অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে দেশের ২৪টি জেলার কৃষি ব্যাপকভাবে ক্ষতির শিকার হয়েছে। এ ছাড়া বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে দেশের ১১টি জেলার ৫৪১টি ইউনিয়ন ও পৌরসভা। কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতের ক্ষতি ছাড়াও এসব অঞ্চলের বসতবাড়ি, অবকাঠামো ও ব্যবসা-বাণিজ্যেরও ক্ষতি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ন্যূনতম হিসাব বিচেনায় বন্যায় এ পর্যন্ত সরাসরি আর্থিক ক্ষতি ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়াবে।
তাদের মতে, জেলা পর্যায়ে কৃষিবহির্ভূত অন্য খাতে ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়। বিশেষ করে ছোট ও ক্ষুদ্র ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, গ্রামীণ অর্থনীতির বিভিন্ন উপখাত এবারের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবার বন্যা আক্রান্ত জেলাগুলোর আশপাশের জেলাগুলোও ক্ষতির শিকার হয়েছে। বসতবাড়ি ও অবকাঠামো মিলিয়ে এসব খাতে ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে।
আর কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে ক্ষতি ছাড়িয়েছে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত বন্যায় দেশের অর্থিক ক্ষতি অন্তত ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানায়, দেশের বন্যা আক্রান্ত জেলাসমূহ হলো- ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, সিলেট, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজার। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত লোক সংখ্যা ৫০ লাখ ২৪ হাজার ২০২ জন। এদের মধ্যে মৃতের সংখ্যা মোট ৭১ জন। যারমধ্যে পুরুষ ৪৫, মহিলা সাত ও শিশু ১৯ জন। জেলাভিত্তিক মৃত্যুর সংখ্যা কুমিল্লায় ১৯, ফেনীতে ২৮, চট্টগ্রামে ছয়, খাগড়াছড়িতে এক, নোয়াখালীতে ১১, ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায় এক, লক্ষ্মীপুরে এক, মৌলভীবাজারে এক ও কক্সবাজারে তিন জন।
কৃষি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, এবারের বন্যায় অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর অবস্থায় পড়ে আক্রান্ত জেলাগুলো। গ্রামীণ অর্থনীতির কৃষি ও অকৃষিজ কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে পড়েছে। ফলে সরাসরি ক্ষতি ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি হলে প্রকৃত ক্ষতি আরো অনেক বেশি হবে। তবে আশার দিক হলো, আমাদের দেশের মানুষ এই বন্যায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে একে অন্যের পাশে দাঁড়িয়েছে। ত্রাণ সহায়তা কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের সংগঠিত উদ্যোগ দেশের মানুষের মধ্যে আশার সঞ্চয় করেছে। বন্যার্তদের সাহস জুগিয়েছে। তবে বন্যার পানি সরে গেলে সব মানুষের জন্য সরাসরি নগদ সহায়তা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ওষুধ, কৃষিতে সার ও উপকরণ সহায়তা জোরদার করতে হবে। তাহলে ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে।’
কৃষির ক্ষতি: কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, এবারের বন্যায় ২৪টি জেলার কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব জেলার ১৭ লাখ ৭২ হাজার ৮৮০ হেক্টর জমিতে ফসল আবাদ করা হয়েছিল। এসব ফসলের মধ্যে তিন লাখ ৪৪ হাজার ৬৭৬ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বর্তমানে এসব জেলার অন্তত ২০ শতাংশ ফসলি জমি বন্যায় আক্রান্ত। ক্ষতির শিকার হওয়া আবাদি জমির মধ্যে রয়েছে : আউশ ৭০ হাজার ৬১৯ হেক্টর, আমন দুই লাখ ২০ হাজার ৬৩৪ হেক্টর, বোনা আমন চার হাজার ৩৫১ হেক্টর, রোপা আমন বীজতলা ১৯ হাজার ৭৭৫ হেক্টর।

এ ছাড়া শাক-সবজি ১৫ হাজার ৫৬১ হেক্টর, আদা ১৬১ হেক্টর, হলুদ ২৪৬ হেক্টর, আখ ৬৫৭ হেক্টর, পান ৬৪৭ হেক্টর, ফলের বাগান ১১ হাজার ৮০০ হেক্টর, মরিচ ১২৭ হেক্টর, তরমুজ ৫৬ হেক্টর, পেঁপে ২৩ হেক্টর, ভুট্টা তিন হেক্টর, পেয়াঁজ এক হেক্টর ও গ্রীষ্মকালীন টমেটো ১৫ হেক্টর। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত কৃষি খাতে আর্থিক ক্ষতি ছাড়িয়েছে অন্তত তিন হাজার কোটি টাকা।
কৃষি বিশ্লেষকরা বলছেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এসব জমিতে প্রায় ২০ লাখ টনের বেশি শস্য উৎপাদন সম্ভব হতো। যদি পুনর্বাসনপ্রক্রিয়া সঠিকভাবে না করা যায়, তাহলে কৃষিজ পণ্য উৎপাদন ও দেশের খাদ্য নিরাপত্তা বিপুলভাবে বাধাগ্রস্ত হবে।
জানা গেছে, বন্যায় দেশের বিভিন্ন জেলায় কৃষিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তবে ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে মন্ত্রণালয় থেকে পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। এরই মধ্যে ১৯৩ কোটি টাকার সহায়তা কার্যক্রম নেওয়া হয়েছে। এর আওতায় দেশের ছয় লাখ কৃষক প্রণোদনা পাবেন।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে ক্ষতি: আকস্মিক বন্যায় মৎস্য খাতে ১১টি জেলার ৮৬টি উপজেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যায় জান-মালের ক্ষতিসহ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এক লাখ ৮০ হাজার ৮৯৯টি পুকুর/দিঘি ও মৎস্য খামার। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত মাছ ও চিংড়ির পরিমাণ ৯০ হাজার ৭৬৮ টন। মাছের পোনা ও চিংড়ির পোস্ট লার্ভা ক্ষতির শিকার হয়েছে তিন হাজার ৭৪৬ লাখ। ফলে মৎস্য খাতে মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এক হাজার ৫৯০ কোটি ৩৬ লাখ টাকা।
এদিকে বন্যার কারণে অনেক গবাদি পশুর মৃত্যু, ভেসে যাওয়াসহ অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগির খাদ্য এবং অন্যান্য পশুখাদ্য বিনষ্ট হয়েছে। ডিম, দুধ ও অনান্য খাতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ফলে পশুসম্পদ খাতে আনুমানিক ক্ষতির পরিমাণ ৪১১ কোটি টাকা। গত ৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে মোট ক্ষতি ছাড়িয়েছে অন্তত দুই হাজার কোটি টাকা।