অরুন্ধতী রায় একজন বিশিষ্ট ভারতীয় লেখক, সমাজকর্মী এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তাঁর প্রথম উপন্যাস “দ্য গড অব স্মল থিংস” এর জন্য ১৯৯৭ সালে তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন, যা তাকে বুকার পুরস্কার এনে দেয়। লেখালেখির পাশাপাশি, অরুন্ধতী রায় বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন।
২০২২ সালে সেইন্ট লুইস বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি এসোসিয়েশনের তরফ থেকে লেখক অরুন্ধতী রায়কে সম্মানজনক সেইন্ট লুইস সাহিত্য পুরষ্কারে ভূষিত করা হয়। ২৮ এপ্রিল শেলডন কনসার্ট হলে তাকে এই পুরষ্কার দেওয়া হয়। বর্তমান সময়ের গুরুত্বপূর্ণ একজন লেখক হিসেবে তাঁর সমৃদ্ধ লেখক জীবনকে সম্মাননা জানাতে এই পুরষ্কারটি প্রদান করা হয়েছে। সেইন্ট লুইস ম্যাগাজিনেরর পক্ষ থেকে ২৮ এপ্রিল, ২০২২ দিল্লীতে লেখকের সাথে অনলাইনে এই সাক্ষাৎকারটা নিয়েছেন তবেইয়া ইবিতাইও।
ত.ই: সেইন্ট লুইসে কি এই প্রথম আসা হলো আপনার?
অ.রা: বহুবছর আগে এখানে একবার আমার আসা হয়েছিলো। খুব সম্ভবত তখন ‘‘‘দ্য গড অফ স্মল থিংস’’ বইটা প্রকাশ পেয়েছিলো। একটা দিন বা রাতের জন্য যাওয়া হয়েছিল। বুক ট্যুর চলছিলো বোধহয় ঐ সময়টায়। আমার খুব ভালো লেগেছিলো আপনাদের ওখানে যেয়ে।
ত.ই: সেইন্ট লুইস সাহিত্য পুরষ্কার পাওয়ার আগে এসম্পর্কে আপনার কিছু জানা ছিলো কি?
অ.রা: সত্যি বলতে বিশেষ কিছু জানা ছিলো না। কিন্তু পরে আমি আপনাদের সম্পর্কে শুনলাম এবং পড়লাম। পাশাপাশি এও জানলাম যে এর আগে কারা কারা এই পুরষ্কার পেয়েছেন। তখন আমি সত্যি খুব আনন্দ পেয়েছি যে এমন একটা পুরস্কারের জন্য আমাকে ভাবা হলো। কারণ আমি ভারতের বাইরে কখনো থাকিনি। আমার বইটির শিকড়ও ভারতবর্ষে। তাই ভিন্নদেশ থেকে স্বীকৃতি পাওয়ার ঘটনাটা নিঃসন্দেহে রোমাঞ্চকর। তাও আমেরিকার মতো বিরাটবপু কোনো জায়গা থেকে নয়, বরং বেশ প্রত্যন্ত একটা এলাকা থেকে পাচ্ছি। তাই এর মাহাত্ম আমার কাছে আরো বেশি।
ত.ই: আপনার উপন্যাসে স্পষ্টভাবে মানুষবিহীন চরিত্রগুলোর প্রতি বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। যেমন পশুপাখি, নদীনালা, বৃক্ষরাজি এবং বিস্তৃত বনায়ন। এরা সবাই আপনার উপন্যাসের জীবন্ত এক একটি চরিত্র। আপনার মনুষ্য চরিত্রগুলো যেখানে বাস করে এরাও তার সাথে হেলান দিয়ে সেই জায়গাগুলোর ক্ষেত্র রচনা করে।
অ.রা: হয়তোবা আমার নিজের গ্রামে বেড়ে ওঠার সাথে এর কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে। সেখানে কেবল মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে সবকিছু দেখা চলে না। আমি সেই নদীর তীরে বেড়ে ওঠা মেয়েটি, যে নদীর ধারে ‘‘দ্য গড অফ স্মল থিংস’’ বইটির প্রেক্ষাপট গড়ে উঠেছে। বইটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ছোট ছোট অনুভবের সংকলন। শৈশবে আমরা পোকামাকড়দের চিনতাম, কারণ আগ্রহভরে দেখতাম। আমরা জানতাম যে দিনের কোন সময়ে নদীর কোন পাশটায় গেলে মাছ পাওয়া যায়। আমরা জানতাম নিজেদের বড়শি কেমন করে বানাতে হয়। আমরা জানতাম কোন বিশেষ ধরণের পাতা কেমন করে ভাঁজ করলে তা দিয়ে খেলনা বানানো যায়। খুব অদ্ভুত শোনাচ্ছে তাই না? এখন তো সবার আইফোন আর আইপ্যাড আছে।

ছবি: অরুন্ধতী রায়, সূত্র: হাই অন বুক
আমি সেদিনই এক বন্ধুকে বলছিলাম, যে আমাদের জীবনের বিরাট একটা অধ্যায় পার হয়ে গেলো বিশাল বৃক্ষরাজি আর নদীমালার মাঝে যেন সেটা আমাদের দেহেরই একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটা কি আমাদের জন্য আশীর্বাদ না অভিশাপ? ফলে লেখক হিসেবে আমি কি লিখতে চাই সে সম্পর্কে এই প্রাকৃতিক বিষয়গুলো জ্ঞান বা তথ্য আকারে আমার মস্তিস্কে নেই বরং, লেখক সত্তার নির্যাস আকারে রয়েছে। এরা খুব সাধারণভাবেই আমার জীবনের অংশ। মানুষকে বুনন করা হয়েছে ‘নিষ্ঠুরতা’ আর ‘মমত্ব’ দিয়ে। অথচ যে আদর্শিক পকেটগুলোতে আমাদের ক্রমাগত ফিট হতে জোর করা হচ্ছে তা ভুয়া। এটাই নিখাঁদ সত্য। এই বিশেষ চেতনাবোধটা মনে হয় না আমাকে কখনো ছেড়ে গিয়েছে।
ত.ই: আপনি আগেও একবার বলেছিলেন যে একটা উপন্যাস লেখা অনেকটা একটা শহর নির্মাণের মতো। একটা স্তরের মাঝে আরো অনেক স্তরের খেলা হয় সেখানে। আপনি এও বলেছেন যে ফিকশনধর্মী লেখার ব্যাপারটা অনেকটা প্রার্থনার সামিল। এই মহাবিশ্বে নিমার্ণের যে মেটাফিজিক্স সেখানে স্থাপত্য এবং ফিকশনাল চরিত্র সৃষ্টি প্রসঙ্গে আরেকটু বিস্তরে বলবেন কি?
অ.রা: আমার প্রবন্ধগুলোতে বেশিরভাগই দেখা যাবে কোনো পরিসংখ্যানের বিরুদ্ধে আমি কিছু চিন্তা-ভাবনা যুক্তি সহকারে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছি। এগুলোর ভিত্তি হিসেবে থাকছে নানান ধরনের পত্র পত্রিকা বা টেলিভিশনের খবর এবং মূল ধারার গণমাধ্যমের হালচাল যা আমাদেরকে একটা নির্দিষ্ট ধরণের আদর্শিক জায়গায় নিয়ে যেতে উঠেপড়ে লেগেছে। আমার নন-ফিকশগুলো মূলত সে বিষয়গুলোকে সমালোচনা করে তার্কিক ভঙ্গিতে লেখা। কিন্তু যখন আমি ভ্রমণ করছি এবং লিখছি, তখন ঐ সমস্ত তর্ক ছাপিয়ে আমি আরো জটিলতার আভাস পাই যা আমার মাঝে নদীর পলিমাটির মতো জমে থাকে। ফিকশন লেখার বেলায় কিন্তু আমার লক্ষ্য এমন না। তখন আমার দেখার ধরন বদলে যায়। যেমন ধরেন, আমার ‘‘দ্য মিনিস্ট্রি অফ আটমোস্ট হ্যাপিনেস’’ উপন্যাসে যেভাবে একটা ভিন্ন চিন্তার প্রয়াস করা হয়েছে বা একে অপরের সাথে যেভাবে সম্পর্ক স্থাপন করা হয়েছে এমনকি জীবিত বা মৃতের বেলাতেও, সেটা কিন্তু কেবল ফিকশনের ক্ষেত্রেই সম্ভব। কেননা ফিকশনে আদর্শবাদী চরিত্র কিংবা যারা এই সিস্টেমের যাতাকলে পিষ্ট অথবা যারা এইসমস্ত ছকের একদম বাইরে বসবাস করেন এইসব পক্ষগুলোকে তুলে ধরা যায়। বিশেষ করে ‘‘দ্য মিনিস্ট্রি অফ আটমোস্ট হ্যাপিনেস’’ সেদিক থেকে আমার তো মনে হয় ভারতীয় সমাজের চিন্তার জগতে বেশ বড়সড় একটা বাড়ি মারতে পেরেছে।
ত.ই: ‘‘ট্রিকেল ডাউন রেভ্যুলুশন’’ বলে আপনার যে প্রবন্ধটি আছে সেখানে আপনি বর্ণনা করেছেন ‘‘অপেরাশন গ্রিন হান্ট’’, এবং ‘‘সেন্ট্রাল ইন্ডিয়া’’ এর যুদ্ধ সম্পর্কে। আপনি লিখেছেন, ‘‘একটা নতুন পৃথিবী কল্পনা করার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে যেটি ভয়াবহ ভুল তা হলো, যারা ভিন্নভাবে কল্পনা করে তাদেরকে বাধাগ্রস্ত করা। এমন একটি চিন্তা বা কল্পনা যা কিনা পুঁজিবাদের বাইরে থেকে আসতে পারে একইভাবে সাম্যবাদের বাইরে থেকেও আসতে পারে। এমনকি এর উৎস হতে পারে একদম ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আসা কিছু যা ‘সুখ’ এবং ‘পূর্ণতা’র এক নতুন সংজ্ঞার জানান দেয়।’’ আমি সেইন্ট লুইসে এমন ভিন্ন ভিন্ন চিন্তার সম্মেলন দেখতে পাই যেখানে নানা ধরণের মতবাদ ও তার প্রেক্ষিতে নানান প্রতিক্রিয়া রয়েছে। বিশেষ করে, প্রায় আট বছর আগে মাইকেল ব্রাউনের হত্যার প্রতিবাদে ফেরগুসনে এই হত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে যারা পথে নেমেছিলো তাদের উদ্দেশ্যে যখন মিলিটারি পুলিশ অফিসারেরা টিয়ার গ্যাসের ক্যান ছুড়ছিলেন এবং রবার বুলেট ছুড়ছিলেন।
অ.রা: হুম একদমই নন-ফিকশন ব্যাপার স্যাপার। ‘‘দ্য মিনিস্ট্রি অফ আটমোস্ট হ্যাপিনেস’’ এবং আমার প্রবন্ধগুলো প্রকাশ হয়েছে ‘’এন্টি ড্যাম রেসিস্টেন্স’ ‘(বাধ বিরোধী) এবং ‘’এন্টি ডিস্প্লেসমেন্ট’’ (উচ্ছেদ বিরোধী) আন্দোলনের পরে। কিন্তু এরপর আমাদের দেশে সবকিছু কেমন যেন ধীরে ধীরে আরো অন্ধকারময় হয়ে উঠতে লাগলো। এখানে এখন সবাই রাস্তায়। আপনি যা ফেরগুসনে দেখেছেন ঠিক তার বিপরীত। এখানে আছে বিনা বিচারে নিজেরাই বিচার করে সাজা দেওয়ার একটা মবের দল। এখানে আছে ঘৃণা ছড়াচ্ছেন এমন নির্দিষ্ট করে বলে দেওয়ার মতো কিছু ব্যক্তি। এখানে আছেন এমন মানুষজন যারা প্রকাশ্যে মুসলিম নারীদের ধর্ষনের ঘোষণা দিয়ে বেড়াতে পারেন। প্রকাশ্যে হত্যা করার ঘোষণাও দেন যারা তাদের এই জাতীয়তাবাদী ধারণার সাথে একমত নন। এমন যত বিদপদের আশংকা আছে নিয়মিতভ তার সমস্ত কিছুর মাঝ দিয়ে যাচ্ছেন এদেশের মানুষেরা। প্রতি মুহূর্তে এখানে ছোট ছোট নানা আন্দোলনের মাধ্যমে এই ধরণের চেতনার বিস্ফোরণ ঘটছে। এই যে নতুন সিটিজেনশিপ আইন ২০১৯-এ পাশ করানো হলো, যেখানে মূলত মুসলিমদের বিরুদ্ধে বৈষম্যপূর্ণ একটা আচরণ করা হয়েছে। এরপর তিনটা ফার্ম আইন পাশ করলো ভারত সরকার। এরপর প্রায় এক বছর ধরে কৃষকদের এনিয়ে তুমুল আন্দোলন চললো। শেষ পর্যন্ত তারা এই আইন তুলে নিতে বাধ্য হলো।
কিন্তু এরপরেও এই ডানপন্থীরা থামে না। এই আজকেই যেমন দিল্লীতে একজন মানুষ প্রকাশ্যে গণহত্যার আহ্বান জানিয়েছেন এবং হিন্দুদের হাতিয়ার নিয়ে প্রস্তুত হতে বলেছেন। ‘‘দ্য কাশ্মির ফাইলস’’ বলে সম্প্রতি একটি চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছে। এরা চক্রান্ত করে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে নিজেদের জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোকে সিনেমা হলগুলোতে নিয়োগ করছে। তারা বলছে যে, মুসলিম নারীদের আরো বেশি বেশি গর্ভধারণ করে বংশ বিস্তার করা উচিৎ কেননা অ-জাতীয়তাবাদী হিন্দুরা মুসলমানদের চেয়েও বেশি বিশ্বাসঘাতক। শারীরিকভাবে আঘাত করার এই হুমকি এতটাই বাস্তব সত্য হয়ে পড়েছে যে কৃষক আন্দোলনের মতো বিরাট একটা আন্দোলন কিংবা এন্টি-সিটিজেনশিপ আইন বাতিলের আন্দোলনকেও কোনো আকারে তারা আসতে দিচ্ছে না।