শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্পর্ক বৃদ্ধির বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে। বর্তমান সরকার দেশটির সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক মজবুত করার জন্য পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের চেয়ে পাকিস্তানের লাভের সম্ভাবনা বেশি।
অর্থনীতির গবেষক ও আমদানি-রপ্তানিকারকরা মনে করেন, সরাসরি জাহাজ ও বিমান চলাচল চালুর পাশাপাশি দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি, উভয় দেশের মান নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে সার্টিফিকেট গ্রহণ এবং বাণিজ্য সম্পর্কিত পারস্পরিক বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে বাণিজ্য কয়েকগুণ বাড়ানো যাবে, যাতে উভয় দেশ লাভবান হতে পারে। তবে পাকিস্তানের যে বেশি লাভ হবে, সেটাও বলছেন তারা।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান হ্যালো বাংলাদেশকে বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের এতদিন তৃতীয় দেশের বন্দর ব্যবহার করে কন্টেইনার আনা-নেওয়া করা হতো। এখন পাকিস্তানের করাচি থেকে সরাসরি জাহাজ চলাচল শুরু হওয়ায় দুদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যেই ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। পরিবহন খরচ কমায় প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়বে। দুপক্ষের জন্যই ইতিবাচক হবে। তবে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য যেহেতু পাকিস্তানের অনুকূলে, সে কারণে পাকিস্তানই বেশি লাভবান হবে।
দু’ দেশের আমদানি-রপ্তানির চিত্র
গত অর্থবছরে (২০২৩-২৪) বাংলাদেশ মোট ৬ হাজার ৬৭২ কোটি ৫১ লাখ (৬৬.৭২ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য আমদানি করে, তার মধ্যে পাকিস্তান থেকে আমদানি হয় ৬২ কোটি ৭৮ লাখ ডলারের পণ্য।
অন্যদিকে গত অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে বাংলাদেশের আয় হয় ৪ হাজার ৪৪৬ কোটি ৯৭ লাখ (৪৪.৪৭ বিলিয়ন) ডলার। তার মধ্যে পাকিস্তানে রপ্তানি হয়েছিল ৬ কোটি ১৯ লাখ ডলারের পণ্য।
স্বল্প আমদানি-রপ্তানির মধ্যেও দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পাল্লা পাকিস্তানের দিকেই ভারী। অর্থাৎ যতটা আমদানি বাংলাদেশ করে, রপ্তানি তার চেয়ে অনেও কম হয়।
ফলে সেদিক থেকেও বাংলাদেশের লাভের সম্ভাবনা কম। আবার দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সহজ হলেও যে আমদানি-রপ্তানি বেড়ে যাবে, তেমন কোনও আশাও দেখছেন না অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। শুধু বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক শিল্পের কাঁচামাল আমদানি সহজ হবে বলে মনে করছেন এই খাতের ব্যবসায়ীরা।
বাণিজ্যের গতিপ্রকৃতি
পাকিস্তানের করাচি বন্দরের সঙ্গে চট্টগ্রামের সরাসরি কনটেইনার জাহাজ চলাচল প্রথম বারের মতো শুরু হয়। প্রথম জাহাজটি আসে গত বছরের ১৬ নভেম্বর; দ্বিতীয়টি আসে ২২ ডিসেম্বর। তার আগেই পাকিস্তান থেকে পণ্য আমদানিতে কড়াকড়ির বিধান বাতিল করা হয়। ২০০৯ সাল থেকে পাকিস্তানি পণ্য আমদানির পর ছাড় নিতে গেলে শতভাগ কায়িক পরীক্ষার বিধান ছিল। এখন অন্য সব দেশের মতোই ১০ শতাংশ পণ্যের কায়িক পরীক্ষা করেই পুরো আমদানি চালান ছাড় করানো যাচ্ছে।
এছাড়া প্রায় ২০ বছর পর বাংলাদেশ–পাকিস্তান যৌথ অর্থনৈতিক কমিশনের (জেইসি) সভা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। চলতি ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে ইসলামাবাদে এ সভা হতে পারে। সভায় উভয় দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের পাশাপাশি যোগাযোগ বাড়ানোয় জোর দেওয়া হবে বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
পাকিস্তান বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা প্রক্রিয়াও সহজ করেছে। দুই দেশের মধ্যে সরাসরি বিমান চালু করা নিয়েও এখন আলোচনা চলছে।
করাচি থেকে বাংলাদেশে সরাসরি যে দুটি জাহাজ এসেছে, তাতে এসেছে ফেব্রিকস, চুনাপাথর, সোডা অ্যাশ, পেঁয়াজ, ম্যাগনেসিয়াম কার্বোনেট ও ডলোমাইট। এর বেশিরভাগই বস্ত্র শিল্পের কাঁচামাল।
পাকিস্তান থেকে গত বছর সবচেয়ে বেশি আমদানি হয়েছে তুলা। এছাড়া আরও যেসব পণ্য আসে বাংলাদেশে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আসে সিমেন্টের কাঁচামাল।
পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে পাকিস্তান বাংলাদেশে প্রায় ৬৫ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। এর মধ্যে রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল সুতা-কাপড় ও প্রস্তুত চামড়া ছিল প্রায় ৭৯ শতাংশ।
বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে রপ্তানি হয়, এমন পণ্যের যে তালিকা পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে রয়েছে, তার পেপার ও পেপারবোর্ড লেবেল, ছেলেদের শার্ট, মেডিক্যাল সার্জিক্যাল ও ডেন্টাল ইকুইপমেন্টও রয়েছে।
বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে যে ৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়, তার মধ্যে ছিল কাঁচা পাট, ওষুধ, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, চা ও তৈরি পোশাক।
এর আগে ২০২২ সালে বাংলাদেশ ৭ কোটি ৪০ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করে পাকিস্তানে; বিপরীতে দেশটি থেকে আমদানি হয় ৮৪ কোটি ডলারের পণ্য। অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ পণ্য পাকিস্তানের রপ্তানি হয়, তার দশগুণ বেশি পাকিস্তান বাংলাদেশে রপ্তানি করে।