যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতায় বিশ্বের অনেক দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। ক্রমবর্ধমান খাদ্য মূল্যস্ফীতি বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করছে এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমানকে চরমভাবে প্রভাবিত করেছে। বিশ্বে বর্তমানে সর্বোচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনায়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমলেও চাপে রয়েছে বাংলাদেশ। এ অঞ্চলে দেশগুলোর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে।
ট্রেডিং ইকোনমিক্সের তথ্য ব্যবহার ভিজ্যুয়াল ক্যাপিটালিস্ট বিশ্বে খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে শীর্ষ দেশগুলোর একটি তালিকা করেছে গত সোমবার (১৬ ডিসেম্বর)। সেখানে এসব তথ্য উঠে এসেছে। তালিকা তৈরিতে ২০২৩ ০ও ২৪ সালের সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বর মাসের তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে।
তালিকা অনুযায়ী, বিশ্বে বর্তমানে সর্বোচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতি রয়েছে এমন দেশগুলো হচ্ছে আর্জেন্টিনা ১৮৩ শতাংশ (১ম), ফিলিস্তিন ১১৫ শতাংশ (২য়) , জিম্বাবুয়ে ১০৫ শতাংশ (৩য়) দক্ষিণ সুদান ৯৬ শতাংশ (৪র্থ), তুরস্ক ৪৫ শতাংশ (৫ম), মালাউই ৪৪ শতাংশ (৬ষ্ঠ), নাইজেরিয়া ৩৯ শতাংশ (৭ম), হাইতি ৩৮ শতাংশ (৮ম), অ্যাঙ্গোলা ৩৪ শতাংশ (৯ম) ও মিশর ২৭ শতাংশ (১০ম)।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনার প্রভাব কাটার পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও মধপ্রাচ্যে ইসরাইলের আগ্রাসন শুরু হওয়ার পাশপাশি বিশ্ববাজারে খাদ্য, জ্বালানিসহ পণ্যসামগ্রীর দাম ও জাহাজভাড়া পাওয়ায় এবং সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ায় মূল্যস্ফীতি বাড়ছে।
আর্জেন্টিনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে দক্ষিণ আমেরিকার দেশটি। গত চার মাস ধরে কিছুটা কমলেও, বর্তমানে দেশটির বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতি প্রায় ৩০০ শতাংশ। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ৫০ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে দারিদ্র্যসীমা। চলতি বছর ২ দশমিক ৮ শতাংশ জিডিপি সঙ্কোচনের পূর্বাভাস থাকায় ভয়াবহ আর্থিক মন্দার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে লাতিন আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনা ছিল রীতিমতো ধনী দেশ। কিন্তু পরে ক্রমশই অবস্থা বদলেছে, তীব্র হয়েছে অর্থসংকট। বর্তমানে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে সেই পরিস্থিতি। আগামী বছরের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে দেশটিতে বিশ্বের সর্বোচ্চ ১২০ শতাংশ খাদ্য মূল্যস্ফীতির পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে বাংলাদেশ
সম্প্রতি দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সফলতার মুখ দেখলেও, এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যতিক্রম। বাংলাদেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি শঙ্কার জায়গায় পৌঁছেছে। গত নভেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৩ দশমিক ৮ শতাংশে উঠেছে।
মূল্যস্ফীতির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো উদাহরণ তৈরি করেছে শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান। করোনা পরিস্থিতির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোও চরম চাপের মুখে পড়ে। শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতি ৬০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেলে সে দেশের সরকার প্রধানকে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়। পরে ধাপে ধাপে নীতি পরিবর্তনের মাধ্যমে দেশটির মূল্যস্ফীতি গত বছরের নভেম্বরে দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ২ দশমিক ১ শতাংশ, আগের মাস অক্টোবরেও যা ছিল ঋণাত্মক শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ। চলতি বছরের নভেম্বরে শ্রীলঙ্কায় খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল শূন্য দশমিক ৬০ শতাংশ।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর মধ্যে সাম্প্রতিক সবচেয়ে বেশি অস্বস্তিতে ছিল পাকিস্তানের অর্থনীতি। রাজনৈতিক নানা টানাপড়েনের মধ্যে দেশটির মূল্যস্ফীতিও প্রায় ৩০ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। কিন্তু গত বছরের নভেম্বরে দেশটির মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৯ শতাংশে, অক্টোবরেও দেশটির মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ২ শতাংশ। চলতি বছরের নভেম্বরে পাকিস্তানে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ঋণাত্মক শূন্য দশমিক ২৪ শতাংশ।
দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ ভারতকেও ২০২২ সালের পর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছিল। কিন্তু তারাও কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এনেছে। গত বছরের অক্টোবরে দেশটির মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ২১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সেপ্টেম্বরের ৫ দশমিক ৪৯ শতাংশের তুলনায় যা কিছুটা বেশি। গত নভেম্বরে ভারতে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ।
এ অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর মধ্যে গত অক্টোবরে ভুটানের খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ৪ দশমিক ৬২ শতাংশ। মালদ্বীপে খাদ্য অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৯০ শতাংশে। নেপালে নভেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ১০ শতাংশে। আফগানিস্তানের সর্বশেষ তথ্য মতে গত সেপ্টেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ঋণাত্মক ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ।
বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার নানা চেষ্টা করছে। তারপরও নিয়ন্ত্রণের বাইরেই থাকছে। চলতি অর্থবছর মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে রাখার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। ইতিমধ্যে কয়েকবার নীতি সুদহারও বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাজার নিয়ন্ত্রণে জেলায় জেলায় টাস্কফোর্সও গঠন করা হয়েছে। কিন্তু কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না গড় মূল্যস্ফীতি।
সিপিআই তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশের গড় মূল্যস্ফীতি নভেম্বরে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ, যা আগের মাসেও ছিল ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ। সদ্য শেষ হওয়া মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১৩ দশমিক ৮ শতাংশে ঠেকেছে, অক্টোবরেও যা ছিল ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশ। খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতিও কিছুটা বেড়ে ৯ দশমিক ৩৯ শতাংশে ঠেকেছে। আগের মাস অক্টোবরে এ খাতের মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ।
গ্রাম ও শহর এলাকার বিবেচনায় শহরের তুলনায় গ্রামে গড় মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে। তবে অক্টোবরে গ্রামে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেশি থাকলেও নভেম্বরে এসে এ চিত্র পাল্টে শহর এলাকায় খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। নভেম্বরে গ্রাম এলাকার গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৫৩ শতাংশে, শহর এলাকায় তা আছে ১১ দশমিক ৩৭ শতাংশে। তবে খাদ্য মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে গ্রাম এলাকায় ১৩ দশমিক ৪১ শতাংশে, যেখানে শহর এলাকায় খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ দশমিক ৬৩ শতাংশে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরী হ্যালো বাংলাদেশকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে নীতি সুদহার বাড়িয়ে চাহিদা সংকোচন করা ছাড়া অন্য কোনো হাতিয়ার নেই। কিন্তু এতে কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। বাজার তদারকি করা হলেও পদক্ষেপ হিসেবে সেটিও পর্যাপ্ত নয়। প্রতিনিয়ত অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের দাম বাড়ছে। উৎপাদন ও আমদানিকারক থেকে ভোক্তা পর্যায়ে একটি বড় সরবরাহ চেইন রয়েছে। এখানে কিছু অংশগ্রহণকারী শক্তিশালী সিন্ডিকেট তৈরি করে অতিরিক্ত মুনাফা করছে। তাদের চিহ্নিত করে যথাযথ ব্যবস্থা নিলে মূল্যস্তর সহনীয় করা যাবে। তবে বাজার ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা ও প্রতিযোগিতার সক্ষমতা না বাড়িয়ে শুধু তদারকির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না।