Home মতামত বাংলাদেশের বদ্বীপ পরিকল্পনা: এখনই ভাবার সময়

বাংলাদেশের বদ্বীপ পরিকল্পনা: এখনই ভাবার সময়

ড. সজল চৌধুরী
১৩৬ views

বাংলাদেশ, তার ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে, বিশ্বের বৃহত্তম বদ্বীপ অঞ্চলের একটি অংশ। প্রাকৃতিক এবং মনুষ্য সৃষ্ট কারণে বদ্বীপ অঞ্চলের জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশগত চাপ প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের জন্য একটি টেকসই বদ্বীপ পরিকল্পনা তৈরি করা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। এই পরিকল্পনা নিয়ে ভাবনার সময় এখনই। বাংলাদেশের বদ্বীপ অঞ্চলে প্রধানত তিনটি প্রধান নদীর মোহনার সংযোগস্থলে গঠিত: গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, এবং মেঘনা। এই বদ্বীপ অঞ্চলের দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক, এবং পরিবেশগত জীবনের একটি প্রধান উৎস হিসেবে বিবেচিত। তবে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বদ্বীপ অঞ্চলে বন্যা, নদী ভাঙন, জলসঙ্কট এবং লবণাক্ততার মতো সমস্যা প্রতিনিয়ত দেখা দিচ্ছে। এর ফলে বাংলাদেশের কৃষি, মৎস্য, জীববৈচিত্র্য এবং মানুষের জীবনযাত্রায় মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।

বাংলাদেশের বদ্বীপ পরিকল্পনা একটি বৃহৎ প্রকল্প, যার মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে স্থিতিশীলতা অর্জন করা সম্ভব। তবে, এটি শুধু একটি পরিকল্পনা হিসেবে রয়ে গেলে কোন কাজেই আসবে না। পরিকল্পনাটি কার্যকর করতে হলে আমাদেরকে এখন থেকেই উদ্যোগ নিতে হবে। স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ, সমন্বিত উন্নয়ন, এবং টেকসই ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ (Delta Plan 2100) এমন একটি কৌশলগত পরিকল্পনা, যার লক্ষ্য হলো দেশের দীর্ঘমেয়াদী টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা, পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা, খাদ্য নিরাপত্তা, এবং পরিবেশগত স্থিতিশীলতা রক্ষা করা সম্ভব হবে। তবে, এই পরিকল্পনাটি কার্যকর করতে গেলে কিছু উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।

প্রথমত, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে পরিকল্পনার বাস্তবায়ন অত্যন্ত কঠিন হতে পারে। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে পরিকল্পনার বিভিন্ন পর্যায়ে স্থানীয় জনগণের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। পরিবর্তিত জলবায়ুর সঙ্গে খাপ খাওয়ানো এবং স্থানীয় জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এই সমস্যা সমাধান করা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, ব দ্বীপ পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ অর্থায়ন প্রয়োজন। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে পর্যাপ্ত অর্থায়ন নিশ্চয়তা না থাকলে এই বৃহৎ প্রকল্পের কার্যকর বাস্তবায়ন অসম্ভব হয়ে পড়বে। এ ক্ষেত্রে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন এবং সরকারি ও বেসরকারি খাতের অংশীদারিত্বের গুরুত্ব দিতে হবে। তৃতীয়ত, পরিকল্পনার সফলতা নির্ভর করে সরকারের নীতি এবং পরিচালনার দক্ষতার উপর। বদ্বীপ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, এনজিও, এবং স্থানীয় জনগণের সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। প্রয়োজনীয় দক্ষতা এবং জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও, প্রশাসনিক জটিলতা এবং দুর্নীতি পরিকল্পনার অগ্রগতি বিঘ্ন ঘটাতে পারে।

‘বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০’ পরিবেশ সংরক্ষণ এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করে। বদ্বীপ অঞ্চলে রয়েছে অসংখ্য জলাভূমি, বনভূমি, এবং প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য। তবে মানুষের অসচেতনতা এবং অতিরিক্ত শোষণের কারণে এসব প্রাকৃতিক সম্পদ হ্রাস পাচ্ছে। পরিকল্পনায় পরিবেশ সংরক্ষণ, বনায়ন, এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও পুনরুদ্ধারের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচন এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন ‘বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০’-এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। বদ্বীপ অঞ্চলে বসবাসরত জনগণের একটি বড় অংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে, যারা প্রকৃতির রুদ্ররোষে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরিকল্পনায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবা উন্নয়ন, এবং স্থানীয় জনগণের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

এছাড়া, জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য গবেষণা, প্রযুক্তি উন্নয়ন, এবং স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণের দিকে নজর দেওয়া উচিত। বদ্বীপ পরিকল্পনার উদ্দেশ্য শুধুমাত্র বর্তমান প্রজন্মের সমস্যার সমাধান নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ তৈরি করা। অতএব, এখনই সময় বাংলাদেশের বদ্বীপ পরিকল্পনা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করার এবং এই পরিকল্পনাকে কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার। বদ্বীপ পরিকল্পনা সফল বাস্তবায়ন কেবল দেশের নয়, সমগ্র বিশ্বের জন্য একটি উদাহরণ হতে পারে, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে টেকসই উন্নয়নের প্রতিজ্ঞা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে।

তাছাড়া, এ পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়নের জন্য, প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর সাথে সহযোগিতা এবং সমন্বয় করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলো সাধারণত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে বাঁচতে উন্নত প্রযুক্তি ও কৌশল ব্যবহার করে, যা বাংলাদেশে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। বিশেষত, টেকসই অবকাঠামো, জল ব্যবস্থাপনা, এবং পরিবেশগত পুনরুদ্ধার কার্যক্রমে প্যাসিফিক দেশগুলোর অভিজ্ঞতা বাংলাদেশ ডেলটা প্ল্যান ২১০০-এর অধীনে কার্যকর ভাবে গ্রহণ করা দরকার। এছাড়াও, উভয় অঞ্চলের মধ্যে একটি জ্ঞান বিনিময় প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা উচিত, যা জলবায়ু সহনশীলতা বাড়াতে এবং বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করবে।

সবশেষে, এই পরিকল্পনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো কৃষি ও জলসম্পদ ব্যবস্থাপনা। বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন প্রধানত নির্ভর করে নদীজল এবং মৌসুমি বৃষ্টিপাতের ওপর। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই অঞ্চলে পানি সরবরাহের অনিশ্চয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। পরিকল্পনায় আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির প্রয়োগ, সেচ ব্যবস্থা উন্নয়ন, এবং খরা ও লবণাক্ততা সহনশীল ফসলের প্রচলনের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া, মৎস্য উৎপাদন বাড়ানোর জন্য অভ্যন্তরীণ জলাশয় ব্যবস্থাপনা এবং সামুদ্রিক সম্পদ রক্ষার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। ‘বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০’-এর সফল বাস্তবায়নের জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং স্থানীয় অংশীদারিত্ব অত্যন্ত জরুরি। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়োজন। এ ছাড়া, স্থানীয় জনগণ এবং সংস্থাগুলিকে সম্পৃক্ত করে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা অপরিহার্য।

ড. সজল চৌধুরী

স্থপতি, শিক্ষক (স্থাপত্য বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়) ও
স্থাপত্য পরিবেশ বিষয়ক গবেষক
email: sajal_c@cuet.ac.bd

আরও যা পড়তে পারেন

কমেন্ট করুণ