‘বন্ড’ একটি আর্থিক পণ্য। এখানে বিনিয়োগের মাধ্যমে স্থির আয় পাওয়া যায়। মেয়াদপূর্তিতে বেশ ভালো পরিমাণের মুনাফা আসায় বিগত বছরগুলোতে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে বিনিয়োগের এই মাধ্যমটি। ব্যক্তি থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ধরনের বন্ডে বিনিয়োগ করতে পারে। ব্যাংকের আমানত বা ডিপোজিট রেখে যে সুদ পাওয়া যায়, সাধারণত বন্ডের মুনাফা বা সুদ তার চেয়ে কিছুটা বেশি দেওয়া হয়। এ কারণে বন্ড এখন বিনিয়োগের জন্য আকর্ষণীয় পণ্য হিসেবে আলোচিত হচ্ছে। তবে বাজারজুড়ে যথেষ্ট ভিন্নতা থাকায়, সঠিক বন্ডটি কেনার আগে তার যথাযথ যাচাই-বাছাই প্রয়োজন।
স্টক ব্রোকার হাউস রয়্যাল ক্যাপিটালের হেড অব রিসার্চ আকরামুল আলম হ্যালো বাংলাদেশকে বলেন, এখন বিনিয়োগকারীরা মোবাইলেই দেখে নিতে পারছেন কোন কোন বন্ডে বিনিয়োগ করলে সুদ আয় কেমন হতে পারে। অন্যান্য খাতে সুদের হার কমে যাওয়ায় ব্যক্তি বিনিয়েগাকারীরা ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ শুরু করেছেন। দেশে ধীরে ধীরে এর বাজার বড় হচ্ছে। সঞ্চয়পত্র ক্রয়ের সীমা ব্যক্তি পর্যায়ে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা হলেও বন্ডে বিনিয়োগের কোনো সীমা রাখেনি সরকার।
তিনি বলেন, বন্ডে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে করছাড় সুবিধা রয়েছে। কর সনদ বাধ্যতামূলক না হওয়ায় অনেক বিনিয়োগকারী পুঁজিবাজারের বিকল্প আয় হিসেবে ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ শুরু করেছেন।
বন্ড কী
ঋণের বিনিময়ে একটি নিরাপত্তা চুক্তিপত্রের নাম বন্ড, যে চুক্তি ঋণগ্রহীতা হিসেবে বন্ড ইস্যু করা প্রতিষ্ঠান এবং ঋণদাতার মধ্যে হয়ে থাকে। এখানে ঋণদাতা বা বিনিয়োগকারীকে বন্ড ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠান প্রাপ্ত ঋণের উপর নির্দিষ্ট হারে বিভিন্ন কিস্তিতে সুদ প্রদান দিয়ে থাকে। এভাবে পূর্বনির্ধারিত মেয়াদ পার হওয়ার পর ঋণের টাকা সুদসহ পরিশোধ করা হয়। বন্ডের অর্থের ওপর নির্দিষ্ট মেয়াদে ধার্য করা সুদের হারকে কুপন রেটও বলা হয়। বন্ড ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠান ও কুপন রেটসহ মূল অর্থ দিতে নানা মাধ্যমের ওপর ভিত্তি করে বন্ডগুলো বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে।
কারা কিনতে পারবেন
সাধারণত সব বন্ড সবাই কিনতে পারে না। বন্ড ইস্যুর আগেই ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি নিজেরাই ঠিক করে নেয় কাদের কাছে তারা এ বন্ড বিক্রি করবে। সেই অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছ থেকে বন্ডের অনুমোদন নেওয়া হয়। যেসব প্রতিষ্ঠান ব্যক্তিশ্রেণির সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য বন্ড ইস্যু করে, সেসব বন্ড প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওর মতো শেয়ারবাজারের ব্রোকারেজ হাউসের মাধ্যমে কেনা যায়। সেই ক্ষেত্রে নির্ধারিত সময়ে ব্রোকারেজ হাউসের মাধ্যমে আবেদন করতে হয়। আর যেসব বন্ড শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়, সেগুলো শেয়ারবাজার থেকে যখন খুশি তখন কেনাবেচা করা যায়।
বন্ডের নানা প্রকারভেদ
বন্ড হচ্ছে একধরনের ঋণপত্র। এ বন্ড বিক্রি করে সাধারণ মানুষ বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মূলধন বা অর্থ সংগ্রহ করে ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠান। সরকার থেকে শুরু করে ব্যক্তি পর্যায়ের কোম্পানি যে কেউ বাজারে বন্ড ইস্যু বা ছাড়তে পারে। সরকারের পক্ষ থেকে সাধারণত ট্রেজারি বন্ড ছেড়ে মানুষের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করা হয়। সাধারণত সরকারের হয়ে ট্রেজারি বন্ড ইস্যু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর সরকারের বাইরে বিভিন্ন ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি যে বন্ড ইস্যু করে, তার অনুমোদন দেয় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন বা বিএসইসি। তবে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বন্ড ছাড়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকেরও অনুমতির দরকার হয়।
সাধারণভাবে আমাদের দেশে বন্ড দুইভাবে পরিচিত—প্রথমটি ট্রেজারি বন্ড, দ্বিতীয়টি করপোরেট বন্ড। করপোরেট বন্ডের মধ্যে আবার দুটি ভাগ আছে। এর একটি ইসলামি শরিয়াহভিত্তিক বন্ড, বর্তমানে যা দেশে সুকুক বন্ড হিসেবে পরিচিত। আর অন্যটি প্রচলিত বা কনভেনশনাল বন্ড। কনভেনশনাল বন্ড আবার কয়েক ধরনের। তার মধ্যে রয়েছে পারপিচুয়াল বন্ড ও জিরো কুপন বন্ড।
ট্রেজারি বন্ড কোথায় থেকে কিনবেন
ব্যাংক বা পুঁজিবাজার থেকে ট্রেজারি বন্ড কেনা যায়। তবে সব ব্যাংক ট্রেজারি বন্ড বিক্রি করে না। শুধু বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়োজিত ডিলার ব্যাংকই ট্রেজারি বন্ড বিক্রি করে। যে ব্যাংক ট্রেজারি বন্ড বিক্রি করে, সেই ব্যাংকে হিসাব খুলে এ বন্ড কেনা যাবে। আর শেয়ারবাজারের মাধ্যমে বন্ড কেনার ক্ষেত্রে বেনিফিশিয়ারি ওনার্স বা বিও হিসাব থাকতে হবে।
ট্রেজারি বন্ড মেয়াদপূর্তির আগে নগদায়ন করা যায়। সে ক্ষেত্রে যে ব্যাংক থেকে ট্রেজারি বন্ড কেনা হয়, ওই ব্যাংকের মাধ্যমেই তা নগদায়নের সুযোগ রয়েছে। আর পুঁজিবাজার থেকে কেনা হলে পুঁজিবাজারেই তা যেকোনো সময় বিক্রয় করা যায়।
সাধারণত ট্রেজারি বন্ড বিভিন্ন মেয়াদি হয়ে থাকে। যেমন ২ বছর, ৫ বছর, ১০ বছর, ১৫ বছর ও ২০ বছর মেয়াদি। সরকারের পক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংক এ বন্ড ইস্যু করে। তাই বেসরকারি কোম্পানির বন্ডের চেয়ে এ বন্ডে বিনিয়োগকে অনেকটা নিরাপদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বিভিন্ন ধরণের বন্ডের পার্থক্য
কুপননির্ভর বন্ড হচ্ছে এমন বন্ড, যার বিপরীতে মুনাফা বা সুদ নির্দিষ্ট করে কুপন ইস্যু করা হয়। এ ধরনের বন্ড আবার দুই রকমের। পারপিচুয়াল বা স্থায়ী বন্ড ও অবসায়িত বা মেয়াদি বন্ড। পারপিচুয়াল বন্ডের কোনো মেয়াদ থাকে না। এটি মেয়াদহীন একটি বন্ড। আর মেয়াদি বন্ড নির্ধারিত মেয়াদ শেষে অবসায়িত বা বাতিল হয়ে যায়।
অন্যদিকে জিরো কুপন বন্ডও একটি মেয়াদি বন্ড, যা নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য ইস্যু করা হয়। পারপিচুয়াল ও জিরো কুপন বন্ড উভয় ক্ষেত্রেই বছরভিত্তিক বা ষাণ্মাসিক সুদের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে কীভাবে সুদ পরিশোধ করা হবে, তা অনুমোদনের সময় উল্লেখ করা হয়।
সাধারণত পারপিচুয়াল বন্ডে কুপন বা সুদের হার নির্ধারিত থাকে। বিনিয়োগকারীরা সে অনুযায়ী সুদ পেয়ে থাকেন। আর জিরো কুপন বন্ডে কোনো সুদ নির্ধারিত থাকে না। এ বন্ড বিক্রি হয় সাধারণত ডিসকাউন্ট বা সাশ্রয়ী দামে। উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, কোনো একটি কোম্পানি জিরো কুপন বন্ড ছেড়ে এক কোটি টাকা সংগ্রহ করবে। ওই বন্ডের অভিহিত মূল্য বা ফেসভ্যালু এক হাজার টাকা। কোম্পানিটি এ বন্ড সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে প্রতিটি ৮০০ টাকা মূল্যে অর্থাৎ ডিসকাউন্টে বিক্রি করল। যিনি এ বন্ডে বিনিয়োগ করবেন, তিনি ২০০ টাকা কমে সেটি কিনতে পারবেন—এই দুই শ টাকাই তার মুনাফা। তবে মেয়াদ শেষে ওই ব্যক্তি অভিহিত মূল্যের হিসাবে বন্ডে বিনিয়োগ করা অর্থ ফেরত পাবেন।
আর পারপিচুয়াল বন্ডের ক্ষেত্রে কুপনে সুদহার নির্ধারিত থাকে। সে অনুযায়ী নির্ধারিত সময় পরপর মুনাফা পাবেন বিনিয়োগকারী। তবে এ মুনাফা বা কুপন হার সময়ে-সময়ে পরিবর্তন হতে পারে। যেহেতু এ ধরনের বন্ড মেয়াদহীন, তাই কেউ চাইলে কয়েক বছর পর তা বিক্রি করে আসল অর্থ তুলে নিতে পারবেন। যে প্রতিষ্ঠান এ ধরনের বন্ড ইস্যু করে, তাদের মাধ্যমে বা ওই কোম্পানির মনোনীত প্রতিনিধির মাধ্যমে তা কেনাবেচা করতে হবে।
কেন বন্ডে বেশি সুদ দেওয়া হয়
বন্ড ছেড়ে ব্যক্তি খাতের প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি মূলত অর্থ সংগ্রহ করে। অর্থ সংগ্রহ করা সব সময়ই কষ্টসাধ্য একটি বিষয়। তার জন্য মূল্যও দিতে হয়। আরেক দিক থেকে যারা বিনিয়োগ করেন, তাদের ঝুঁকিও বেশি। কারণ, নিয়ম অনুযায়ী কোনো ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি যদি কখনো কোনো কারণে দেউলিয়া হয়ে যায়, তাহলে ওই প্রতিষ্ঠানের যা সম্পদ আছে, তা বিক্রি করে সবার আগে আমানতকারীর দায় মেটানো হয়। সব পাওনা পরিশোধের পর যদি কিছু থেকে যায়, তবে সেখান থেকে কিছু অর্থ ফেরত পান অর্থ জোগানদাতারা। এ কারণে অর্থ জোগানদাতাদের আমানতকারীর চেয়ে কিছুটা বেশি সুদ দেওয়া হয়।
বন্ড কেনার আগে যে বিষয়গুলো বিবেচনা রাখা জরুরি
ঠিক কত বছর পরে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের দরকার তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করে আগে থেকেই সঠিক বিনিয়োগ নির্বাচন করতে হবে। এই মেয়াদের ওপর নির্ভর করছে কোন সময়টিতে টাকাটা তুলে প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করা যাবে। যাদের খুব দ্রুত অর্থের প্রয়োজন তাদের দীর্ঘ মেয়াদে বন্ডগুলোর দিকে না যাওয়াই উত্তম। অপরদিকে, দীর্ঘমেয়াদে বন্ড থেকে উদ্বৃত্ত অর্থ এমন কাজে লাগানো যেতে পারে, যা বিনিয়োগ ছাড়া অন্য সময়ে অসম্ভব।
বন্ড নির্বাচনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠানের ‘ক্রেডিট রেটিং’ যাচাই করা। সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে ঝুঁকির বিচারে একটি বিশাল কোম্পানির বিভিন্ন দিক খুঁটিয়ে দেখা বেশ জটিল। মূলত বিভিন্ন এজেন্সি এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মূলধন, দেশি ও বৈদেশিক বিনিয়োগের খাত, ঋণের খাত, ঋণ পরিশোধের হার প্রভৃতি সূচকগুলো খতিয়ে দেখে। সামগ্রিক বিচারে বিভিন্ন অ্যাজেন্সি এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিভিন্ন স্কেলে মার্কিং করে। এই রেটিংগুলো দেখে সহজেই প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক অবস্থান সম্পর্কে অবগত হওয়া যেতে পারে। অধিকাংশ অ্যাজেন্সিতে পরিমাপের স্কেলগুলো একই হলেও এজেন্সি ভেদে কিছুটা ভিন্নতা থাকে। যেমন “ট্রিপল এ” বা “এএএ” বলতে সর্বোচ্চ নিরাপদ বা ঝুঁকিহীন প্রতিষ্ঠানকে বোঝানো হয়। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে “ট্রিপল সি” বা “সিসিসি”, “ডাবল সি” বা “সিসি”, “সিঙ্গেল সি” বা “সি” উল্লেখ করা হয়। আর “সিঙ্গেল ডি” হচ্ছে ঋণ খেলাপি প্রতিষ্ঠানের নির্দেশক।
কুপন বা সুদের হার
ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায়ই উচ্চ সুদের হারের প্রস্তাব করে। উচ্চ কুপন রেটে বিনিয়োগের স্থির আয়সহ মেয়াদ শেষে সুদ-আসল বেশ লোভনীয়। কিন্তু কুপন রেট বেড়ে যাওয়া মানে বন্ডের বাজার মূল্য হ্রাস পাওয়া। অর্থাৎ পরবর্তীতে বন্ড হোল্ডারকে ক্রয়মূল্য অপেক্ষা কম মূল্যে বন্ড ছেড়ে দিতে হতে পারে। তাই বাজারে বন্ডের দাম হ্রাসের আশঙ্কা থাকলে দীর্ঘমেয়াদি বন্ড বেছে নেওয়া ভালো। আর দাম বৃদ্ধির সম্ভাবনা সৃষ্টি হলে স্বল্পমেয়াদী বন্ড নেওয়া যেতে পারে।