দেশে ইসলামী ধারার ব্যাংকিংয়ের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব মোহাম্মদ আবদুল মান্নান। তিনি বর্তমানে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করছেন। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালন করেছেন এ প্রথিতযশা ব্যাংকার। দেশের ব্যাংক খাতের সার্বিক অবস্থা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনাসহ নানা বিষয়ে হ্যালো বাংলাদেশের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সিনিয়র রিপোর্টার ইকবাল হোসেন।
গত আট মাসে দেশের ব্যাংক খাতে কতটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে?
আট মাস আগে জানতাম না দেশের ব্যাংক খাত কোথায় আছে। এ খাতের স্বাস্থ্যের বাস্তব চিত্র কেমন। গত আট মাসে দেশের ব্যাংক খাতের প্রকৃত অবস্থা আমাদের সামনে দৃশ্যমান হয়েছে। দেশের ব্যাংক খাত ধ্বংসের মধ্যে ছিল। এ ধরনের অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা চলছে। এ সময় দেশের ব্যাংক খাত একটা বড় ধরনের যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে গেছে। বিশেষ যে ব্যাংকগুলোকে জোর করে সমস্যাগ্রস্থ করে ফেলা হয়েছে, সেগুলোকে সংগ্রাম করতে হচ্ছে। প্রায় তৈরি হচ্ছিলো না নতুন একাউন্ট।
ডুবতে বসা ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংককে টেনে তোলার চ্যালেঞ্জিং দায়িত্ব নিয়েছিলেন, এখন কি অবস্থা?
হঠাৎ করে একটা প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে আমাকে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান করা হয়। এখানে কি পরিস্থিতি মোকাবিলা করবো সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা ছিল না। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক আস্থা রেখে আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে। তারপর একটু সময় লেগেছে। বিষয়গুলো বুঝার জন্য, সেটা একটু চ্যালেঞ্জিং ছিল। ব্যাংকের ভেতরের প্রকৃত অবস্থাটা বুঝা ততটা সহজ না, কিছুটা বাঁধা ছিল। অনেকগুলো দেয়াল অতিক্রম করে আমাদের ব্যাংকের প্রকৃত অবস্থা বুঝতে হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের অডিট কার্যক্রম করে, রিপোর্ট এনে ব্যাংকের স্বাস্থ্য সম্পর্কে জানতে হয়েছে। আট মাস আগে দায়িত্ব নিয়ে এখন বুঝতে পারছি আমাদের ব্যাংকটি কি অবস্থায় পেয়েছি। অভ্যন্তরীন অডিট কার্যক্রম জোরদার করে এখানে যেসব মন্দ কাজ, নিয়মের বাইরে গিয়ে যে সমস্ত কাজ, এক কথায় বলা যায় যেসব লুটপাট হয়েছে – সেগুলোর প্রকৃত চিত্র বুঝতে পেরেছি।
ব্যাংকের সাধারণ নিয়মাচার ভঙ্গ করা হয়েছে। পাশাপাশি অসাধারণ আইন ভঙ্গের ঘটনাও ঘটেছে। ব্যাংকিং ইন্ডাস্ট্রিতে অনেকদিন কাজ করার কারণে দেশে ও বিদেশের ব্যাংকিং সিস্টেম সম্পর্কে আমার ধারণা রয়েছে। এখানে উল্লেখ করতে চাই হার্ভার্ড, স্ট্যানফোর্ড, অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজ, কলাম্বিয়া, ইউসি বার্কলেসহ বিশ্বের নামিদামি প্রতিষ্ঠান, যারা বিজনেস নিয়ে ডিল করে- এসব জায়গায় প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার মাধ্যমে আমার পদচারণার সুযোগ হয়েছে। সেখানে বিশ্বের ব্যাংকিং খাতের বিভিন্ন মন্দ কেস নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে এসে মনে হলো আমার সকল অভিজ্ঞতা, অর্জন, জ্ঞান ব্যাংকটির তখনকার অবস্থার তুলনায় একেবারে কিছু না। প্রতিদিন এমন সব বিষয় এখানে বের হয়েছে, যা দেখে অত্যন্ত আশ্চার্য হতে হয়েছে । এখানে লাখ লাখ গ্রাহকের পবিত্র আমানত নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়েছে। দুনিয়ার বিভিন্ন জায়গায় ব্যাংক খাতে মন্দ কাজের তথ্য মেলে, কিন্তু বাংলাদেশের কিছু ব্যাংকে যা ঘটেছে, তা বিশ্বে বিরল। বিশেষ করে এক ব্যক্তি ৭-৮টা ব্যাংকের মালিকানা জোর জবরদস্তি করে দখল করেছে। অত্যন্ত অবৈধ পন্থায়, অন্যায়ভাবে, এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে বিশেষ বাহিনী ব্যবহার করে ব্যাংকগুলো দখল করার পর লুটপাট করা হয়েছে। লুট করা অর্থ বিদেশে পাচার করেছে। এছাড়া বিভিন্ন ব্যাংক, বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগের নামে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। এভাবে নানা অপকৌশলের মাধ্যমে জনগণের আমানত লুটপাট করা হয়েছে।
বাংলাদেশের ব্যাংক সেক্টর ১৯৮০ সালের পর থেকে ক্রমশ বিকশিত হয়েছে। কিন্তু একটা সম্ভাবনাময় খাতকে কয়েক বছরে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ যেমন একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত অবস্থায় দেখেছি, আজকে ব্যাংকিং সেক্টরে ওই ধরনের ধ্বংস কার্যক্রম সংঘটিত হয়েছে। অনেকের চোখের সামনে, অনেকের অনুমোদনের ভিত্তিতে কাজটি হয়েছে। এটা বিশ্বের ইতিহাসে নজিরবিহীন।

মোহাম্মদ আবদুল মান্নান
গ্রাহকের আস্থা ফিরিয়ে আনতে আপনারা কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন?
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে জাকাতের টাকা পর্যন্ত চুরি করা হয়েছে। বিধ্বস্ত অবস্থার মধ্যে ব্যাংকটির দায়িত্ব নিয়েছি। দায়িত্ব নেওয়ার পর আমাদের ব্যাংকের বোর্ডে ব্যাংকিং শুদ্ধাচার, নিয়মাচার পরিপূর্ণভাবে মানার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এ ব্যাংকটি শরিয়াহ মোতাবেক পরিচালনার কমিটমেন্ট রয়েছে। শতভাগ শরিয়াহ পরিপালনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাদের কোনো ম্যানেজার, অফিসার যদি শরিয়াহ পরিপালন না করে, তবে তাদের এসিআরে লাল দাগ পড়বে। তারা প্রমোশন পাবে না। এ ধরনের পদক্ষেপ আমরা নিয়েছি। ব্যাংকে নিয়মাচার অনুসরনের ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছি।
দায়িত্ব নেওয়ার পর দেখলাম গ্রাহকের আস্থা অনেক নষ্ট হয়েছে। তখন জনগণের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। আমাদের জনশক্তিকে উদ্বুদ্ধ করেছি। মাছের জন্য যেমন পানি দরকার, তেমনি ব্যাংকারের জন্য জনগণই হচ্ছে আধার। ব্যাংক মানে হচ্ছে ট্রাস্ট বা জনগণের আস্থা। এটি রক্ষা করার ব্যাপারে আমাদের আমানতদারিতা পরিচয় দিতে হবে। এখন থেকে আট মাস আগ পর্যন্ত আমাদের ব্যাংকের যে অবস্থা ছিল, সেটিকে সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে দিয়েছি। আমরা শতভাগ জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি। জনগণের আমানত সুরক্ষার নিশ্চয়তা বিধান করা ও হেফাজত করা আমাদের বর্তমান বোর্ডের দায়িত্ব। এ কাজটা আমরা করছি এবং জনগণের কাছে যাচ্ছি। গত সাত মাসে ৭ লাখ ৩২ হাজার নতুন একাউন্ট করেছি। জনগণের কাছে গিয়েছি, আমাদের সেবা ও কার্যক্রম সম্পর্কে তাদের কাছে তুলে ধরেছি। এরচেয়ে বড় সুখবর হচ্ছে জনগণ আমাদের দিকে সাহায্য, সহযোগিতা, সহমর্মিতা, বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। তারা আমাদের প্রতি আস্থা রাখছেন বলেই প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার নতুন ডিপোজিট পেয়েছি।
যেসব জায়গায় আমাদের ব্যাংক বিনিয়োগ করেছে, যাদের কাছে কর্মকর্তারা আগে যেতে সাহস করতো না, ঋণ শ্রেণীকরণ করতো না। আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পরে বলেছি ক্লাসিফাইড না করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। গ্রাহরাও বুঝেছেন অতীতে যাই ঘটুক না কেন, এখন এ ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন স্বাভাবিক অবস্থায় থাকতে হলে ব্যাংকের টাকা ফেরত দিতে হবে। এভাবে আমরা খুব অল্প সময়ে সোয়া দুই হাজার কোটি টাকা অনাদায়ী পাওনা আদায় করেছি। নতুন একাউন্ট খোলার প্রতি বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। যে সাত লাখ নতুন গ্রাহক আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন, তাদের ভালো সেবা প্রদানের মাধ্যমে আস্তে আস্তে এ সংখ্যা অনেক বাড়বে।
আগামীতে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংককে কোন পর্যায়ে নিয়ে যেতে চান?
এ ব্যাংকের সবচেয়ে দুর্বল একটা দিক হলো বিনিয়োগ পোর্টপোলিও। আমরা ৩০ লাখের মতো ডিপোজিটের জন্য নতুন একাউন্ট পেয়েছি। এ ডিপোজিটের ৯৯ শতাংশ মুষ্টিমেয় কিছু লোকের কাছে গেছে, যাদের সংখ্যা ১০০ জনের কম। এসব বিনিয়োগের অধিকাংশই চলে যায় চট্টগ্রাম ও ঢাকার ছোট একদল গ্রাহকের কাছে। চট্টগ্রামে ৮০ শতাংশ ও ঢাকায় ১৯ শতাংশ বিনিয়োগ হয়েছে। অন্য ব্যাংকগুলোতে উল্টো চিত্র দেখা যায় ঢাকায় ৬০ শতাংশ ও চট্টগ্রামে ২০ শতাংশ বিনিয়োগ হয়েছে। আমাদের ব্যাংকের ৯৯ শতাংশ বিনিয়োগ চট্টগ্রাম ও ঢাকায় কতিপয় গোষ্ঠীর কাছে, বাকি এক শতাংশ সারাদেশে। আমরা এ অবস্থা ঘুরিয়ে দেয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। শুধুমাত্র পদ্ধতিগতভাবে নয় উদ্দেশ্যগতভাবেও যাতে এ ব্যাংকটা ঘুরে দাঁড়াতে পারে সে লক্ষ্যে কাজ করছি। একটা ভালো ইসলামি ব্যাংক হতে পারে, সারা বিশ্বের জন্য এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করবো।
ব্যাংকিং খাতে বড় সমস্যা গ্রাহকরা চাহিদা মতো টাকা তুলতে পারছিলেন না। আপনাদের ব্যাংকেও এ সমস্যাটা ছিল, এখন কি অবস্থা?
আগে যারা ব্যাংকটির মালিক ছিল, তারা চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন। ব্যাংকটিকে খুব বাজে অবস্থায় রেখে গেছে। সে অবস্থা থেকে আস্তে আস্তে বের করে এনেছি। প্রথমদিকে কিছু দিন আমাদের গ্রাহকরা অনেক ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন। তখন একটা চেক আমরা একদিনে পুরো পেমেন্ট করতে পারিনি। ভেঙ্গে ভেঙ্গে কয়েক দফায় দিয়েছি। এখন আমরা মোটামুটিভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। জমা এবং উত্তোলন প্রায় সমান।
লুটপাটের কারণে ব্যাংক খাতে যে সংকট তৈরি হয়েছে তা কিভাবে কাটিয়ে উঠা সম্ভব?
জনগনে আস্থার মাধ্যমে এটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। যেকোনো সমস্যার সমাধান হচ্ছে জনগণের সঙ্গে কানেক্টিভিটি। একা একা ব্যাংক করতে পারবেন না। ব্যাংক হচ্ছে আস্থার জায়গা। জনগণের আস্থা নিয়ে এগিয়ে যেতে হয়। অনেক লুটপাটের পরও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে। শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে। এগুলো জনগণের প্রচেষ্টার ফল। বেসরকারি খাত সরকারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকেনি।
জনগণ এবং ব্যাংকার বিচ্ছিন্ন নয়। একসঙ্গে মিলে নৈতিকতা ঠিক রেখে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। আমাদের দেশে আইনের সংকট নেই , আইন মানার সংকট রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যেসব নিয়মাচার দেওয়া হয়েছে, সেগুলো সঠিকভাবে পালন করতে হবে। নতুন একাউন্ট তৈরিতেও দায়িত্বশীল হতে হবে।
ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে যারা আছেন তারা যদি ক্ষমতার অপব্যবহার না করেন, জনস্বার্থের বাইরে যদি কোন সিদ্ধান্ত না নেয়া হয় তাহলে ভালো করা সম্ভব। মূল বিষয় হচ্ছে পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কাঠামো ঠিক করতে হবে। নতুন একাউন্ট বাড়াতে হবে। ম্যানেজমেন্টের কর্মকর্তাদের সব ধরনের ভয়ের ঊর্ধ্বে উঠে শুধু নিয়মের অনুসরণ করবে। পরিচালনা পর্ষদে যোগ্যতাসম্পন্ন লোকদের নিতে হবে।