Home সাহিত্য কথায় কথায় অরুন্ধতী রায় (২য় পর্ব)

কথায় কথায় অরুন্ধতী রায় (২য় পর্ব)

সুপ্রভা জুঁই 
২১৮ views

ত.ই: আমি পড়লাম ‘দ্য কাশ্মির ফাইলস’ চলচ্চিত্রটি নাকি মুসলিম-বিরোধী চেতনার জন্ম দিয়েছে ভারতে। কিছু ভিডিও দেখলাম যেখানে হিন্দুত্ববাদীরা সিনেমা হলের সামনে ক্ষিপ্ত হয়ে স্লোগান দিচ্ছে। এটা তো খুব ভয়াবহ একটা ঘটনা। তুমি আগেও বলেছ যে ইন্ডিয়া নিজেকে একটা জঙ্গি দলে পরিণত করেছে।

অ.রা: চলচ্চিত্রটি দেখলে তুমি বুঝবে যে সেটা কিন্তু সত্যের জানান দিচ্ছে না। মজার বিষয় যে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং বলছেন, ‘এটাই সত্যি এবং সবার এটা দেখা উচিৎ।’ শুধু তাই নয়, তারা সরকারি পুলিশ ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের রীতিমতো ছুটি দিচ্ছেন যেন তারা হলে গিয়ে সিনেমাটা দেখে। তারা তাদের নিজস্ব গুন্ডা পাঠাচ্ছেন যেন হলে ঝামেলা তৈরি হয়। পরিচালক বলছেন, ‘এখানে যা সত্যি তাই দেখানো হয়েছে।’ কিন্তু সিনেমার শুরুতে লেখা থাকছে— এটা একটা ফিকশনাল কাজ। মূলত এখানে সত্যের একটা অংশকে নিয়ে তার চারপাশ দিয়ে মিথ্যের মহাবিশ্ব গড়ে তোলা হয়েছে। চলচ্চিত্রটি কিন্তু শেষমেশ কাশ্মির পন্ডিতদের নিয়ে নয়, বরং এটা হলো সেই কাশ্মির পন্ডিতদের উপস্থাপন যারা কিনা গোটা ভারতবর্ষের হিন্দুদের পক্ষে আছেন এবং সকল মুসলিম যেখানে খারাপ। তারা কেবল কসাইয়ের মতো হিন্দুদেরকে হত্যা করতেই জানে। অথচ সত্য হলো, এখনো অনেক কাশ্মিরি পন্ডিত কাশ্মিরেই বসবাস করছেন, যাদের মুসলিম বন্ধু এবং প্রতিবেশী রয়েছে। গত ৩০ বছরে ৬১৯ জন কাশ্মিরি পন্ডিতকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু চলচ্চিত্রে বলা হচ্ছে— গোটা জাতিকে ধ্বংস করে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়েছে।

এদিকে কাশ্মির কিন্তু মুসলিমদের কবরে ছেয়ে আছে। দশ হাজারেরও বেশি মুসলিম সেই যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে। অথচ তার সবকিছু হাওয়ায় মিলিয়ে দেওয়া হলো। একটা মহাকাব্যিক বিয়োগান্তক ঘটনা থেকে আপনি একটা বেদনায়ক সুতা নিলেন এবং তা দিয়ে পর্দায় দৃশ্য রচনা করলেন, আর বাদবাকি সবকিছু বাদ দিয়ে দিলেন। শুধু তাই নয়, চলচ্চিত্রটাকে বর্শার মতো ব্যবহার করে জটিল পরিস্থিতিতে থাকা এদেশের মানুষের অবুঝ হৃদয় ছিন্নভিন্ন করার একটা সুযোগ রচনা করলেন। এই চলচ্চিত্র সম্পর্কে আমার প্রতিক্রিয়া কেবল এক শব্দেই বয়ান করা যায়, radio-active (রেডিও-এক্টিভ) বা তেজস্ক্রিয়তা। এই চলচ্চিত্রে মুসলমানদের পক্ষে সাফাই গাইছেন এমন একজন অধ্যাপক চরিত্র আছেন যেটা নাকি আমাকে ভেবে নির্মাণ করা। এর ফলে আমি কোথাও গেলে আমাকে শারীরিকভাবে আক্রমণের সব রকমের উপাদান তারা ছড়িয়ে রেখেছে।

চলচ্চিত্রের এই কাল্পনিক অধ্যাপক চরিত্রটি আমার এবং দিল্লির একজন অধ্যাপকের সমন্বয়ে রচিত, যিনি চলচ্চিত্রে কল্পিত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। চলচ্চিত্রের মতো একটি শিল্পকর্ম দেখার পর সাধারণ জনগণ যদি নারীদের ধর্ষণ এবং হত্যার হুমকি দিতে থাকে, মানুষজনকে রাস্তায় ফেলে যত্রতত্র নির্যাতন করতে থাকে, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার নামে হিন্দুরা অস্ত্র হাতে নিয়ে নেয়— এমন অবস্থায় আপনি কিভাবে নিজের সাথে আপস করবেন? এটা নিঃসন্দেহে একটা তেজস্ক্রিয়া। একবার চিন্তা করে দেখুন, শিল্পের একটা অংশ তেজস্ক্রিয় অস্ত্রের সাথে তুলনীয় হয়ে পড়লো। সেই অস্ত্রকে ছোড়া হলো এই ভারতের মানুষের হৃদয়ে এবং যার কুপ্রভাব বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকবে। মনের সবগুলো স্তর এভাবে ভেদ করে করে সেই বিষ গভীরে পৌঁছে যাবে।

 ত.ই: আপনার ‘মাই পোস্ট লকডাউন রিভারাই’ এর বর্ধিত সংশোধিত প্রকাশনা ‘আজাদি: ফ্যসিজম, ফিকশন অ্যান্ড ফ্রিডম ইন দ্য টাইম অফ দ্য ভাইরাস’ ২০২০ সালে প্রকাশ পেয়েছে এবং সেখান আপনি লিখছেন, মহামারিতে ভারত সরকারের প্রতিক্রিয়া বর্ণবৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। জাতি, বর্ণ এবং সাম্রাজ্যবাদের মাঝে পারস্পারিক সম্পর্কের কথা চিন্তা করে আপনি কিভাবে নির্ধারণ করেন যে এভাবে কাঠামোগত উপায়ে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিলীন করা হচ্ছে?

অ.রা: পুরো ব্যাপারটা এখন আরও জটিল হয়ে উঠেছে। ১৯৯০ থেকে ধরলে দেখা যাবে যে রাজনৈতিক দলগুলোর ক্রমবর্ধমান ইশতেহারের মাঝে আসবে যে তারা নিজেদেরকে দলিতদের কণ্ঠ হওয়ার দাবি জানাচ্ছে অথবা তারা পিছিয়ে পড়া নানা বর্ণের মানুষদের জন্য আওয়াজ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। কারণ এই নিম্নবর্ণের মানুষদের একত্রিত করে বেশ বড় একটা জনসংখ্যাকে ভোটার হিসেবে পাওয়া যায়। যদিও তাদের নিজেদের মাঝে একতা নেই, তারা খণ্ডিত। কিন্তু গত দুই নির্বাচনে হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল এই খণ্ডিত নানা বর্ণের দলগুলোকে তুচ্ছ জ্ঞান করেছে। দলিত পার্টি যেটা কিনা আম্বেদকরবাদীর চেতনায় দাঁড়িয়েছে, তারা কেবল একটা সিট জিতেছে। এবং সেটাও কেবল দলিতদের দ্বারা জিতেছে এমনটিও নয়। উত্তর প্রদেশের নির্বাচনের কথা বলছি আমি। এই ধরনের জাতীয়তাবাদ এবং মেরুকরণ মুসলিমদের বিরুদ্ধে সমস্ত সমীকরণ পাল্টে দিয়েছে লকডাউন সত্ত্বেও, নিষ্ঠুরতা সত্ত্বেও,  ডিমনিটাইজেশন সত্ত্বেও, বেকারত্ব সত্ত্বেও।

আমার প্রবন্ধে আমি লিখেছি যে ষাটের দশকে অনেক বৈপ্লবিক আন্দোলন হয়েছে টাকাপয়সা এবং জমির সমবন্টন নিয়ে। সেগুলোর কোনোটাই আলোর মুখ দেখেনি। এরপর এলো সেই বিখ্যাত উচ্ছেদ-বিরোধী আন্দোলন। বাঁধ-বিরোধী আন্দোলন, ৮০ ও ৯০ এর দশকে যেখানে মানুষজন আর অন্য কিছু চাইছে না, তারা কেবল বলছে যে তাদের নিজেদের জায়গাটুকু যেন কেড়ে না নেওয়া হয়। সেসবও ধ্বংস করা হলো। এরপর মানুষেরা যুদ্ধ করলো ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি আইনের জন্য যেটা অন্তত এটুকু নিশ্চিত করতে পারে যে সর্বনিম্ন ৯০ দিনের মাঝে শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করা হবে।

আজকে আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি এমন একটা পরিস্থিতির যেখানে জনমানুষ প্রধানমন্ত্রী মোদিকে ভোট দিচ্ছে, কারণ তাদেরকে রেশন দেওয়া হচ্ছে। যেমন— পাঁচ কিলো চাল, এক কিলো চিনি ইত্যাদি। এবং এর সাথে যুক্ত হয়েছে সিটিজেনশিপ এমেন্ডমেন্ট বিল যেখানে মুসলিমদের ভূমিহীন করে দেশ ছাড়ার পায়তারা করা হচ্ছে। মুসলিমদের এটাই বোঝানো হচ্ছে যে এদেশ তাদের নয়। একটা বন্দিশালায় তারা আছে যেখানে আহার-বিহারের সীমানা ঠিক করে দেওয়া আছে এবং এটাই তাদের কপাল। কিন্তু তাদের সংখ্যা এতই বেশি যে ডিটেনশন সেন্টারে তাদের সবাইকে আটানো যাবে না। এমন একটা কাল্পনিক রাষ্ট্র যেখানে আপনি বসবাস করছেন অথচ যেখানে আপনার অধিকার বলতে কিছু নেই। গত বছরই ৩০০ জন খ্রিস্টানের বিরুদ্ধে এখানে আক্রমণ করতে দেখা গেলো।

এই বর্ণপ্রথা আছে বলে ইন্ডিয়ায় ধর্ম, জাতিগত দ্বন্দ্ব এবং এলাকাভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতা আছে। নতুবা সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের প্রচেষ্টা চলছে। কিন্তু দেখুন বাস্তবে এমন কিছুর কিন্তু কোনো অস্তিত্বই নেই। এটা খুবই নিষ্ঠুর একটা প্রক্রিয়া। ডক্টর বি আর আম্বেদকর তার ‘এনিহিলেশন অফ কাস্ট’ প্রবন্ধে লিখছেন যে, বর্ণ কোনো সাম্প্রদায়িক চর্চা নয় যেটা সাদা চামড়ার মানুষেরা কালো চামড়ার মানুষদের সাথে করে থাকেন। বর্ণ একদম ভিন্ন একটা ব্যাপার, এ অর্থে যে এটা খুব সন্তর্পণে শ্রেণিবিন্যাসকরণকে আকৃতি দিয়েছে। যেখানে কাউকে না কাউকে অত্যাচার করতে হবে এবং কাউকে না কাউকে অত্যাচারিতও হতে হবে। ফলে এই হলো জটিলতার মূল জায়গা, যেখানে আপনি এমন একটা কাঠামো ব্যবস্থা নিরূপণ করেছেন যার দরুন সবাই এই শ্রেণির ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত স্তরবিন্যাস অনুযায়ী একে অপরের সাথে আচরণ করতে বাধ্য থাকছে। আমি প্রায় সময়েই এই লাইনটা বলি যা সাম্যবাদীরা বা মাওবাদীরাও বলে থাকেন। এটা মাওয়ের বিখ্যাত এক উক্তি— একটি ছোট্ট স্ফুলিঙ্গ অজস্র মশালের আগুন হতে পারে।

ত.ই: আমার মনে আছে আপনি একবার বলেছিলেন, ব্রাহ্মণ্যবাদ ভারতকে আলোর পরিবর্তে অন্ধকারে টেনে নিয়েছে।

অ.রা: হ্যাঁ! সেই ক্ষুদ্র স্ফুলিঙ্গ অন্ধকারে মিলিয়ে গিয়েছে। সে বুঝতেই পারলো না কোথায় তার গন্তব্য ছিল! জাত-পাত আপনাকে সব ধরনের সংহতি থেকে বিরত রাখে। এমনকি যারা যুক্তিবাদী র‍্যাডিক্যাল মানুষ তারাও এই প্রথার দরুন আলাদা করতে করতে নিজেদেরকে অনেক দূরে… দূরে… দূরে… সরিয়ে নিয়েছে।

অরুন্ধতী রায়, চিত্রগ্রাহক: ম্যাগনুস ওয়েনম্যান

অরুন্ধতী রায়, চিত্রগ্রাহক: ম্যাগনুস ওয়েনম্যান

ত.ই: এসব কিছুর ভিড়ে আপনি কোথায় অবস্থান করেন?

অ.রা: আশা বা সুখ কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া যাবে বা কোনো ভবনে গেলে সেসব দেওয়া হয়— এমন তো নয়। আমার মনে হয় তা নিহিত আছে নিবিড় অনুধাবনের মাঝে, একে অন্যের পাশে দাঁড়ানোর মাঝে, এবং সকলে মিলে একত্রে প্রতিহত করার মাঝে। হয়তো তা আপনার কল্পনামাফিক হবে না। আমাদের একসাথে সবাইকে মিলেমিশে থাকতে হবে এবং আমরা সবাই ভিন্ন ভিন্ন মানুষ— এই সহজ সরল বিষয়টাকে গ্রহণ করতে পারার মতন বোঝাপড়ার দ্বারা নিজেদের জন্য একটা স্পেস আমাদের তৈরি করতে হবে।

গত বছরের কৃষক আন্দোলন ছিল ভারতের ঐতিহাসিক একটা আন্দোলন। চিন্তা করুন, তারা পুরো একটা বছর দিল্লির বাইরে উপশহরে তাবু গেড়ে থাকলো। সেই আন্দোলনে তাদের নিজেদের মাঝেও কিন্তু বোঝাপড়ার অনেক অসামাঞ্জস্যতা ছিল। কিন্তু তাও, আজীবনের শত্রু হলেও, এই আন্দোলনে তারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলেছে। এখানে ছিল ভূমিহীন অনেক মানুষ যারা জমিদারদের দ্বারা শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে অত্যাচার ও ছলনার শিকার। কিন্তু এই দুই পক্ষ একটা উপায় খুঁজে পেয়েছিল এই আন্দোলনে একে অপরের সাথে কথা বলার।  কারণ তারা জানতো যে একসাথে সবাই ডুবতে চলেছে। শেষ পর্যন্ত এই যে স্পিরিটটা ধরে রাখা হলো যাতে ভিন্নমতের মানুষেরাও একত্রিত হয়ে, কাউকে বাদ না দিয়ে, সবাই একসাথে হয়ে কারও চাওয়াকে ক্ষুদ্র জ্ঞান না করে, কারোর উপরে খবরদারি না করে এতদিন থাকলো। সেটাই কিন্তু বর্তমানের মতন ভয়ংকর শক্তিশালী সরকারকে বাধ্য করতে পারলো যেন আইন বাতিল করে নতুন আইন প্রণয়ন করে। এটা কিন্তু জনমনে বিশাল আশার জন্ম দিয়েছে।

ভারতে নিশ্চিতভাবেই আমরা এমন একটা অবস্থায় আছি যেখানে শক্তিশালী সরকারি ব্যবস্থা আছে। যারা সমস্ত নিয়ম-কানুন বদলে দিচ্ছে, যা সংবিধান পরিপন্থী, যা নির্বাচনের নিয়মাবলীর পরিপন্থী। যাদের নিজেদের একটা সক্ষমতা আছে যে কীভাবে কর্পোরেট হাউসগুলো থেকে বিরাট অংকের ফান্ড জোগাড় করতে হয় কোনো প্রকার স্বচ্ছতা ছাড়াই। যাদের কাছে অন্যদের সম্পর্কে বিস্তর তথ্য আছে। আপনি যদি নির্বাচন লক্ষ্য করেন আপনার মনে হবে, একটা ফেরারি গাড়ির সাথে একটা বাইসাইকেলের রেস হচ্ছে।

তাই আমাদের নিজেদেরকে জায়গা খুঁজে নিতে হবে, রাস্তায় অথবা শ্রেণিকক্ষে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেখানে আমরা পারি। হয়তো কোনো পরিবর্তন আমরা দেখতে পাব না, এটা আমাদের জানা থাকা দরকার। কারণ একটা দল নির্বাচনে অন্য দলের কাছে হারবেই। আমরা হয়তো সেই জয় থেকে অনেক দূরে ভেসে গিয়েছি। আমাদের পক্ষে হয়তো আর সেই সৈকতে জাহাজ ভেড়ানোর সময় নেই। কিন্তু তাও আমাদের সেই সৈকতেই ফিরতে হবে।

সাক্ষাৎকারের ১ম পর্ব

আরও যা পড়তে পারেন

কমেন্ট করুণ