একটি সাহিত্যিক রিভিউ
‘পরমা’ ১৯৮৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত অপর্ণা সেন পরিচালিত সিনেমা। প্রথমদিকে অনেকেই এই সিনেমাকে সহজভাবে নিতে পারেননি। সময়ের সাথে এখন সে ভাবনা পাল্টেছে। মহিলারা তাদের ন্যায্যতা আদায়ে অনেকগুণ বেশি সরব। অপর্ণা সেন তার এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ১৯৮০এর পর মহিলাদের কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পেলেও মহিলাদের জীবন ও যৌন-জীবনের সিদ্ধান্ত যে তারই, সেই ঘটনাটা এই সিনামাতে প্রথম উঠে এসেছে। লিঙ্গভিত্তিক সম্পর্কগুলো যেমন, স্ত্রী, মা, বৌমা, ভাবি, ননদ, কাকি ইত্যাদি থেকে বেরিয়ে স্বীয় সত্তার কাছে ফেরত আসার দারুন এক গল্প ‘পরমা’। সাধারণভাবে দেখলে মনে হবে সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্রে পরমার পারিবারিক জীবনে সুখের ঘাটতি ছিলনা। ভাল মা, ভাল স্ত্রী, ভাল ঘরণী, সুন্দরী ও রুচিশীল- এসবের গৌরব তারও কম ছিলনা। সমাজ যেরূপে মহিলাদর দেখতে চায় সেরূপে সে ছিল অনন্যা। কিন্তু কতজন পরমা পারেন নিজেকে ধোঁকা দিয়ে একটা গোটা জীবন পার করে দিতে? অপর্ণা সেনের পরমা পারেনি। এই প্রথম নিজের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়ে সে নিজের নিখাঁদ অনুভবের সঙ্গে পরিচিত হল, সে প্রেমেও পড়ল। দারুন অপরাধবোধে ভুগত। এক সময় ‘ধরাও’ পড়ল। নিজের মনের সাথে ক্রমাগত প্রশ্ন-উত্তরের সম্মুখীন হতে হতে পরিবার ও সমাজের মানুষের চোখে মুহূর্তে ছোট বনে যাওয়া পরমাকে সুইসাইডের সামনাও হতে হয়। পরমা কি খারাপ মানুষ? শিশুকালে দেখা একটি গাছ হাসপাতালের বারান্দায় আবিষ্কার করার মধ্য দিয়ে নিজের পবিত্রবোধকে পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয় পরমা। অলীক সুখের সংসার ছেড়ে নিজের মত ছোট্ট চাকুরী নিয়ে টিকে থাকতে পারার মত দুঃসাহস সে সহজেই দেখতে পারে তখন। কামনা-বাসনা নয়, বরং নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজ বিবেচনায় নেওয়ার জায়গাটা পরমার মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে। প্রেম নিঃসন্দেহে পরমার মাঝে সুপ্ত গুনগুলিকে জাগিয়ে দিয়েছে, কিন্তু তার অস্তিত্ব প্রেমিকের অনুপস্থিতে শেষ হবার নয়। এই সিনেমায় আমার প্রিয় একটা দৃশ্য হল সিনেমার শেষাংশে মানসিক হাসপাতালে। সেখানে পরিবারের সকলে উপস্থিত। ডাক্তার সবাইকে বলেন, সময়ের সাথে পরমার অপরাধবোধ কেটে গেলে সে আবার আগের পরমা হয়ে যাবে। অর্থাৎ, ভাল গৃহবধূ পরমা। জবাবে পরমা বলে, ‘‘কিন্তু আমার তো অপরাধবোধ নেই।’’