমান, ছবি : আরব নিউজ

এদিকে বি-৫২ আকাশে উচ্চতায় উড়তো এবং বি‑১ নিচে ও দ্রুত উড়ে রাডারকে ফাঁকি দিতে পারত। তবে এদের কোনো কৌশলই একদম নিখুঁত ছিল না। তাই প্রয়োজন হয় এমন এক বিমান তৈরি করার যা পারমাণবিক অস্ত্র বহন করতে সক্ষম এবং রাডারে একেবারেই শনাক্ত করা কঠিন।

এই স্বপ্ন পূরণ হয় ১৯৭০ এর দশকে ‘স্টিলথ’ প্রযুক্তির মাধ্যমে, যা বিমানের রাডারে ধরা পড়ার সম্ভাবনা একেবারে কমিয়ে দেয়। এই প্রসঙ্গে গ্রান্ট বলেন, ‘বি-২ একটি স্নায়ুযুদ্ধের ফসল তবে এর পেছনে বড় প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ছিল, যা একটি সম্পূর্ণ স্টিলথ বিমান ডিজাইন। বি-২ এর গঠন এমনভাবে তৈরি যাতে রাডার ওয়েভ প্রতিফলিত না হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।’

এ ছাড়া বিমানে কোনো লম্বা অংশ নেই। যেমন লেজ বা পাখা, যা রাডার ওয়েভকে ফিরিয়ে দিতে পারে। এর পৃষ্ঠ এত মসৃণ যে, রাডারে এটি একটি পাখির মতো ক্ষুদ্র বস্তু মনে হয়। ইঞ্জিনগুলো বিমানের পেছনে লুকানো, যাতে সেগুলোর তাপ শনাক্ত করা না যায়। রহস্য়ময় এই বিমানটি স্পেস শাটলের মতো হিট-অ্যাবজর্বিং টাইল ব্যবহার করা হয়েছে ইঞ্জিন এক্সহস্টে।

বোমারু বিমান 1

১৯৫০ সালের একটি ওয়াইবি-৪৯ প্রোটোটাইপ বিমান, ছবি : সিএনএন

এ ছাড়া এই বিমানে যখন বাষ্পীয় রেখা তৈরি হয় তখন পাইলটরা উচ্চতা পরিবর্তন করতে পারেন। এটি এতটাই স্থিরভাবে উড়ে যে শুনতে পাওয়া যায় শুধু তখনই, যখন এটি মাথার উপর দিয়ে চলে যায়।

এর সব স্টিলথ ফিচার সবসময় চালু থাকে না। যখন শত্রুপক্ষের ঘনিষ্ঠতায় আসে, তখন ককপিটের পেন বোতাম চাপলেই স্টিলথ ফিচার সক্রিয় হয়। গ্রান্ট এই প্রসঙ্গে আবারও বলেন, ‘এটা সাধারণ যুদ্ধপ্রস্তুতিরই অংশ। শত্রু এলাকায় প্রবেশের আগে পাইলটরা কিছু নির্দিষ্ট পদ্ধতি মেনে চলে—যা সম্পূর্ণ গোপন, তবে এটা সত্যি যে তারা ‘স্টিলথ মোডে’ যায়।’

২০০১ সালে আফগানিস্তানে একটি মিশনে এটি টানা ৪৪ ঘণ্টা চলে—যেখানে মাঝ আকাশে জ্বালানি ভরে মিশন সম্পন্ন করা হয়। তাই ককপিটের পেছনে বিশ্রামস্থান, খাবার গরম করার ব্যবস্থা ও শৌচাগার রয়েছে।

এটি যুদ্ধক্ষেত্রে কখনো হারেনি, তবে ২০০৮ সালে গুয়ামে এক দুর্ঘটনায় পাইলটরা বেরিয়ে যান। এ ছাড়া ২০১০ সালে এটি আরেকটি অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং পরবর্তীতে এটি পুনরায় মেরামত করে চালু করা হয়।

সূত্র : সিএনএন ও ব্রিটাটিকা

আরও যা পড়তে পারেন

কমেন্ট করুন