Home বিনোদন রাজ কাপুরের রাজত্বে

রাজ কাপুরের রাজত্বে

ফারজানা জামান
১৫৬ views
অনেকেই জানে না, রাজ কাপুরের আসল নাম রনবীর রাজ কাপুর।

১৯২৪ সালে জন্ম হয়েছিল নীল চোখের এক তারকার। তার পূর্ব পুরুষের কেউ সমুদ্রের ওপার থেকে এসেছিলেন কিনা তা জানা নেই বটে। কিন্তু বাবার নীল চোখ নিয়ে তিনি রাজত্ব করেছেন ভারতের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে। তার নাম রাজ কাপুর। এই নীল চোখ বলিউডের এক রহস্যের নামও বটে। বলা হয়, উপমহাদেশীয় ত্বক আর নীল চোখ- প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের এই মিলনে যে কেউ হয়ে যায় আকর্ষণীয়। অনেকটা তারা শঙ্করের লেখা অমর প্রেমকাহিনী সপ্তপদীর নায়িকা রীনা ব্রাউনের মতন। আর সেই নীল চোখের মায়া রাজ কাপুরের পরিবারে একই ভাবে আভিযাত্য বয়ে নিয়ে আসছে। একদম শব্দহীন উপন্যাসের মতন।

১৯৮৮ সালে রাজ কাপুরের প্রয়াণ হলেও নীল চোখ- আভিজাত্য আর বলিউডে রাজকীয় প্রভাব কমে যায়নি এতোটুকুও। এখানেও তো বনেদীয়ানার মুন্সীয়ানা। সেই রাজ কাপুরের গল্পই এবার জন্মের শত বর্ষের পর আজও নতুন এবং জেনে রাখার মতন।

রাজ কাপুরের জন্ম আজকের পাকিস্তানের পেশোয়ারে। বাবা পৃথীরাজ কাপুর, মা রমাস্বামী রমা কাপুর। এবং তার অন্য দুই ভাই শাম্মী কাপুর ও শশি কাপুর- যারা নিজেরাও সুপারস্টার যার যার ক্ষেত্রে।

১৯৩০ দশকের দিকে তাদের পুরো পরিবার ভারতে চলে আসে। আর তখন থেকেই ভারতের রূপালি জগতে রাজত্ব শুরু করে রাজ পরিবার।

মজার ব্যাপার হলো- অনেকেই জানে না, রাজ কাপুরের আসল নাম রনবীর রাজ কাপুর। অর্থ্যাৎ ঋষি কাপুরের ছেলের নামও দাদার মতই। অর্থ্যাৎ রনবীর কাপুর। তার মেয়ে আবার পেয়েছে রাজ কাপুরের চোখ। বর্তমানে কাপুর বংশের যে দুজন রাজ কাপুরের নীল চোখ নিয়ে সবার চোখের মণি হয়েছেন- তারা হলেন রনবীরের মেয়ে রাহা কাপুর ও কারিনা কাপুরের ছোট ছেলে তৈমুর আলী খান।

এ ছাড়াও রণধীর কাপুরের বড় কন্যা তথা আরেক সুপারস্টার কারিশমার চোখের রঙও নীল। সব মিলিয়ে ‘ব্লু ব্লাড’ ও নীল চোখ একই সুত্রে গাঁথা প্রায়। 

এই আভিজাত্য আসলে একই প্রজন্মে তৈরি হয়নি। পৃথ্বীরাজ কাপুরের পর প্রথম যিনি বলিউডের রাজত্ব শুরু করে তিনিই এই রাজ কাপুর। মাত্র ১০ বছর বয়সে তিনি অভিনয় শুরু করেন ১৯৩৫ সালে। সিনেমার নাম ছিল ইনকিলাব। এরপরের বছরগুলো আরও সিনেমায় অভিনয় করেন। ১৯৪৭ সালে বড় ধরনের সুযোগ পান নীল কমল চলচ্চিত্রের মাধ্যমে।

অনেকেই জানেননা, রাজকাপুর অভিনয়ের পাশাপাশি ফিল্মের খুঁটিনাটি কাজ শেখার জন্য সহকারি পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন। বাবা চেয়েছিলেন ছেলে নিজের যোগ্যতায় কিছু করুক। তাই পরিবারের ছায়ার বাইরে তাকে যেতে উৎসাহ দেন। পরিচালক কেদার নাথের সাথে কাজ শুরু করেন। শোনা যায় কাজে ভুলের কারণে একবার তাকে প্রচণ্ড বকা দিয়েছিলেন কেদার নাথ।

এভাবেই শিখতে শিখতে অবশেষে অভিনয়ে নাম লেখালেন রাজ কাপুর। ঐ সময়ের শীর্ষস্থানীয় অভিনেত্রী ছিলেন মধুবালা। আরও ছিলেন নার্গিস, বৈজন্তী মালাসহ তখনকার সুপারস্টার নায়িকারা। তবে দারুণ জুটি হয়ে গেল নার্গিসের সাথে। ‘আওয়ারা’, ‘শ্রী ৪২০’সহ একাধিক সিনেমায় তাদের একসাথে দেখা গেছে।

শুধু পর্দাতে নয়, বাস্তব জীবনেও রাজের মনের রানী ছিলেন নার্গিস। তাকে বিয়ে করার জন্য পাগলপ্রায় হয়ে যান রাজ কাপুর। তখন পরওসান-খ্যাত সুনীল দত্তও নার্গিসের প্রতি অনুরক্ত। নার্গিস বেছে নেন সুনীলকেই। বলিউডে এখনও তাদের বিয়ের গল্প ভেসে বেড়ায় গুজব আকারে। অনেকেই বলেন, নার্গিসও রাজ কাপুরকে ভালোবাসতেন, কিন্তু রাজ তখন বিবাহিত এবং নার্গিস তার স্ত্রীকে ত্যাগ করার পরামর্শ দেন প্রণয়ের আগে। ওদিকে রাজ তার স্ত্রীকে ছাড়তে চাননি। এরপর নার্গিস মাদার ইন্ডিয়া সিনেমার সময় দুই অভিনেতাকেই তার ছেলের চরিত্রে অভিনয় করতে বলেন। এবং শর্ত দেন, যে তার ছেলের ভূমিকায় অভিনয় করবেন, তাকেই তিনি বিয়ে করবেন। প্রেমিক হিসেবে সে যাত্রায় জয়ী হয়ে যান সুনীল দত্ত। আর নিজ স্ত্রীর কাছে ফিরে আসেন রাজ কাপুর।

ব্যক্তিগত জীবনে পিছিয়ে গেলেও কর্মজীবনে ক্রমাগত সামনে এগিয়েছেন রাজ কাপুর। ১৯৪৮ সালে চব্বিশ বছরের যুবক রাজকাপুর আর কে ফিল্মস নামে নিজস্ব স্টুডিও প্রতিষ্ঠিত করেন। যার ব্যানারেই তার ব্যবসাসফল ছবিগুলো নির্মিত হয়। এক একটি সিনেমা বনে যায় এক একটি ইতিহাস। বিতর্কও যে সৃষ্টি করেনি তা নয়। তার ছবিতে খোলামেলা নারীদেহ প্রদর্শনের জন্য আন্দোলন করতে পথে নামেন প্রগতিশীল নারীরা। বিশেষ করে সত্যম শিবম সুন্দরম, প্রেমরোগ ও রাম তেরি গঙ্গা মেইলি হো গেয়ি সিনেমা যথাক্রমে জিনাত আমান, পদ্মিনী কলাপুরি ও মন্দাকিনীর শরীর প্রদর্শন নিয়ে আপত্তি তোলে ভারতীয় নারী সম্প্রদায়। বিশাল বাজেটের ঋষি কাপুরের অভিষেকের সিনেমা মেরা নাম জোকারেও অসম বয়সের প্রেমকে দৃষ্টিকটু বলে সংজ্ঞায়িত করা হয়। পরে অবশ্য ঋষির এই প্রথম সিনেমা ক্লাসিক বলে গণ্য হয়েছে। এদিকে পদ্মিনীর সাথে তার প্রণয়ের সম্পর্কও ছিল বলে দাবী করে বলিউড। রাজ কাপুরকে যৌন হেনস্তার কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছিলেন হেমা মালিনীও। যা পরে ধামাচাড়া পড়ে যায়। প্রেমিক পুরুষ হিসেবে খ্যাত রাজ কাপুর পর্দায় নয় শুধু বাস্তবেও ব্যস্ত রেখেছেন পেইজ থ্রি তথা বিনোদন পাতার সাংবাদিকদের।

তবে সমালোচনার বাইরে তার যে অমর সৃষ্টি, সেগুলো ফেলে দেওয়ার সুযোগ নেই। ডিম্পল কাপাডিয়ার ববি থেকে শুরু করে জেবা বখতিয়ারের হেনা- সবাই তার ছত্রছায়ায়। বাস্তুব জীবনে তোর মিতব্যয়িতা ও কাজের প্রতি নিষ্ঠা বংশপরম্পরায় তার পরিবারের সকলের মাঝে প্রবাহিত হয়েছে। রাম তেরে গঙ্গা মেইলি হো গেয়ি সিনেমার জন্য তিনি আগে গান নির্বাচন করে যেমন তার উপর ভিত্তি করে সিনেমার গল্প লিখেছেন, তেমনেই আবার কাউকে অভিষেক করাবেন বলে সেভাবেই গল্প বানিয়েছেন। দিনের পর দিন স্ক্রিপ্টে মনোযোগ দিয়েছেন, ছেলেমেয়েদের বাসে, ট্রেনে চড়িয়ে জীবনের মানে ‍বুঝিয়েছেন।

সব মিলিয়ে রাজ কাপুর শুধু একজন সুপারস্টার নয়। বলা যেতে পারে জীবনের গাইড বই। যে গাইড বই অনুসরণে চলচ্চিত্রে কাজ করতে চাইলে দক্ষ হওয়া যায়, আবার কিভাবে সফলতায়, ব্যর্থতায়, সমালোচনায়, আলোচনায় থেকেও শুধু কাজটাকেই মুখ্য করে এগিয়ে চলা যায়, সেটিও শেখা যায় নিখুঁতভাবে।

আরও যা পড়তে পারেন

কমেন্ট করুণ