Home বাণিজ্য ইসরায়েল-ইরান সংঘাতের ধাক্কা বিশ্ব অর্থনীতিতে

ইসরায়েল-ইরান সংঘাতের ধাক্কা বিশ্ব অর্থনীতিতে

ইকবাল হোসেন
৩৮ views

ইরান–ইসরায়েল পাল্টাপাল্টি হামলা ঘিরে বিশ্বজুড়ে উত্তেজনা বেড়েছে। এ  যুদ্ধের অর্থনৈতিক প্রভাব ইতিমধ্যেই টের পাওয়া যাচ্ছে। হামলার পরপরই বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম লাফিয়ে বাড়ছে। বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজার থেকে অর্থ তুলে নেওয়ায় দরপতন হয়েছে। বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ বিনিয়োগমাধ্যম সোনার দিকে ঝুঁকে পড়ায় মূল্যবান ধাতুটির দাম তরতর করে বাড়ছে। মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানি বাজার ও বাণিজ্য বিপর্যস্ত হতে শুরু করেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরায়েল-ইরানের মধ্যকার এই সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হলে বিশ্ব অর্থনীতিতে চাপ আরও বাড়বে। মন্দার আশঙ্কা তরান্বিত হবে।  

জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে ৭ শতাংশ
ইসরায়েলের হামলার কারণে ইরান থেকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে বিশ্ববাজারে সর্বশেষ লেনদেনে পণ্যটির দাম ৭ শতাংশের বেশি বেড়ে কয়েক মাসের সর্বোচ্চে পৌঁছেছে। অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক বাজার আদর্শ ব্রেন্টের দাম গত শুক্রবার ব্যারেলে ৫ ডলার ১০ সেন্ট বা প্রায় ৭ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়েছে। প্রতি ব্যারেলের মূল্য স্থির হয়েছে ৭৪ ডলার ৪৬ সেন্টে। এদিন জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলে সর্বোচ্চ ৭৮ ডলার ৫০ সেন্টে পৌঁছেছিল, যা ২৭ জানুয়ারির পর সর্বোচ্চ। মার্কিন বাজার আদর্শ ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েটের (ডব্লিউটিআই) দাম বেড়েছে ৫ ডলার ১০ সেন্ট বা ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। ব্যারেলপ্রতি মূল্য স্থির হয়েছে ৭৩ ডলার ১৫ সেন্টে। পণ্যটির দাম দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ ৭৭ ডলার ৬২ সেন্টে পৌঁছেছিল, যা ২১ জানুয়ারির পর সর্বোচ্চ।

সোনার দাম বাড়ছে
বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকিপূর্ণ শেয়ার ছেড়ে নিরাপদ সম্পদে বিনিয়োগ অব্যাহত রাখার কারণে তরতর করে বাড়ছে সোনার দাম। বিশ্ববাজারে  শনিবার সকালে আউন্সপ্রতি সোনার দাম বেড়েছে ৫৪ দশমিক শূন্য ২ ডলার বা ১ দশমিক ৬০ শতাংশ। ফলে সোনার দাম উঠেছে ৩ হাজার ৪৩৩ দশমিক ৪৭ ডলার। স্পট মার্কেটে সোনার দাম আউন্সপ্রতি ৩ হাজার ৪৩৩ ডলারে উঠেছে। সেই সঙ্গে গোল্ড ফিউচার্সের দাম বেড়ে হয়েছে ৩ হাজার ৪৫২ দশমিক ৮০ ডলার। ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দাম অস্থির থাকতে পারে বলে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের। পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হলে স্পট মার্কেটে সোনার দাম ৩ হাজার ৫০০ ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে।

বিশ্ব শেয়ারবাজারে দরপতন
জ্বালানি তেলের দাম বাড়লেও কমেছে শেয়ারের দাম। যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারের এসএন্ডপি ৫০০  সূচক শুক্রবার সকালের দিকে ১ দশমিক ২ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছে। দিনশেষে শুন্য  দশমিক ৬ শতাংশ কমেছে। ডাও জোন্স ইন্ডাস্ট্রিয়াল এভারেজ ৬১২ পয়েন্ট বা ১ দশমিক ৪ শতাংশ  কমেছে এবং নাসডাক কম্পোজিট শুন্য  দশমিক ৬ শতাংশ কমেছে। এদিন এশিয়া ও ইউরোপের শেয়ারবাজারে নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা যায়। সবচেয়ে বেশি ধাক্কা খায় জার্মানির ডিএএক্স সূচক। 

হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে বিশ্ব বাণিজ্য হুমকিতে পড়বে
ইসরায়েলের হামলার মধ্যে ইরান হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। বৈশ্বিক জ্বালানি পরিবহনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই জলপথ বন্ধ হয়ে গেলে বিশ্ব বাণিজ্যে এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে। বিশেষজ্ঞদের মতে, হরমুজ প্রণালি বন্ধ হয়ে গেলে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের সরবরাহ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। এতে তেলের দাম আকাশচুম্বী হবে এবং বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। এর ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মন্দার ঝুঁকি আরও প্রকট হবে। এই প্রণালি দিয়ে প্রতিদিন ১৮ থেকে ২০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল পরিবাহিত হয়, যা বিশ্বব্যাপী তেলের বাজারের প্রায় ২০ শতাংশ। সৌদি আরব বা কুয়েতের জন্য ওই এলাকা থেকে বের হওয়ার কোনো সহজ বিকল্প পথ নেই। এই প্রণালি দিয়ে  তেল পরিবহন অর্ধেক কমিয়ে দিলে বিশ্বব্যাপী তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ১২০ ডলারের বেশি বেড়ে যাবে—এই প্রভাব খুব দ্রুত বিশ্বের সবার ওপর পড়বে। তেলের দাম বাড়লে বিশ্বজুড়ে আবারও মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে।

বিভিন্ন এয়ারলাইনসের আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বাতিল
পাল্টাপাল্টি হামলার মধ্যে ইসরায়েল ও ইরান নিজেদের আকাশপথ বন্ধ করে দিয়েছে। ইরাক ও জর্ডান একই পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি এয়ারলাইনস বা বিমান পরিচালন সংস্থা ওই অঞ্চলে উড়ান বাতিল করেছে। ইসরায়েলি বিমান সংস্থাগুলো তাদের কিছু উড়োজাহাজ তেল আবিবের বেন গুরিয়ন বিমানবন্দর থেকে সরিয়ে অন্যত্র নিয়ে যাচ্ছে। ফ্লাইট ট্র্যাকিংয়ের তথ্যানুসারে, শুক্রবার সকালে তেল আবিব থেকে বেশ কয়েকটি বিমান উড়াল দেয়। এর মধ্যে কিছু বিমান যাত্রী ছাড়াই সাইপ্রাস ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যায়। 

বাংলাদেশের পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স কুয়েত ও সৌদিআরবে ফ্লাইট পরিচালনায় ইরানের আকাশসীমা ব্যবহার করে। বর্তমান পরিস্থিতিতে অন্য আন্তর্জাতিক ফ্লাইটগুলোর মত ইরানের আকাশসীমা এড়িয়ে চলছে বিমানও।

মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানি বাজার ও বাণিজ্য বিপর্যয়ের শঙ্কা
ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ শুরু হলে মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানি বাজার ও বাণিজ্য বিপর্যস্ত হতে পারে। এর অভিঘাত সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। মধ্যপ্রাচ্য বিশ্বের অন্যতম প্রধান জ্বালানি উৎপাদনকারী অঞ্চল। সেখানেই বিশ্বের বৃহত্তম তেলের মজুত। সৌদি আরব ও ইরাকের পর ইরান এই অঞ্চলের তৃতীয় বৃহত্তম তেল উৎপাদক। আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও দেশটি এখনো চীন ও ভারতকে বিপুল পরিমাণে অপরিশোধিত তেল সরবরাহ করছে।
বার্কলেস ব্যাংকের বিশ্লেষক অমরপ্রীত সিং এক গবেষণায় সতর্ক করেছেন, সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে এই সংঘাত অঞ্চলের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তেল ও গ্যাস উৎপাদন ও জাহাজ নেটওয়ার্কেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।

বিশ্ব অর্থনীতিতে চাপ বাড়বে
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতি ইতিমধ্যে বিশ্ববাণিজ্যকে বিপর্যস্ত করেছে। বিনিয়োগকারীরা হারাচ্ছেন আস্থা। এতে ভোক্তা ব্যয় ও ব্যবসার খরচ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে অর্থনীতির গতি মন্থর হয়ে পড়েছে। ইসরায়েল-ইরানের মধ্যকার এই সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হলে বিশ্ব অর্থনীতিতে চাপ আরও বাড়বে। এফএক্স স্ট্রিটের ২০১৯ সালের এক বিশ্লেষণে বলা হয়, তেলের দাম ১০ শতাংশ বাড়লে পরের এক বছরে ভোক্তা মূল্যস্ফীতি শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। ইরানঘনিষ্ঠ গোষ্ঠী, যেমন লেবাননের হিজবুল্লাহ বা ইয়েমেনের হুতিরা এই সংঘাতে যুক্ত হলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে। এতে আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচল ও পর্যটন খাত কার্যত অচল হয়ে পড়বে।

সূত্র: রয়টার্স, বিবিসি, আল-জাজিরা 

 

আরও যা পড়তে পারেন

কমেন্ট করুণ