স্প্যানিশ-পেরুভিয়ান ঔপন্যাসিক ও ২০১০ সালে সাহিত্যে নোবেলজয়ী কথাশিল্পী মারিও ভার্গাস য়োসা মারা গেছেন। রোববার (১৩ এপ্রিল) ৮৯ বছর বয়সে পেরুর রাজধানী লিমায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বলে এক বিবৃতিতে নিশ্চিত করেছে তার পরিবার। এই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের ‘গোল্ডেন জেনারেশন’ যুগের অবসান হলো।
লিমা থেকে তার বড় ছেলে আলভারো এক্স (সাবেক টুইটার)-লেখেন, গভীর দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, আমাদের বাবা মারিও ভার্গাস য়োসা আজ লিমায় পরিবার পরিবেষ্টিত অবস্থায় শান্তিতে মৃত্যুবরণ করেছেন।’
তার ভাই গনজালো ও বোন মরগানাও এতে স্বাক্ষর করেন।
মধ্যবিত্ত পেরুভিয়ান পরিবারে জন্ম নেওয়া ভার্গাস য়োসা ১৯৬০ ও ৭০-এর দশকের লাতিন আমেরিকান সাহিত্য ‘বুম’-এর অন্যতম প্রধান মুখ ছিলেন, গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস ও হুলিও কোর্তাসারের সঙ্গে একই কাতারে বিবেচিত হন তিনি।
১৯৯৩ সালে তিনি স্পেনে চলে যান ও স্পেনের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। একই সময় তিনি পেরুর স্বৈরশাসক ফুজিমোরি বিরুদ্ধেও অবস্থান নেন।

মারিও ভার্গাস য়োসা, পেরুর লিমায় নিজ বাসগৃহে ১৯৯০ সালের ১ মার্চ, ছবি: সিএনএন
গতকাল সোমবার (১৪ এপ্রিল) স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ এক্স-এ লেখেন, ‘মারিও ভার্গাসকে বিদায় জানাচ্ছে স্প্যানিশ সাহিত্য। এক বিশ্বজোড়া শ্রেষ্ঠ কথাশিল্পীর প্রতি একজন পাঠকের কৃতজ্ঞতা রইল। তিনি আমাদের সময়কে বোঝার জন্য যে বিশাল সাহিত্যভাণ্ডার রেখে গেছেন, তা অমূল্য।’
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তার অসুস্থতা নিয়ে গুঞ্জন ছিল, তিনি জনসমক্ষে দেখা দিচ্ছিলেন না। গত অক্টোবরে তার ছেলে আলভারো বলেছিলেন, ‘তিনি ৯০ ছুঁইছুঁই করছেন, এমন বয়সে একটু বিশ্রাম নেওয়াই স্বাভাবিক।’
পারিবারিক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, ভার্গাসের মৃত্যুতে তার পরিবার, বন্ধু ও সারা বিশ্বের পাঠকরা শোকাহত হবেন। তবে তারা আশাবাদী যে— ‘তার দীর্ঘ, দু:সাহসিক ও সৃজনশীল জীবনের স্মৃতি ও তার রেখে যাওয়া সাহিত্য আমাদের সান্ত্বনা দেবে।’
পেরু সরকার সোমবার তাকে সম্মান জানিয়ে একদিনের শোক ঘোষণা করে, সরকারি ভবনগুলোতে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়।
‘অমর উত্তরাধিকার’ ভার্গাস য়োসার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী কোনো সরকারি বা পাবলিক শোকানুষ্ঠান হবে না। পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তারা ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে তাকে বিদায় জানাতে চান।
লেখকের শেষ ইচ্ছানুযায়ী তার দেহ দাহ করা হবে বলেও জানিয়েছেন আলভারো, গনজালো ও মরগানা।

স্পেনের মাদ্রিদ শহরে ২০১৯ সালে নোবেলজয়ী সাহিত্যিক মারিও ভার্গাস য়োসা, ছবি: টাইম ম্যাগাজিন
মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর লেখকের বাড়ির আশপাশে অনেকেই জড়ো হন। তাদের মধ্যে একজন, গুস্তাভো রুইজ বলেন, ‘আমি বিশ্বাসই করতে পারিনি। যেহেতু শোকানুষ্ঠান হচ্ছে না, তাই এখানে এসেছি শ্রদ্ধা জানাতে।’
৩০ বছর বয়সী ভিজ্যুয়াল শিল্পী ডেভিড মাররোস বলেন, ‘ভার্গাস য়োসা দেখিয়ে গেছেন যে, যে কাজ আপনি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন, সেটা করেই জীবন কাটানো সম্ভব।’
পেরুর প্রেসিডেন্ট দিনা বলুয়ার্তে এক্স-এ লেখেন, ‘এই মহান পেরুভিয়ান আমাদের জন্য রেখে গেছেন এক বিশাল সাহিত্যিক উত্তরাধিকার, যা আগামী প্রজন্মের জন্য অনন্ত অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।’
কলোম্বিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট আলভারো উরিবে তাকে বলেছেন ‘মাস্টার অব মাস্টারস’।
সহপাঠী ও লেখক আলফ্রেদো ব্রাইস এচেনিকে ভার্গাস য়োসাকে ‘আধুনিক পেরুর সবচেয়ে বড় সাহিত্যিক’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
মার্কিন উপ-পররাষ্ট্র সচিব ক্রিস্টোফার ল্যান্ডাউ বলেন, ‘তাকে শুধুমাত্র পেরুভিয়ান বলা তার প্রতি অবিচার হবে, কারণ তার সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গি সময় ও ভৌগোলিক সীমার ঊর্ধ্বে।’
‘তিনি বেঁচে থাকবেন আমার বইয়ের তাকেই নয়, গোটা লাতিন আমেরিকা ও বিশ্বের অগণিত পাঠকের মনে,’ লেখেন ল্যান্ডাউ।

২০১৮ সালে ইসাবেল প্রিসলারের সাথে নোবেলজয়ী সাহিত্যিক মারিও ভার্গাস য়োসা, ছবি: বিবিসি
২০২৪ সালে ভার্গাস য়োসা আবার লিমায় চলে আসেন ও চলতি বছরের ২৮ মার্চ ৮৯তম জন্মদিন উদযাপন করেন।
এর কয়েক দিন আগে তার ছেলে আলভারো এক্স-এ তার তিনটি ছবি পোস্ট করেন, যেখানে লেখককে লিমার নানা জায়গায় দেখা যায়— সেখানেই তিনি তার শেষ দুই উপন্যাস লিখেছেন।
ভার্গাস য়োসা বাস্তবতার ঘনিষ্ঠ ও নিরীক্ষাধর্মী চিত্রণ এবং সমাজ বিশ্লেষণের জন্য খ্যাতি অর্জন করেন। তবে তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, বিশেষত রক্ষণশীল অবস্থান, অনেক দক্ষিণ আমেরিকান বুদ্ধিজীবীর সমালোচনার মুখে পড়ে।
ফরাসি ভাষা ও সংস্কৃতির অনুরাগী ভার্গাস য়োসা প্যারিসে অনেক বছর কাটিয়েছেন। জীবিত থাকা অবস্থায় ২০১৬ সালে তিনি ফ্রান্সের বিখ্যাত প্লেয়াদে সিরিজে স্থান পাওয়া প্রথম বিদেশি লেখক হন। ২০২১ সালে তিনি ফ্রান্সের একাডেমি অব ইন্টেলেকচুয়ালস-এর সদস্য মনোনীত হন।
১৯৩৬ সালের ২৮ মার্চ পেরুর আরেকিপায় জন্মগ্রহণ করেন মারিও ভার্গাস য়োসা। তার সাহিত্যিক জীবন শুরু হয় সাংবাদিকতা দিয়ে, যা পরবর্তীতে তাকে উপন্যাস, নাটক ও প্রবন্ধের জগতে নিয়ে যায়।

২০১৬ সালে মাদ্রিদের কাসা আমেরিকায় নিজের নতুন বই “সিনকো এসকুইনাস” (“ফাইভ কর্নারস”) মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে লেখক, ছবি: এনবিসি নিউজ
তার প্রথম উপন্যাস নায়কের কাল (১৯৬৩) পেরুর সামরিক একাডেমির বাস্তবতা তুলে ধরে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করে। এরপর সবুজ ঘর, ক্যাথেড্রালে কথোপকথনসহ বহু বিখ্যাত উপন্যাস রচনা করেন তিনি। তার লেখায় লাতিন আমেরিকার রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
২০১০ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন মারিও ভার্গাস য়োসা। নোবেল কমিটি তার সাহিত্যকর্মকে ‘ক্ষমতার কাঠামো, বিদ্রোহ, পরাজয় ও ব্যক্তির সংগ্রাম’-এর গভীর চিত্রায়ন হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তার রচনাগুলো প্রায় ৩০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
তিনি ১৯৯৩ সালে স্পেনের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় দীর্ঘ সময় বসবাস করেন।
মারিওর ব্যক্তিগত জীবনও ছিল আলোচিত। তিনি দুইবার বিয়ে করেন। প্রথম স্ত্রী ছিলেন চাচাতো বোন জুলিয়া। পরবর্তীতে তিনি কাজিন প্যাট্রিসিয়া য়োসাকে বিয়ে করেন।

রাজনৈতিকভাবে তিনি পেরুর প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, ছবি: নিউ দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস
রাজনৈতিকভাবে তিনি পেরুর প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, যদিও নির্বাচনে জয়ী হননি। তার রাজনৈতিক অবস্থান সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়েছে, যা তার লেখায়ও প্রতিফলিত হয়েছে।
মারিও ভার্গাস য়োসার মৃত্যুতে বিশ্ব সাহিত্য জগতে গভীর শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তার সাহিত্যকর্ম পাঠকদের চেতনাকে জাগ্রত করেছে এবং সমাজের গভীর বাস্তবতাকে তুলে ধরেছে। তার মৃত্যুতে লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের একটি যুগের অবসান ঘটলো।
তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বিশ্বজুড়ে পাঠক ও সাহিত্যপ্রেমীরা শোক প্রকাশ করছেন। মারিও ভার্গাস য়োসার সাহিত্যকর্ম চিরকাল পাঠকদের অনুপ্রাণিত করবে এবং তার অবদান সাহিত্য জগতে অমর হয়ে থাকবে।
সূত্র: এএফপি, ব্লুমবার্গ, বিবিসি, টাইম ম্যাগাজিন ও সিএনএন