Home পরিবেশ চা শ্রমিকদের মধ্যে বাড়ছে নিরাপদ পানি ও টয়লেটের ব্যবহার

চা শ্রমিকদের মধ্যে বাড়ছে নিরাপদ পানি ও টয়লেটের ব্যবহার

নিজস্ব প্রতিবেদক
১৫৫ views

চা বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল ও রপ্তানি পণ্য। দেশের জিডিপি ও অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখা এ রকম গুরুত্বপূর্ণ একটি খাতের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের ৭৪ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। বর্তমানে একজন চা শ্রমিকের দৈনিক মজুরি মাত্র ১৭০ টাকা।

অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা এই শ্রমিকরা নিরাপদ পানি ব্যবহার ও উন্নত স্যানিটেশনের সুবিধা থেকেও বঞ্চিত। আগ্রহ থাকলেও টয়লেট ও টিউবওয়েল বসানোর মতো আর্থিক সক্ষমতা তাদের নেই। অথচ নিরাপদ পানি ও উন্নত স্যানিটেশন নিশ্চিত করা ও দেখভালের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সবার। কিন্তু বাগান কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে উদাসীন।

এ অবস্থায় এগিয়ে এসেছে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)। চা শ্রমিকদের সহজ ঋণ উপকরণের মাধ্যমে নিরাপদ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা এবং টয়লেট নির্মাণ করে দিচ্ছে পিকেএসএফ। এতে চা-জনগোষ্ঠীর মধ্যে দিনদিন নিরাপদ পানি ও টয়লেটের  ব্যবহার বাড়ছে।

শ্রীমঙ্গলের রিয়াজিবাজার এলাকায় পাতাকুঁড়ি সোসাইটি ও হবিগঞ্জের হবিগঞ্জ উন্নয়ন সমিতির মাঠ পর্যায়ের কার্যক্রম পরিদর্শনে সম্প্রতি এ চিত্র উঠে এসেছে। সেখানে কথা হয় চা শ্রমিকদের সঙ্গে। তারা জানান, আগে তাদের মধ্যে সচেতনতার অভাব ছিল।  অধিকাংশ সময় তারা খোলা জায়গায় মলত্যাগ করতেন। এর ফলে তাদের অনেক রোগ হতো।  পিকেএসএফের সহায়তায় এখন তারা নিরাপদ ব্যবস্থাপনায় দুই গর্তের  টয়লেট নির্মাণ করেছেন। এতে তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি কমেছে এবং রোগ-বালাইও কম হচ্ছে।

রিয়াজিবাজার এলাকায় চা-শ্রমিক কৃষ্ণা দাস জানান, আগে দিনে কিংবা গভীর রাতে ছড়াতেই তাদের টয়লেট সারতে হতো। তার খুবই ভয় হতো যেতে। কিন্তু কিছু করার ছিল না। তিনি জানালেন, রাত ২টা হলেও আমাদের ছড়ায় যেতে হতো। বারবার আকুতি জানালেও শুনতো না কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এখন অবস্থা পাল্টেছে। পিকেএসএফের সহায়তায় তারা ঘরের পাশেই দুই গর্তের টয়লেট নির্মাণ করেছেন। এতে তাদের খরচও কম হয়েছে। এখন আর তাদের ছড়ায় যেতে হয় না।

পিকেএসএফের উদ্যোগ  
বাংলাদেশ সরকার পিকেএসএফ ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের মাধ্যমে ২০২১ থেকে ২০২৫ সাল মেয়াদে ‘মানবসম্পদ উন্নয়নে গ্রামীণ পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যবিধি প্রকল্প’ বাস্তবায়ন করছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের সকল নাগরিকের জন্য নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যবিধি এবং এ সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করা হচ্ছে। পাশাপাশি জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট-৬-এর লক্ষ্য অর্জনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। বিশ্বব্যাংক এবং এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের (আইইবি) যৌথ অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় পিকেএসএফ ঋণ উপকরণের মাধ্যমে নিরাপদ পানি সরবরাহ ব্যবস্থা এবং টয়লেট নির্মাণের জন্য ৮৭টি সহযোগী সংস্থার মাধ্যমে দেশের ৮টি বিভাগের ৩০টি জেলার ১৮২টি উপজেলায় বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। 

DSC08176.JPG.vN5wCf 1
নিরাপদ ব্যবস্থাপনায় এই ধরনের দুই গর্তের  টয়লেট ব্যবহার করেন চা-শ্রমিকরা । ছবি: পিকেএসএফ

কর্মকর্তারা জানান, প্রকল্পের আওতায় মানুষের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতে দেশের ৩০টি জেলায় ইতিমধ্যে প্রায় ৩ লাখ দুই গর্ত বিশিষ্ট টয়লেট নির্মাণ করেছে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)।

তারা জানান, নিরাপদ ব্যবস্থাপনায় দুই গর্তের টয়লেটের কারিগরি বিষয়ে প্রকল্প বাংলাদেশে এটিই প্রথম। পাশাপাশি গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মাঝে নিরাপদ ব্যবস্থাপনায় দুই গর্তের  টয়লেটের ধারণা একেবারে নেই বললেই চলে। টয়লেটের কারিগরি বিষয় এবং স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রকল্পের আওতায় গ্রামীণ জনসাধারণের জন্য নির্ধারিত ৫টি বিষয়ে আচরণ পরিবর্তন যোগাযোগের (বিসিসি) কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। এর মাধ্যমে নিরাপদ ব্যবস্থাপনায় পানি সরবরাহ, নিরাপদ ব্যবস্থাপনায় স্যানিটেশন, হাত ধোয়া, শিশুর ওয়াশ আচরণ এবং মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়ে গ্রামীণ এলাকায় জনসাধারণের মাঝে সচেতনতা বাড়ানো ও সঠিক ওয়াশ আচরণে উদ্বুদ্ধ করার কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

নারী চা-শ্রমিকদের জীবন  
সারা দেশে ১৬৭টি চা-বাগান আছে। দেশের চা-বাগানগুলোয় কয়েক লাখ শ্রমিক কাজ করছেন। এর মধ্যে নারী শ্রমিক ৮৫ শতাংশের বেশি। এই শ্রমিকদের আছে আলাদা জীবনধারা, ভাষা ও সংস্কৃতি। মৌলভীবাজার জেলাতেই আছে ৯২টি চা–বাগান। 

জেলার বিভিন্ন চা–বাগানের একাধিক নারী শ্রমিক জানান, খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হয়। সংসারের কাজ করতে হয়। বাগান দূরে হলে আগেভাগে রওনা দিতে হয়। প্রতি সপ্তাহে সোম থেকে শনিবার সকাল আটটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত কাজ করতে হয়। কেউ সকাল খেয়ে বের হন, কারও সময় না থাকলে বাটিতে খাবার নিয়েই ছুটতে হয়। দুপুরের খাবার বলতে চাল ভাজা, চায়ের কুঁড়ি পাতা, পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ ইত্যাদি দিয়ে বানানো ‘পাতিচখা’ বা ‘পাতি চাটনি’। লাইনে (শ্রমিকদের বসতি) ফিরতে ফিরতে কারও সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত আটটা বেজে যায়। ঘরে ফিরে আবার সংসারের কাজ।

DSC08292 1
শিশুর জন্য উন্নত ওয়াশ আচরণ নিয়ে উঠান বৈঠকে হবিগঞ্জ উন্নয়ন সংস্থার ক‍র্মক‍র্তা ও সদস্যরা । ছবি: পিকেএসএফ

চা-বাগানে বর্তমানে দৈনিক মজুরি ১৭০ টাকা। এ মজুরি পেতে বাগানভেদে ২০ থেকে ২৫ কেজি চা–পাতা তুলতে হয় নারী শ্রমিককে। বাড়তি চা-পাতা তুললে যে পরিমাণ টাকা পাওয়ার কথা, তাও পান না বেশিরভাগ নারী শ্রমিক। চা-পাতা তোলার স্থানে গাড়ি থাকার কথা। কিন্তু অনেক বাগানেই গাড়ি থাকে না। অনেক নারী চা-শ্রমিককে উত্তোলিত পাতা ওজন করে জমা দেওয়ার জন্য পাতাগুলো পিঠে করে তিন থেকে পাঁচ কিলোমিটার পর্যন্ত দূরে যেতে হয়। রোদ-বৃষ্টিতে ভিজে এ কাজ করতে হয়। বৃষ্টির সময় রেইনকোট দেওয়ার কথা। কিন্তু তা দেওয়া হয় না বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। সেকশনে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা থাকার কথা, তাও থাকে না।

সাতগাঁও চা-বাগানের নারী শ্রমিক কাজল রায় আলাপকালে বলেন, চা শ্রমিকদের কারও ৫ জনের সংসার, কারও সংসার ৮ জনের। ৮ জনের সংসারে রোজগার করেন ১ বা ২ জন। অথচ এর বিপরীতে তাদের দৈনিক ইনকাম ১৭০ টাকা-ই। অন্যদিকে দ্রব্যমূল্যের বাজারে আগুন। তাই খেয়ে না খেয়ে থাকতে হয় অসংখ্য চা শ্রমিকের।

তিনি জানান, নারী শ্রমিকদের জন্য বাগানে তেমন সুযোগ-সুবিধা নেই। নারী শ্রমিকদের জন্য কোনো শৌচাগার নেই। বাধ্য হয়ে নারীরা খোলা জায়গা ব্যবহার করেন বা প্রস্রাব-পায়খানা দীর্ঘক্ষণ আটকে রাখেন। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ে। পিরিয়ড বা মাসিকের সময় অপরিষ্কার কাপড় ব্যবহার করেন বা অনেকে নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর উপায় অবলম্বন করেন।

চা-শ্রমিক মলিন দাস বলেন, বাবা, খুবই অসুবিধায় আছি আমরা। অনেক দাবির পর মজুরি করলো ১৭০ টাকা। কিন্তু বর্তমান সময়ে এটি কোনো টাকা? সাথে সপ্তাহে দেয় ৩ কেজি আটা। আমার পাঁচজনের সংসার। এই টাকা ও আটা দিয়ে সংসার চালাই কিভাবে?

তিনি জানান, অসংখ্য শ্রমিক দুই বেলা ভাত খেতে পারে না। অনেক সময় আটাও খেতে পারে না।  মালিকরা বলে, আমরা ভালো আছি। কিন্তু কিভাবে বুঝাই, আমরা যে দারিদ্রের আঘাতে নিস্পেষিত। ধারের ভারে জর্জরিত। আমরা শিক্ষা, চিকিৎসাসহ সবকিছু থেকেই বঞ্চিত।

আরও যা পড়তে পারেন

কমেন্ট করুণ