নানা অনিয়ম ও ঋণ কেলেঙ্কারির কারণে দুর্বল হয়ে পড়া ছয়টি ব্যাংককে একীভূত করে সরকারি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।
দুর্বল ব্যাংকগুলো হলো—সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড (এসআইবিএল), গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক।
চলতি বছর জুলাইয়ের মধ্যে এ প্রক্রিয়া শেষে একীভূত ব্যাংকটির জন্য বিদেশি বিনিয়োগকারী খোঁজা হবে। এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন।
এসব ব্যাংকের মধ্যে চারটির পর্ষদ সরাসরি চট্টগ্রামভিত্তিক আলোচিত ব্যবসায়ী সাইফুল আলম মাসুদ (এস আলম) এর নিয়ন্ত্রণে ছিল। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ দিকে ন্যাশনাল ব্যাংকের পর্ষদের নিয়ন্ত্রণও পরোক্ষভাবে সুবিধাভোগীদের মাধ্যমে তার কাছে যায়। আর এক্সিম ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ছিল শেখ হাসিনার সময়ের আরেক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম মজুমদারের।
একীভূত করে সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে এসব ব্যাংকের সম্পদ পর্যালোচনাও করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।
সোমবার রাতে প্রচারিত স্থানীয় একটি টেলিভিশন চ্যানেলের সাক্ষাৎকারভিত্তিক প্রতিবেদনে গভর্নর বলেন, জুলাইয়ের মধ্যে এসব ব্যাংককে সরকারি মালিকানায় নিয়ে প্রয়োজনীয় পুঁজি যোগান দেওয়া হবে। তারপর বিদেশি বিনিয়োগকারী খোঁজা হবে।
“এটা আস্থার খবর কারণ এটা সরকারিকরণ করা হবে। সরকার সাময়িকভাবে এটাকে নিয়ে নেবে। একই সঙ্গে সেগুলোকে মূলধন যোগাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকতো ইতোমধ্যে তাদের তারল্য সহায়তা দিচ্ছে। তারপর আমরা শেয়ারগুলোকে আন্তর্জাতিক কৌশলগত বিনিয়োগকারীর কাছে হস্তান্তর করব; পুনর্গঠন হওয়ার পরে।”
তিনি বলেন, “পুনর্গঠনের সময়টায় আমরা অংশীদারত্ব রাখব। এটা একটা সাময়িক ব্যবস্থা, যেটা আমরা নতুন ব্যাংক করব। পরে সেটা নতুন বিনিয়োগকারীর কাছে হস্তান্তর করে দেওয়া হবে।”
এর আগে বিগত সরকারের আমলে দুর্বল ব্যাংককে একীভূত বা মার্জার করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। তবে ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর সে উদ্যোগ আর এগোয়নি।
গভর্নর বলেন, আমরা পর্যায়ক্রমে যাব। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে আমরা প্রথমটা সফলভাবে করতে পারলে আমরা পরেরটায় যাব। প্রথমটা থেকে আমরা শিক্ষা নেব কী ভুল হতে পারে। এটা ধাপে ধাপে হবে। এটা দুই-তিন মাসের ব্যাপার নয়। রেজুলেশনের প্রথম তিন মাস একটা কঠিন সময়।
একীভূত করার পর ওই ব্যাংকে বিদেশি বিনিয়োগ আনার বিষয়ে তিনি বলেন, “নতুন কৌশলগত বিনিয়োগকারী যারাই নেবেন তারা এটা সুন্দরভাবে চালিয়ে যেতে পারবেন। আমরা চাই এটার মূলধন বাড়বে, এটার তারল্য বাড়বে, প্রত্যেকটা গ্রাহক তার টাকা পাবে, গ্রাহকদের কোনো লোকসান হবে না।“
গভর্নর আহসান মনসুর বলেন, “যেসব ব্যাংকের ক্যাপিটাল অ্যাডোকেসি রেশিও ঘাটতিতে রয়েছে, আমাদের লক্ষ্য হলো চার বছরের মধ্যে তাদের এই রেশিও ১২ দশমিক ৫ থেকে ১৫ শতাংশে উন্নীত করা।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী, একটি ব্যাংকের জন্য তার রিস্ক-ওয়েটেড অ্যাসেটের বিপরীতে কমপক্ষে ১০ শতাংশ মূলধন সংরক্ষণ করা বাধ্যতামূলক। এছাড়াও ক্যাপিটাল কনজারভেশন বাফার হিসেবে অতিরিক্ত ২ দশমিক ৫ শতাংশ মূলধন রাখতে হয়। ফলে, মোট মূলধন সংরক্ষণের হার দাঁড়ায় ১২ দশমিক ৫ শতাংশ।
এ বিষয়ে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের অ্যাসিট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট খায়রুল হাসান হ্যালো বাংলাদেশকে বলেন, “পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে দেশের বাংকখাতে নাজিরবিহীন অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাট ও অর্থপাচারের কারণে দূর্বল হয়ে পড়া ব্যাংকগুলোকে সরকারি মালিকানার এনে পুনরায় সবল করার উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। আমি মনে করি ‘ব্যাংক রেজল্যশন অর্ডিন্যান্স-২০২৫’ ক্ষমতা বলে বাংলাদেশ ব্যাংক যে সংস্কারের উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে তার ফলে ব্যাংকখাতে সুশাসন, শৃঙ্খলা ও জবাবদিহিতার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হবে। এতে আমানতকারীদের আমানত নিরাপদ হবে এবং গ্রাহক ও সাধারণ মানুষের এসব ব্যাংকের প্রতি আস্থা পুনঃস্থাপিত হবে। ভবিষ্যতে যাতে আর কেউ ব্যাংকখাতে এ ধরনের লুটপাট করতে না পারে যেজন্য এই আইনটি রক্ষা কবজ হিসেবে কাজ করবে। পাশাপাশি এই অর্ডিন্যান্স বাস্তবায়ন করতে গিয়ে গ্রাহক ও ব্যাংকারদের মধ্যে যাতে কোনো ধরনের আতংক ও ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে । একই সাথে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ রেগুলেটরি অথরিটির মধ্যে যারা দুর্নীতির সাথে জড়িত তাদের ব্যাপারে আইনানুগ ব্যাবস্থা গ্রহণের দাবি জানাই।”
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ২৬৭ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩৪ দশমিক ৭৯ শতাংশ। একই সময়ে ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি ১০ হাজার ৬০৩ কোটি টাকা। আর মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ১১ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা।
ডিসেম্বর শেষে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ৮৫১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ। আর ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি ১৩ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা।
২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে ন্যাশনাল ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৬০ দশমিক ৫০ শতাংশ। ১৮ হাজার ৭২০ কোটি টাকার প্রভিশন ঘাটতি ব্যাংকটির। মূলধন ঘাটতি ৭ হাজার ৭৯৯ কোটি টাকা।
ইউনিয়ন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ডিসেম্বর শেষে দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৮৭ দশমিক ৯৮ শতাংশ। একই সঙ্গে ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি ১৫ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা।
নজরুল ইসলাম মজুমদারের নিয়ন্ত্রণে থাকা এক্সিম ব্যাংকের খেলাপি গত ডিসেম্বর শেষে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৯৯৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩ দশমিক ৮২ শতাংশ।
এ ছাড়া ডিসেম্বর শেষে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৪৪২ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩০ দশমিক ৮৬ শতাংশ। ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি ২ হাজার ৯০৫ কোটি টাকা।