প্রতিনিয়তই বাড়ছে তাপমাত্রা। নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভের পানির স্তর। জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ বিপর্যয়ের ঝুঁকির শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তনে কৃষিতে বাড়ছে পোকামাকড়ের আক্রমণ। অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে কমে আসছে সবুজ এলাকা ও উন্মুক্ত স্থান।
এই অবস্থায় আমরা কী কিছুই করতে পারি না? বিজ্ঞান ও প্রকৃতির উত্তর হচ্ছে- হ্যাঁ, পারি। আর সেই উপায়ের নাম হলো গাছ। আর তার মধ্যেও যেটি সবচেয়ে কার্যকর ও উপকারী, তা হলো নিমগাছ।
পরিবেশ দূষণ কমাতে প্রকৃতিতে নিমগাছের ভূমিকা সম্পর্কে হ্যালো বাংলাদেশকে পরামর্শ দিয়েছেন- কৃষিবিদ ও প্রকৃতি বিষয়ক লেখক মৃত্যুঞ্জয় রায়।
এই কৃষিবিদ বলেন, নিম গাছ পরিবেশগতভাবে খুবই উপকারী। পরিবেশ বান্ধব এমন গাছ দ্বিতীয়টি আর নেই। এটি বেশি মাত্রার দূষণ সহ্য করতে পারে। নিম গাছের পাতা তুলনামূলকভাবে বেশি পরিমাণে সীসা শোষণ করে। ধূলিকণা, কার্বন ডাই-অক্সাইড, সালফার অক্সাইড ও নাইট্রোজেনের মতো দূষক শোষণ করার ক্ষমতা নিম গাছের রয়েছে। পানি, বায়ু এবং মাটি শোধনের জন্য নিম অপরিহার্য। নিমের ছায়া শীতল প্রশান্তি দেয়।
যেভাবে নিমগাছ মাইক্রোক্লাইমেট তৈরি করে
একটা সময় ছিল যখন দক্ষিণ দিকে মুখ করে বাড়ি বানানোর পরিকল্পনা থাকত। বাড়ির দক্ষিণ দিকে একটা পুকুর। আর পুকুর পাড়ে একটা নিম গাছ। এতে করে দক্ষিণ দিক থেকে আসা বাতাসে পুকুরের জলীয় বাষ্প আকাশের দিকে উঠে যেত। সেই জলীয় বাষ্প পরিশোধিত হয়ে একটা “মাইক্রোক্লাইমেট” তৈরি হতো। এই বাতাস বাড়ির দরজা-জানালা দিয়ে প্রবেশ করে বাড়ির পরিবেশকে শান্তিময় করে রাখত।
ফলে অনেক রোগ-জীবাণু থেকে রক্ষা পাওয়া যেত। আর তাই নিমগাছকে প্রকৃতির এয়ার কন্ডিশনারও বলা হয়। একটি পরিপূর্ণ নিম গাছ চারপাশের বাতাসকে প্রায় ১০ টন এসির সমপরিমাণ ঠান্ডা রাখতে পারে

নিমের পাতা তেতো হলেও এর ফল মিষ্টি, ছবি: গার্ডেন অ্যান্ড হোম
নিমগাছের নির্মল বাতাস যেমন উপকারী, তেমনি এ গাছের বিভিন্ন অংশ যেমন- পাতা, ফুল, ফল ও ছাল আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে নানাভাবে ব্যবহার হয়। বসন্ত রোগ থেকে শুরু করে বহু রোগের জীবানুণাশক হিসেবে নিম অসাধারন। নিম থেকে সাত ধরনের কীটণাশক তৈরি করা যায়।
নিমের শুকনো পাতার গুড়া চাল, ডাল অন্যান্য শস্য গুদামে রাখলে পোকা-মাকড়ের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। কাঁচা পাতার রস স্প্রে করলে পোকা-মাকড় বংশবিস্তার করতে পারে না। নিমের বীজের শাঁস থেকে তেল তৈরি করে কীটণাশক তৈরি করে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
নিমগাছ শিল্প এলাকায় ও শহুরে দূষণ দূর করার জন্য উপযুক্ত। এটি পরিচিত হট স্পটগুলোতে সবুজ বেল্টের মত কাজ করে। নিম আমাদের দেশীয় গাছ ও আবহাওয়া উপযোগী। যে কোনো ধরনের মাটিতে জন্মে। নিমগাছ দ্রুত বর্ধণশীল। পানির স্তর ধরে রাখে, মাটির ক্ষয় ও মরুময়তা রোধ করে।
মহামূল্যবান বৃক্ষ
নিমগাছকে আগামী শতকের মহামূল্যবান বৃক্ষ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। এই নিমগাছ ও নিমগাছের তৈরি ওষুধ রাসায়নিক ওষুধের চেয়ে বেশি উপকারি। বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশে নিম অর্থনৈতিক উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও পরিবেশ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তাই পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পেতে এই বর্ষা মৌসুমে নিমগাছ রোপণের উদ্যোগ নেওয়া দরকার বলে মনে করেন এই কৃষিবিদ।
নিমগাছ সারা বছর রোপণ করা যায়। তবে উপযুক্ত সময় হচ্ছে জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত। জুন-জুলাই মাসে বীজ সংগ্রহ করে ১০-১৫ দিনের মধ্যে বীজ বপন করতে হয় চারা উৎপাদনের জন্য। চারার বয়স এক বছর হলে রোপণ করা যায়।

নিমগাছ শিল্প এলাকায় ও শহুরে দূষণ দূর করার জন্য উপযুক্ত, ছবি” নার্সারি লাইভ
প্রায় সব মাটিতে নিম ভাল হয়। নিম স্বল্পকালীন বন্যা সহ্য করতে পারে। পোকামাকড় ও রোগবালাই দ্বারা আক্রান্ত হয় না। দেশের বায়ু দূষণ রোধ করতে শহরাঞ্চলের পতিত খাল, নদী, নালা, বাঁধ, বেড়িবাঁধ, রাস্তার পাশে নিমগাছ রোপণ করা জরুরি। সাধারনত রাস্তার পাশে সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য কৃষ্ণচূড়া, ছাতিম গাছ লাগানো হয়।
এসব গাছ সৌন্দর্য বাড়ানোর সাথে ছায়া দেয় ঠিকই কিন্তু পথচারীদের জন্য বিপজ্জনকও বটে। অল্প ঝোড়ো বাতাসে এসব গাছের ডালপালা ভেঙ্গে পড়ে। সেই তুলনায় নিম রোপণ করা নিরাপদ। এ ছাড়া সরকারের খাসজমি, পতিত জমিতে ছোট ছোট আকারে নিম বন তৈরি করা যায়।
নিমের পাতা তেতো হলেও এর ফল মিষ্টি। তাই পাখি নিম ফল খেয়ে থাকে। নিমের বনায়ন করা গেলে পাখি পর্যাপ্ত খাদ্য পাবে। ফলে পাখির সংখ্যা বাড়বে। আর এতে করে পরিবেশের ভারসাম্য ভালভাবে রক্ষা হবে।
নিম বাড়ির আঙিনা, রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতসহ সর্বত্র লাগানো যায়। নিম গাছের গন্ধে আশপাশের ফসলেও কীট-পতঙ্গ আসে না। তাই ফসলের মাঠে নিমগাছ লাগানো উপকারী। তুলনামূলকভাবে নিমের অথনৈতিক গুরুত্ব অন্যান্য কাঠ, ফল ও ঔষধী গাছ থেকে অনেক বেশি। নিমের পাতা হাম, বসন্ত, ঘা, খুজলি, পাঁচড়া ও চুলকানিতে ব্যবহার হয়। নিমগাছে রোগ-ব্যাধি হয় না ও এই গাছ গরু-ছাগলে খায় না।
তাই গাছ লাগানোর মৌসুমে সকলের বাড়ির খালি জায়গায়, রাস্তার ধারে যার যার পছন্দ অনুযায়ী গাছ লাগিয়ে মাইক্রোক্লাইমেট তৈরি করে প্রাকৃতিক এসির অনুভূতি নেয়ার পরামর্শ দেন মৃত্যুঞ্জয় রায়। বেশি বেশি নিমগাছ লাগিয়ে নিজের ও পরিবারের ভবিষ্যতের জন্য বিনিয়োগ করুন। অক্সিজেনের ফাক্টুরি গড়ে তুলুন এবং পরিবেশকে বিপর্যয়ের কবল রক্ষা করুন।