Home লাইফস্টাইল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ট্রেন্ডিং ‘ডোপামিন মেন্যু’ আসলে কি?

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ট্রেন্ডিং ‘ডোপামিন মেন্যু’ আসলে কি?

ফাহমিদা শিকদার
৬০ views

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই মুহূর্তে ভাইরাল একটি শব্দগুচ্ছ—”ডোপামিন মেন্যু”। টিকটক, ইনস্টাগ্রাম কিংবা ইউটিউব খুললেই দেখা যাচ্ছে এই নিয়ে অগণিত ভিডিও, রুটিন, চ্যালেঞ্জ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই ডোপামিন মেন্যু আসলে কী? এটা কি আরেকটা ট্রেন্ড মাত্র, নাকি বাস্তব জীবনে এটা সত্যিই কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে?

ডোপামিন আসলে কী?
ডোপামিন একটি নিউরোট্রান্সমিটার, অর্থাৎ মস্তিষ্কে তথ্য প্রেরণের জন্য প্রয়োজনীয় রাসায়নিক। এটা আমাদের আনন্দ, অনুপ্রেরণা, ও পুরস্কারবোধ সংক্রান্ত অনুভূতির সাথে গভীরভাবে জড়িত। যখন আমরা কোনো আনন্দদায়ক বা উত্তেজনাকর কিছু করি—যেমন প্রিয় গান শুনি, মজার ভিডিও দেখি, কিংবা চকলেট খাই—তখন মস্তিষ্ক ডোপামিন নিঃসরণ করে। এটি একধরনের পুরস্কারের অনুভূতি তৈরি করে, যাতে আমরা আবার সেই কাজ করতে আগ্রহী হই।

সমস্যা শুরু এখান থেকেই…
বর্তমানে আমরা এমন এক “ওভারস্টিমুলেটেড” যুগে বাস করছি, যেখানে ইনস্টাগ্রাম স্ক্রল করা, নেটফ্লিক্সে বিঞ্জিং, কিংবা ফাস্ট ফুড খাওয়ার মতো কাজগুলো প্রতি মুহূর্তে আমাদের ডোপামিন ঠিক দিয়ে যাচ্ছে। এই স্বল্পমেয়াদি আনন্দ দীর্ঘমেয়াদে একধরনের আসক্তি তৈরি করে, যার ফলে যখন আমরা কিছু না করে বসে থাকি বা সামান্য বিশ্রাম নেই তখন বেশ একঘেয়ে, অনুপ্রেরণাহীন এবং অলসবোধ করি।

man doing his self care ritual

বর্তমানে আমরা এমন এক “ওভারস্টিমুলেটেড” যুগে বাস করছি, যেখানে ডোপামিনের জন্য আমরা ইনস্টাগ্রাম স্ক্রলিং বা নেটফ্লিক্সে বিঞ্জিং-এ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি, ছবি: ফ্রিপিক

আরেকটু ভালোভাবে বুঝিয়ে বললে, যখন আমরা নিয়মিত হাই-ডোপামিন কাজ করি, তখন আমাদের মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে সেই কাজে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। আগে যে জিনিসে আনন্দ পেতাম, এখন আর তা থেকে আগের মতো অনুভূতি পাই না। বই পড়া, প্রকৃতির মাঝে সময় কাটানো, গভীর চিন্তা—এসব কম উত্তেজক কিন্তু মানসিকভাবে সমৃদ্ধ কাজ আমাদের কাছে একঘেয়ে লাগে। ফলে আমরা অলসতা, অনুপ্রেরণার ঘাটতি, এবং ক্রমাগত অতৃপ্তির শিকার হই।

“ডোপামিন ডিটক্স” থেকে “ডোপামিন মেন্যু”
এই সমস্যা থেকে বাঁচতেই আসে ডোপামিন ডিটক্স—অর্থাৎ কিছু সময় ডোপামিন-সার্ভিং কার্যক্রম থেকে দূরে থাকা। তবে, বাস্তব জীবনে এটা খুব কঠিন। তাই এর ভারসাম্যপূর্ণ এসেছে এক নতুন ধারণা—ডোপামিন মেন্যু।
এই ধারণার মূল উদ্দেশ্য হলো:

  • অলস সময়ের পরিবর্তে সচেতনভাবে ডোপামিন-ফ্রেন্ডলি কাজে সময় ব্যয় করা।
  • কম ডোপামিন কার্যক্রমের মাধ্যমে নিজের নিয়ন্ত্রণশক্তি বাড়ানো।

ডোপামিন মেন্যু: নতুনভাবে নিজের জীবন সাজানো
এই সমস্যার সমাধান খুঁজতে গিয়ে কিছু মানুষ তৈরি করেছে “ডোপামিন মেন্যু”—এক ধরনের দৈনন্দিন রুটিন বা সময়সূচি, যেখানে আমাদের কাজগুলো ডোপামিন নিঃসরণের মাত্রা অনুযায়ী শ্রেণিবদ্ধ করা হয়। উদ্দেশ্য একটাই: জীবনের উপর নিয়ন্ত্রণ ফেরানো, মস্তিষ্ককে “রিসেট” করা এবং দীর্ঘস্থায়ী তৃপ্তি খোঁজা।

ডোপামিন মেন্যু মূলত তিন ভাগে ভাগ করা যায়:

লো-ডোপামিন অ্যাকটিভিটি: মেডিটেশন, বই পড়া, প্রকৃতিতে হাঁটাহাঁটি, হাতে লেখা জার্নাল। এই কাজগুলো তুলনামূলক কম উত্তেজক হলেও, এগুলোর মাধ্যমে অন্তর্নিহিত শান্তি ও ফোকাস ফিরে আসে।

young woman practicing yoga rela

ডোপামিন মেন্যুর শুরু হতে পারে মেডিটেশন দিয়ে, ছবি: ফ্রিপিক

মিড-ডোপামিন অ্যাকটিভিটি: ব্যায়াম, হালকা গান শোনা, রান্না করা, বন্ধুর সঙ্গে দেখা। এতে আমাদের মন সতেজ থাকে, অথচ আসক্তি তৈরি হয় না।

হাই-ডোপামিন অ্যাকটিভিটি: সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্রলিং, ফাস্ট ফুড খাওয়া, ভিডিও গেম, টিভি শো বিঞ্জিং। এগুলো দিনে নির্দিষ্ট সময়ে সীমিতভাবে রাখা হয়, যেন আমরা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে না ফেলি।

কেমন হতে পারে একটি ডোপামিন মেন্যু?
সকাল:

  • ৬:৩০ – ধ্যান বা নিশ্বাস অনুশীলন
  • ৭:০০ – ১০ মিনিট জার্নাল লেখা
  • ৭:৩০ – হালকা ব্যায়াম
  • ৮:০০ – স্বাস্থ্যকর প্রাতঃরাশ

দুপুর:

  • ১২:০০ – গভীর কাজের সময় (ডিপ ওয়ার্ক)
  • ২:০০ – স্বাস্থ্যকর লাঞ্চ, কোনো স্ক্রিন ছাড়া
  • ৩:০০ – বই পড়া / প্রকৃতিতে হাঁটাহাঁটি
close up man smiling while readi

রোজ বই পড়ার জন্য অন্তত ৩০ মিনিট সময় বরাদ্দ রাখুন, ছবি: ফ্রিপিক

সন্ধ্যা:

  • ৬:০০ – বন্ধুর সাথে আড্ডা বা কল
  • ৭:০০ – সীমিত সময় সোশ্যাল মিডিয়া (৩০ মিনিট)
  • ৮:০০ – হালকা গান / মুভি
  • ৯:০০ – ঘুমের প্রস্তুতি, স্ক্রিন-মুক্ত সময়

কেন এটা কাজ করে?
যখন আমরা নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ আনি, তখন আমাদের “ডিফার্ড গ্র্যাটিফিকেশন” বা বিলম্বিত আনন্দ উপভোগ করার ক্ষমতা বাড়ে। এতে জীবনের প্রতি গভীর তৃপ্তি আসে। একে বলে “ইন্ট্রিনসিক মোটিভেশন”, অর্থাৎ বাইরের উৎস নয়, নিজের ভেতর থেকেই অনুপ্রেরণার জন্ম হয়।

ডোপামিন মেন্যুর আরও উপকারিতা

  • ফোকাস এবং মনঃসংযোগ বৃদ্ধি পায়
  • সৃজনশীলতা ফিরে আসে
  • দীর্ঘমেয়াদি মানসিক প্রশান্তি তৈরি হয়
  • নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ বেড়ে যায়
  • ডিজিটাল আসক্তি কমে যায়

সবশেষে বলতে চাই “ডোপামিন মেন্যু” কোনো ম্যাজিক নয়। এটি একটি সচেতন জীবনযাপন পদ্ধতি, যেখানে আপনি আপনার আনন্দের রাসায়নিককে নিজেই “ম্যানেজ” করেন। সোশ্যাল মিডিয়ার বাইরেও একটা সৃজনশীল, শৃঙ্খলাবদ্ধ ও তৃপ্তিময় জীবন সম্ভব—শুধু দরকার একটু পরিকল্পনা আর নিজের প্রতি ভালোবাসা।

আরও যা পড়তে পারেন

কমেন্ট করুণ