Home বিনোদন অনন্য ও অমলিন  অড্রে

অনন্য ও অমলিন  অড্রে

ফাহমিদা বৃষ্টি
৯৩ views

ভুবনমোহিনী সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি তিনি। তাঁর অভিনয় প্রতিভা আর সৌন্দর্যে মুগ্ধ বিশ্বের অসংখ্য সিনেমা অনুরাগী মানুষ। বলছি অড্রে হেপবার্নের কথা। তিনি কেবল একজন নামকরা সুন্দরী ও মেধাবী অভিনেত্রীই ছিলেন না, তাঁকে শতাব্দীর অন্যতম সেরা স্টাইল আইকনও বলা হয়। এছাড়া তিনি বিখ্যাত তাঁর মানবহিতৈষী কর্মকাণ্ডের জন্য। 

১৯২৯ সালের ৪ মে বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে এক সম্ভান্ত্র পরিবারে জন্ম অড্রে হেপবার্নের। পুরো নাম অড্রে ক্যাথলিন রাস্টন হেপবার্ন। বাবা ছিলেন ব্রিটিশ ব্যাংকার আর মা ডাচ জমিদার পরিবারের মেয়ে। মা বাবার আদরে শৈশবে ভালোই দিন কাটছিল তাঁর। কিন্তু সেই সুখ বেশিদিন টেকেনি কপালে। তাঁর বাবা ছিলেন ফ্যাসিস্ট অনুসারি। ফ্যাসিস্ট কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পরিবার ছাড়েন তিনি। অড্রের বয়স যখন ১০ বছর তখন তাঁর মা-বাবার আনুষ্ঠানিক বিচ্ছেদ হয়। এরপরই বেজে ওঠে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা। নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে অড্রের মা তাঁকে নেদারল্যান্ডে নিজের পৈতৃক বাড়িতে নিয়ে আসেন। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যে দেশটি জার্মান নাৎসি বাহিনীর দখলে চলে যায়। 

unnamed 3
Source: Flickr

সেসময় অড্রে কেবল ব্যালে নাচ শেখা শুরু করেছিলেন। কিন্তু তারপরও সাহসের সাথে নিজের ঐ সামান্য জ্ঞান নিয়ে নেমে পড়েন যুদ্ধের ময়দানে! না, নাচ দিয়ে যুদ্ধ করতে নয়।  ডাচ রেজিস্ট্যান্সের   সাহায্যের জন্য টাকা তুলতে গিয়ে তিনি নাচ করতেন। এছাড়া তাদের হয়ে খবরের কাগজও বিলি করতেন। এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আহত যোদ্ধাদের সেবিকার কাজও করেছেন।  এই সময়ের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে ইহুদিদের,বিশেষ করে শিশুদের দুরাবস্থা তাঁর মনে দাগ কেটে যায়। এজন্য তিনি পরবর্তীতে ইউনিসেফের শুভেচ্ছা দূত হয়ে তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশের শিশুদের জন্য কাজ করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তাঁর পরিবার খাদ্যাভাবে পড়েন। যার জন্য তিনি অল্প বয়সে অপুষ্টির স্বীকার হন। সেই ধকল তিনি বড় হয়েও কাটিয়ে উঠতে পারেননি। 

ছোটবেলা থেকে তাঁর ইচ্ছা ছিল ব্যালে নৃত্যশিল্পী হওয়ার। কিন্তু উচ্চতার জন্য তাঁর সেই স্বপ্নপূরণ হয়নি। এতে অবশ্য লাভ হয়েছে সিনেমা জগতের! অড্রে ব্যালে নাচিয়ে হলে ‘রোমান হলিডে’-এর প্রিন্সেস অ্যান, ‘দ্য নান’স স্টোরি’-এর সিস্টার লুক, ‘ব্রেকফাস্ট অ্যাট টিফানি’স’-এর আমুদে হলি গোলাইটলি কে হতো? এসব চরিত্রে তাঁকে ছাড়া কাকে মানাতো? না, অন্য কাউকে আমরা অড্রের জায়গায় ভাবতে পারি না।

583027

শুরুটা মঞ্চনাটকে। এরপর এক পা দু পা করে কয়েকটা সিনেমায় অভিনয়। এরপর এলো ১৯৫৩ সাল। মুক্তি পেলো শতাব্দীর অন্যতম সেরা রোমান্টিক সিনেমা ‘রোমান হলিডে’। মিষ্টি রাজকন্যা অ্যানের ভূমিকায় অভিনয় করে তাক লাগিয়ে দিলেন সবাইকে। পর্দার বাইরেও হয়ে গেলেন হাজার তরুণের মনের রাজকন্যা! এই ছবিটি ছিলো তাঁর ক্যারিয়ারের ‘ব্রেকথ্রু’। অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে এই ছবিটার জন্যই তিনি জিতে নেন সেরা অভিনেত্রীর অস্কার, বাফটা ও গোল্ডেন গ্লোব পুরষ্কার। এরপর আর অড্রেকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একে একে এলো ‘সাবরিনা’, ‘ব্রেকফাস্ট অ্যাট টিফানি’ স’, ‘ফানি ফেস’, ‘শ্যারেড’, ‘হাউ টু স্টিল আ মিলিয়ন’, ‘মাই ফেয়ার লেডি’ এর মতো বিখ্যাত সব ছবি। অভিনয় দিয়ে তিনি রোমান্টিক ছবিকে এক অন্যমাত্রায় নিয়ে যান। অড্রে স্বল্প সংখ্যক অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে একজন যার ঝুলিতে আছে অস্কার, গোল্ডেন গ্লোব, বাফটা, এমি, টনি, গ্র্যামির অ্যাওয়ার্ডের মতো সেরা সব পুরষ্কার। একজন অভিনেত্রীর জন্য এ এক বিরাট অর্জন। আমেরিকান ফিল্ম ইন্সটিটিউট তাঁকে মার্কিন চলচ্চিত্র ইতিহাসের তৃতীয় সেরা নারী কিংবদন্তীর স্বীকৃতি দিয়েছেন। 

অড্রের স্টাইল পঞ্চাশ ষাটের দশকে যেমন সব মেয়েরা অনুকরণ করতো তেমন আজও করে। এর ভিতর অনেক সেলিব্রেটিও আছেন। এখনও বিশ্বের হাজার হাজার স্টাইলিস্ট, ফ্যাশন ডিজাইনার তাঁর সাজ থেকে অনুপ্রেরণা নেন। অড্রে অনেক স্টাইলিংকে বিখ্যাত করে তুলেছিলেন। যেমন, এলবিডি বা লিটল ব্ল্যাক ড্রেস, ওভারসাইজ সানগ্লাস, ক্রিমসন লিপস্টিক, টার্টলনেক আর স্ট্রাইপড টি-শার্ট, প্লেইন ট্রাউজার ইত্যাদি। সাজ বা পোশাকে অতিরঞ্জন তিনি কখনোই পছন্দ করতেন না। সাধারণ সাজেও যে অসাধারণ থাকা যায় তা আমরা অড্রে দেখে শিখি। তিনি সবসময় বলে এসেছেন, ‘Elegance is the only beauty that never fades’, অর্থাৎ সুরুচিপূর্ণতা একমাত্র সৌন্দর্য যা কখনো ম্লান হয়না।

110216

অড্রে ছিলেন অত্যন্ত হাসিখুশি একজন মানুষ। খুব সহজে নিজের ব্যক্তিত্ব দিয়ে সম্মোহিত করতে পারতেন আশেপাশের মানুষদের। নিজের জীবনে অনেকবার অনেক ঝড়ের সম্মুখীন হয়েছেন। অল্প বয়সে বাবার চলে যাওয়া, যুদ্ধের ভয়াবহতা, দুবার বিবাহবিচ্ছেদ, পাঁচবার গর্ভপাত, নিজের শারীরিক অসুস্থতা-  এর কোনকিছুই তাঁকে টলাতে পারেনি। ভেঙ্গে যে পড়েননি তা নয়। কিন্তু প্রতিবার ফিরে এসেছেন নতুন রূপে, আগের থেকে আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে। বয়স বেড়ে গেলে অভিনয় ছেড়ে নেমে পড়েছিলেন দুস্থ মানুষের কল্যানে। বিশেষ করে শিশুদের প্রতি ছিল তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসা আর টান। অসহায় দরিদ্র শিশুদের সাহায্য করতে ক্যান্সার আক্রান্ত শরীর নিয়ে ইউনিসেফের শুভেচ্ছা দূত হয়ে ঘুরে বেরিয়েছেন আফ্রিকা থেকে এশিয়া। ১৯৮৯ সালের অক্টোবরে এসেছিলেন বাংলাদেশে। ঘুরে দেখেছিলেন এদেশের গ্রামের শিশুদের অবস্থা। বাংলাদেশ সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, ‘১৮ বছর বয়সী এই দেশের অর্থনীতি হয়তো এখনো যুদ্ধ, বন্যা আর দুর্ভিক্ষে জর্জরিত। কিন্তু এদেশের আছে দক্ষ জনশক্তি যারা মেধাবী, কর্মঠ ও পরোপকারী। এটিই বাংলাদেশের বড় সম্পদ।’’

splendid audrey hepburn greyscale zx8ertmasktcgfuj
Source: splendid

তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী, মননশীল মানুষ। ইংরেজি, ফরাসি, ডাচ, স্প্যানিশ, ইতালিয়ান ও জার্মান ভাষায় দক্ষতা ছিল অড্রের। সাহিত্যের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ ভালোবাসা। বইপোকা ও সাহিত্যনুরাগী অড্রের প্রিয় কবি ছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাই তো ১৯৯৩ সালের ২০ জানুয়ারি সুইজারল্যান্ডে তাঁর মৃত্যুবরণ করার খবর শুনে অশ্রুসজল নয়নে টেলিভিশন পর্দার সামনে এসে বিখ্যাত অভিনেতা, অড্রের বন্ধু গ্রেগরি পেক ইংরেজিতে আবৃত্তি করেন কবিগুরুর ‘অনন্ত প্রেম’ কবিতাটি। এটি ছিল অড্রের সবচেয়ে প্রিয় কবিতা। 

সৌন্দর্য, সৌষ্ঠব, লাবণ্যময়তা, বিশুদ্ধতার প্রতিমা অড্রে। তিনি শুধু তাঁর অভিনয় আর স্টাইল নয় ব্যক্তিত্ব দিয়েও আজও মুগ্ধ করে রেখেছেন কোটি কোটি ভক্তদের। হলিউডে তাঁর সমসাময়িক অভিনেত্রীরা যখন যৌনতার জন্য পরিচিত ছিলেন, তখন তিনি হয়ে ওঠেন অভিজাত, রুচিশীল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নারী আইকন। এজন্য অড্রে হয়ে আছেন চির অনন্য ও অমলিন।   

আরও যা পড়তে পারেন

কমেন্ট করুণ