বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চর দখলের মতো ব্যাংক দখল করেছিল এস আলম শিল্পগ্রুপ। ইসলামী ধারার ছয়টিসহ আটটি ব্যাংক দখল নিয়েছিল এ কোম্পানিটি। আওয়ামী লীগের ক্ষমতা হারানোর পর একে একে সব ব্যাংক হাতছাড়া হয়েছে এস আলমের। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার এ গ্রুপের কবজায় থাকা আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদও ভেঙে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এস আলমের হাতছাড়া হওয়া আটটি ব্যাংক হল: ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক।
ইসলামী ব্যাংক: গত ২২ আগস্ট এস আলমের নেতৃত্বাধীন পর্ষদ ভেঙে দিয়ে ইসলামী ব্যাংকে পাঁচজন স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক; যাদের মধ্যে নতুন চেয়ারম্যান করা হয়েছে সাবেক ব্যাংকার মো. ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদকে।
এদিন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ইসলামী ব্যাংকে দেওয়া চিঠিতে আগের পরিচালনা পর্ষদ বাতিল করার সিদ্ধান্তও জানানো হয়। ওই পর্ষদের চেয়ারম্যান ছিলেন আহসানুল আলম, যিনি আলোচিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলমের ছেলে।
২০১৭ সালে ‘জোরজবরদস্তি’ করে ইসলামী ব্যাংকের দখলে নেয় এস আলম গ্রুপ। তারপর নামে বেনামে ব্যাংক থেকে ঋণ বের করে নেয় গ্রুপটি। তাতে অবনতি ঘটে ব্যাংকটির। শুধু ইসলামী ব্যাংক থেকেই গ্রুপটি ৭৫ হাজার কোটি টাকা বের করে নেয়।
ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলনের মধ্যে সরকার পতনের পরদিনই এস আলম মুক্ত করতে বিক্ষোভ ও আন্দোলনে নামে ইসলামী ব্যাংকের কর্মীরা। এ নিয়ে গত ১১ আগস্ট গোলাগুলির ঘটনাও ঘটে। ইসলামী ব্যাংক ও এস আলম নিয়ে আলোচনার মধ্যেই ব্যাংকটি নিয়ে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়া শুরু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছিলেন, “ইসলামী ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ বের করা হয়েছে। সেই টাকা ব্যাংকে এখনও ফিরে আসেনি। ইসলামী ব্যাংক নিয়ে অডিট করা হবে। নতুন পর্ষদ ব্যাংকে টাকা ফেরত আনার চেষ্টা করবে।”

সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক: গত ২৬ আগস্ট সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড (এসআইবিএল) বিতর্কিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের রাহুমুক্ত হয়েছে। ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ বাতিল করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সম্প্রতি সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের নতুন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন অধ্যাপক ড. এম সাদিকুল ইসলাম। তিনি প্রায় ৩৮ বছর ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগে শিক্ষকতা করছেন।
২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর রাজধানীর ওয়েস্টিন হোটেলে অনুষ্ঠিত বিশেষ সভায় চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপ সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেয়। আগের দিন রাতে ব্যাংকটির তৎকালীন চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও কোম্পানি সচিবকে তুলে নিয়ে যায় প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা। ব্যাংকটি দখলের পর চেয়ারম্যান করা হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আনোয়ারুল আজিম আরিফকে। ব্যাংকটির সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান বেলাল আহমেদ হচ্ছেন এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলমের জামাতা।
এসআইবিএলের মালিকানা পরিবর্তনের সময়ই এস আলম গ্রুপ কয়েকজন উদ্যোক্তা ও পরিচালককে বাদ দেয়। এরপর তারা ব্যাংকটি থেকে নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ টাকা বের করে নেয়। যে কারণে ব্যাংকটি ইতিমধ্যে আর্থিক সংকটে পড়েছে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে রক্ষিত চলতি হিসাবেও ঘাটতিতে রয়েছে। এই ব্যাংকে কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে চট্টগ্রামের পটিয়ার বাসিন্দাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
মালিকানা পরিবর্তনের সময় ব্যাংকটির বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা, যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। নতুন ১৫ হাজার কোটি টাকা ঋণের বড় অংশই এস আলম গ্রুপ ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে নেওয়া হয়েছে বলে জানান ব্যাংকটির কর্মকর্তারা।
আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক: গত ৩ সেপ্টেম্বর আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকটিতে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের পর চেয়ারম্যান ঠিক করে দিয়ে পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে দেওয়া হয়েছে।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নীরবে এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদ থেকে সরে যান আবদুস সামাদ। তিনি এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলমের (এস আলম) ভাই। এরপর ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আসেন কেডিএস গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা খলিলুর রহমানের ছেলে সেলিম রহমান। ব্যাংকটির পরিচালক ছিলেন এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের সাবেক এমডি এ কে এম জাকারিয়া ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের সাবেক এমডি কাজী ওসমান আলী ও ইসলামী ব্যাংকের সাবেক এমডি আবদুল হামিদ মিয়া।
এই ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে ঋণ তুলে নেয় এস আলম গ্রুপ। আবার এস আলমের মালিকানাধীন অন্য ব্যাংকে বড় অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করে আটকে গেছে ব্যাংকটি। এতে আমানতকারীদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আল–আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের নতুন চেয়ারম্যান করা হয়েছে লংকাবাংলা ফাইন্যান্সের সাবেক এমডি খাজা শাহরিয়ারকে।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক: গত ২ সেপ্টেম্বর বিতর্কিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের কবজা থেকে মুক্ত হয়েছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক। গত রোববার ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকটির নতুন চেয়ারম্যান করা হয় ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ আবদুল মান্নানকে। যখন এস আলম গ্রুপ ইসলামী ব্যাংক দখল করে, তখন আবদুল মান্নানকে তুলে নিয়ে পদত্যাগ করানো হয়েছিল। এখন তাকেই এস আলমের মালিকানাধীন এই ব্যাংক পুনরুদ্ধারের দায়িত্ব দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম নিজেই ছিলেন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান। এ ছাড়া ব্যাংকটিতে পরিচালক ছিলেন তাঁর স্ত্রী ফারজানা পারভীন, বোন আতিকুর নেসা ও ভাই মোহাম্মদ আবদুল্লাহ হাসান।
২০০৪ সালে সিকদার গ্রুপের কাছ থেকে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় এস আলম গ্রুপের কাছে। তখন থেকে এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম নিজেই। নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর ব্যাংকটিকে ইসলামি ধারার ব্যাংকে রূপান্তর করা হয়। ব্যাংকটির দেওয়া ঋণের পরিমাণ এখন প্রায় ৫৬ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ঋণের মধ্যে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকাই রয়েছে এস আলম গ্রুপ ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্টদের নামে।
ন্যাশনাল ব্যাংক: গত ২০ আগস্ট বেসরকারি ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বিলুপ্ত করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে ব্যাংকটি পরিচালনার জন্য নতুন পর্ষদ গঠন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ন্যাশনাল ব্যাংকের নবগঠিত পরিচালনা পর্ষদের নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান হয়েছেন স্বতন্ত্র পরিচালক মুখলেসুর রহমান। গত ২২ আগস্ট তাকে চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। মুখলেসুর রহমান বাংলাদেশের ব্যাংকিং ইন্ডাস্ট্রির একজন দক্ষ ও পেশাদার ব্যাংকার।
ব্যাংকিং খাতের সূত্রগুলো জানিয়েছে, ন্যাশনাল ব্যাংকের আগের পরিচালকদের অনেকেই ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের নামে-বেনামে থাকা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি ছিলেন। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই পদক্ষেপের মাধ্যমে ব্যাংকটিকে এস আলম গ্রুপের হাত থেকে মুক্ত হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
সংকটে থাকা বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সর্বশেষ গত মে মাসে পুনর্গঠন করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এর সাড়ে চার মাস আগে আরও একবার ব্যাংক পর্ষদ পুনর্গঠন করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ন্যাশনাল ব্যাংক একসময় নিয়ন্ত্রণ করত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী সিকদার গ্রুপ। মে মাসে পর্ষদ পুনর্গঠনের সময় সিকদার গ্রুপকে ব্যাংক থেকে বের করে চেয়ারম্যান করা হয় চট্টগ্রামের কেডিএস গ্রুপের চেয়ারম্যান খলিলুর রহমানকে।
সে সময় পুনর্গঠিত পর্ষদে অন্য পরিচালকদের অনেকে এস আলম গ্রুপ–সংশ্লিষ্ট ছিলেন। স্বতন্ত্র পরিচালকদের একজন ছিলেন হিসাববিদ রত্না দত্ত, যিনি এস আলম গ্রুপের প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা (সিএফও) সুব্রত কুমার ভৌমিকের স্ত্রী। আরেক পরিচালক এহসানুল করিম ছিলেন এস আলম গ্রুপের আইনজীবী। নতুনভাবে গঠিত পর্ষদে তাঁদের সবাইকে বাদ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে ন্যাশনাল ব্যাংক প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা সুদ মওকুফের সুবিধা দিয়েছিল এস আলম গ্রুপকে।
কমার্স ব্যাংক: গত ৩ সেপ্টেম্বর এস আলমমুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক। এদিন ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে প্রতিষ্ঠানগুলোকে আলাদা চিঠিতে তা জানিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কমার্স ব্যাংকের নতুন চেয়ারম্যান করা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মো. আতাউর রহমানকে।
বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ৫১ শতাংশ শেয়ারের মালিক সরকারি ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানগুলো। ২০১৫ সালে এ ব্যাংকের পুরো নিয়ন্ত্রণ চলে যায় বিতর্কিত শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের হাতে। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে ব্যাংকটিতে চেয়ারম্যান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালকও নিয়োগ দেয় এই গ্রুপ। তাদের মালিকানাধীন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে আটকা পড়েছে ব্যাংকটির ১ হাজার ৩১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে তাদের মালিকানাধীন অন্য ব্যাংকগুলোয় ৬১০ কোটি টাকা আটকে রয়েছে। এ ছাড়া এস আলম ও প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারের আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আটকে আছে বাকি ৭০০ কোটি টাকা। নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেলেও এসব টাকা ফেরত পাচ্ছে না কমার্স ব্যাংক। বেশির ভাগ বিনিয়োগ থেকে সুদও পাচ্ছে না। ব্যাংকটিতে প্রায় ৬০০ জনবল নিয়োগ দিয়েছে এস আলম গ্রুপ।
ইউনিয়ন ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক: গত ২৭ আগস্ট আলোচিত ব্যবসায়িক গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকা ইউনিয়ন ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এদিন ইউনিয়ন ও গ্লোলাব ইসলামী, দুই ব্যাংকেই স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়।
ইউনিয়ন ব্যাংকে চেয়ারম্যান ও স্বতন্ত্র পরিচালক পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মু ফরীদ উদ্দীন আহমদকে।
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের পর্ষদের চেয়ারম্যান করা হয়েছে মেঘনা ব্যাংকের সাবেক এমডি মোহাম্মদ নুরুল আমিনকে।