রাসায়নিক সার ছাড়া চাষাবাদ সম্ভব? ছত্রাকের নতুন কৌশলে মিলতে পারে সমাধান। প্রাকৃতিক পরিবেশে উদ্ভিদ ও ছত্রাকের সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরেই বিজ্ঞানীদের আগ্রহের বিষয়। প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন বছর ধরে মাইকোরাইজাল ছত্রাক, উদ্ভিদের শিকড়ের সঙ্গে জটিল মিথোজীবী সম্পর্ক গড়ে তুলেছে, যার মাধ্যমে তারা পুষ্টি বিনিময় করে। এই ছত্রাক মাটির গভীর থেকে পুষ্টি সংগ্রহ করে উদ্ভিদে সরবরাহ করে, যার বিনিময়ে উদ্ভিদ তাদের তৈরি শর্করা ছত্রাককে দেয়।
সম্প্রতি, প্রখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী নেচার-এ প্রকাশিত এক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন যে, এই ছত্রাকগুলো পুষ্টি সংগ্রহ ও বিতরণের জন্য একটি অত্যাধুনিক ‘ট্রাভেলিং-ওয়েভ’ কৌশল ব্যবহার করে। এই নতুন আবিষ্কার কৃষি ও বাস্তুসংস্থানের ক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে।
ছত্রাকের ‘ট্রাভেলিং-ওয়েভ’ কৌশল কী?
গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন, মাইকোরাইজাল ছত্রাক মাটির মধ্যে বিশেষ এক তরঙ্গগত পদ্ধতিতে তাদের বৃদ্ধি ও বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করে। এই ছত্রাকগুলোর হাইফা (সূক্ষ্ম সুতার মতো কাঠামো) মাটির ভেতর দিয়ে ছড়িয়ে পড়ে এবং একটি ছন্দোবদ্ধ “তরঙ্গ” তৈরি করে, যার মাধ্যমে তারা পুষ্টি সংগ্রহ ও পরিবহন করে। এই কৌশল ছত্রাককে আরও দক্ষতার সঙ্গে মাটির বিভিন্ন স্তর থেকে ফসফরাস, নাইট্রোজেন এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সংগ্রহ করতে সাহায্য করে।
উদ্ভিদের শিকড়ের সঙ্গে সংযুক্ত থাকা সত্ত্বেও ছত্রাকগুলি দূরবর্তী স্থান থেকে পুষ্টি সংগ্রহ করে এবং তা সুষমভাবে বিতরণ করে। এটি কার্যকরভাবে একটি প্রাকৃতিক সাপ্লাই চেইনের মতো কাজ করে, যা উদ্ভিদ ও মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

রাইজোফ্যাগাস ইরেগুলারিস, ছবি: ইউনিভার্সাল মাইক্রোবস
টেকসই কৃষিতে সম্ভাব্য প্রভাব
এই গবেষণার ফলাফল কৃষি ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। বর্তমানে, ফসলের উৎপাদন বাড়াতে ব্যাপক হারে রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয়, যা মাটির উর্বরতা কমিয়ে দেয় এবং পরিবেশ দূষণের কারণ হয়। তবে, বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, যদি উদ্ভিদ ও ছত্রাকের এই সম্পর্ককে আরও ভালোভাবে ব্যবহার করা যায়, তাহলে রাসায়নিক সারের ওপর নির্ভরতা কমানো সম্ভব হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন ফসল উদ্ভাবনের সুযোগ রয়েছে, যা মাইকোরাইজাল ছত্রাকের সঙ্গে আরও কার্যকরভাবে কাজ করতে পারে। এর ফলে গাছপালা স্বাভাবিকভাবেই বেশি পুষ্টি সংগ্রহ করতে পারবে, কৃষকদের সার ব্যবহারের খরচ কমবে এবং পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাবও হ্রাস পাবে।
বাস্তুসংস্থান ও জলবায়ুর ওপর প্রভাব
মাটির নিচে থাকা এই ছত্রাক নেটওয়ার্ক শুধু কৃষির জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং সামগ্রিক বাস্তুসংস্থান এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত। ছত্রাকের মাধ্যমে কার্বন সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা সম্ভব, যা বায়ুমণ্ডলে অতিরিক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড হ্রাসে সহায়ক হতে পারে।
এই গবেষণার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারছেন, প্রকৃতির নিজস্ব প্রক্রিয়াগুলো কীভাবে টেকসই কৃষি ও বাস্তুসংস্থানের ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে। ভবিষ্যতে, বিজ্ঞানীরা এই জ্ঞানকে ব্যবহার করে আরও উন্নত কৃষিপদ্ধতি ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি বিকাশ করতে পারবেন।
সূত্র: নেচার