ফ্ল্যাট কেনার আগে বেশ কয়েকটি বিষয় যাচাই করে নেওয়া জরুরি। তাতে ভবিষ্যতে বাড়তি কোনো ঝামেলা পোহাতে হবে না। সারা জীবনের সঞ্চয় এবং ঋণের বোঝা নিয়ে সাধারণত ফ্ল্যাট কিনে মধ্যবিত্তরা। ফ্ল্যাটের স্বপ্ন যেন দুঃস্বপ্ন না হয়, সে জন্য নানা বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। যেমন ফ্ল্যাট কেনার আগে নিজের বাজেট, কোন এলাকায় কিনবেন, ঋণ পাবেন কিনা, ফ্ল্যাটের আয়তন ও নির্মাণসামগ্রী কেমন এবং কর কত দিতে হবে—এসব ভাবতে হবে।
প্রকল্পের অনুমোদন
ঢাকায় ফ্ল্যাট কিনতে চাইলে ভবনের নকশা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অনুমোদিত কিনা সেটি সবার আগে যাচাই করে নিতে ভুলবেন না। ঢাকার বাইরে হলে নিজ নিজ এলাকার প্রকল্পের অনুমোদন নেওয়া আছে কিনা সে বিষয়ে খোঁজ নেওয়া জরুরি। অনুমোদন নেওয়া থাকলে নকশা অনুযায়ী ভবন তৈরি হয়েছে কিনা- জেনে নিন।
যোগাযোগ ব্যবস্থা
ফ্ল্যাট কেনার আগে এলাকার যোগাযোগের বিষয়ে আগে খোঁজ নেওয়া জরুরি। আশেপাশে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, বাজারঘাট ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দোকান আছে কিনা সেটা যাচাই করে নেবেন। যে এলাকা থেকে ফ্ল্যাট কিনতে চান সেখান থেকে আপনার অফিস বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দূরত্ব পরীক্ষা করুন। এছাড়াও, পরিবহন ও যোগাযোগ সুবিধা, নাগরিক সুবিধা রয়েছে কিনা তাও দেখে নেওয়া উচিত।
সাধ ও সাধ্যের যোগসূত্র জরুরি
সাধ্যের বাইরে ফ্ল্যাট কিনতে যাবেন না। সাধ্যের বাহিরে ফ্ল্যাট কিনতে গিয়ে লোন (ঋণ) পরিশোধের চিন্তায় নতুন ফ্ল্যাট কেনার আনন্দ অনেকটাই বিপদের কারণ হতে পারে। অভিজাত এলাকায় ফ্ল্যাটের দাম অনেক বেশি। অত বেশি টাকা খরচ করার সামর্থ না থাকলে বিবেচনা করুন কোন বিষয়টি আপোষ করে আরেকটু কমের মধ্যে ফ্ল্যাট কিনবেন।
নিরাপত্তা
যে জায়গায় ফ্ল্যাট নিতে যাচ্ছেন সেখানকার নিরাপত্তার ব্যাপারেও নিশ্চিত হতে হবে। চারপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং দূষণও বিবেচনায় নেওয়া উচিত। বাজেটের কথা মাথায় রেখে জায়গাটি বেছে নিন।
ফ্ল্যাটের আকার ও আয়তন
পরিবারের সদস্য সংখ্যা, আসবাবপত্রের লেআউট এবং রুচি বুঝে ফ্ল্যাট সাইজ বেছে নেওয়া উচিত। কত তলা কিনতে যাচ্ছেন তাও মনে রাখতে হবে। যদি পছন্দের ফ্ল্যাট উপরের তলায় থাকে, তাহলে গ্রীষ্মের গরমে ভুগতে পারেন। যাইহোক, অনুমতি সাপেক্ষে, সুন্দরভাবে ছাদ সাজাতে পারেন এবং এটি ব্যবহার করতে পারেন। যদি দ্বিতীয় তলার ফ্ল্যাট পছন্দ করেন, তাহলে ভবনটির নিরাপত্তার দিকে ভালোভাবে নজর দিন। প্রতিটি তলায় ফ্ল্যাটের সংখ্যাও বিবেচনা করা প্রয়োজন। যদি প্রতিটি তলায় একটি ফ্ল্যাট থাকে, তাহলে সিঁড়ি এবং লবির অংশটিকে নিজের মতো করে সাজানো সম্ভব।
পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সুবিধা
ফ্ল্যাট যতই দামি ও সজ্জিত হোক না কেন; যদি এলাকায় পানি, ইলেক্ট্রিসিটি ও গ্যাসের সমস্যা থাকে, তাহলে কিন্তু পরবর্তীতে ভোগান্তি অপেক্ষা করছে আপনার জন্য। ভবনের বাহ্যিক সৌন্দর্য এবং এটি যে দিকে মুখ করে তা বিবেচনা করুন। বাংলাদেশে দক্ষিণমুখী ফ্ল্যাটের চাহিদা সবসময়ই একটু বেশি।
পার্কিংয়ের স্পেস
নিজস্ব ট্রান্সপোর্ট ও পার্কিংয়ের ব্যবস্থা নেই এমন ফ্ল্যাট না কিনায় ভালো। কারণ ভবিষ্যতে গাড়ি কিনলে সেটা রাখার জন্য বিড়ম্বনা পোহাতে হবে। অবশ্য আবাসিক সোসাইটিতে ফ্ল্যাট কিনলে বেশিরভাগ সময় পার্কিং সুবিধা চুক্তির অংশ হিসেবেই থাকে।
আবাসন প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে যা জানা জরুরি
কেউ কম দামে অধিক সুযোগ-সুবিধাসহ ফ্ল্যাট দেওয়ার প্রলোভন দেখালেই সেটা কিনে ফেলবেন না। আবাসন প্রতিষ্ঠানের সুনাম ও বিশ্বাসযোগ্যতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তার পর সিদ্ধান্ত নেন ফ্ল্যাট কেনা যাবে কি না।
মালিকানার ধরণ
যে প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির কাছ থেকে ফ্ল্যাটটি কিনতে যাচ্ছেন সেটির মালিকানার ধরণ নিশ্চিত হতে হবে। এজন্য, যে জমিতে প্রস্তাবিত ফ্ল্যাটটি রয়েছে তার সর্বশেষ রেকর্ডে বিক্রেতার নাম উল্লেখ আছে কি না এবং সিএস, আরএস সহ অন্যান্য লেজারের আদেশ রয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করা প্রয়োজন। জানতে হবে যে রিয়েল এস্টেট কোম্পানির যথাযথ নিবন্ধন আছে কি না এবং এটি রিহ্যাবের সদস্য কিনা। যদি ডেভেলপার কোম্পানি কোন মালিকের কাছ থেকে জমি নিয়ে থাকে, তাহলে এই বিষয়ে কোন চুক্তি আছে কিনা তা যাচাই করা প্রয়োজন।
নামজারির অবস্থা
জমির নামকরণ সঠিক কিনা তা যাচাই করতে হবে। যদি বিক্রেতা উত্তরাধিকার সূত্রে জমির মালিক হন, তবে এটি একটি বিতরণ মামলা আছে কিনা তা নিশ্চিত করতে হবে।
মামলা আছে কিনা
ভূমি উন্নয়ন কর প্রদানের ক্ষেত্রে জমির হালনাগাদ খেয়াল রাখতে হবে। ভূমি কর না দেওয়ার কারণে কোন সার্টিফিকেট কেস আছে কিনা তা খুঁজে বের করা প্রয়োজন। জমিতে অন্য কোনো মামলা আছে কিনা তা আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।
নকশায় মিল অমিল
বিক্রয়ের জন্য প্রস্তাবিত ফ্ল্যাটটি প্রকৃত অবস্থার সাথে ঘটনাস্থলের নকশার সঙ্গে মেলে। প্রয়োজনে আশেপাশের জমির মালিকদের কাছ থেকে দাগ-খতিয়ান জানা প্রয়োজন। চুক্তির একটি অনুলিপি আইনি উপায়ে রাখতে ভুলবেন না, সব শর্ত স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে।
খাসজমির খবরাখবর
এটি নিশ্চিত করতে হবে যে প্রস্তাবিত ফ্ল্যাটটি সরকারের খাস জমিতে আছে নাকি; সরকারের কোন স্বার্থ আছে। এটাও দেখা উচিত যে জমি অর্পিত সম্পত্তি বা পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকায় আছে কিনা। জমি আগে যে কোন সময়ে অধিগ্রহণ করা হয়েছে বা প্রক্রিয়াধীন আছে কিনা, তা ওয়াকফ, দেবোত্তর জমি কিনা তা বিবেচনায় নেওয়া উচিত। পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি যাচাই জমির মালিক কোন অ্যাটর্নি বা অ্যাটর্নি নিয়োগ করেছেন কিনা তা খুঁজে বের করুন। এটি সঠিক কিনা তা অ্যাটর্নিকে দেখতে হবে। যদি বিক্রেতা পাওয়ার অফ অ্যাটর্নির মাধ্যমে ক্ষমতা পেয়ে থাকে, তাহলে তার বৈধতা যাচাই করা প্রয়োজন। প্রকৃত মালিক সঠিক কিনা এবং অ্যাটর্নি সঠিক কিনা তা দেখার জন্য প্রকৃত মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
কিস্তি সম্পর্কে জানা
যদি এটি কিস্তিতে কেনা হয়, চুক্তিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে কতটি কিস্তি এবং কখন স্থানান্তর হবে। যদি এটি কোন কারণে ক্রয় করা না যায়, তাহলে এটি কিভাবে নিষ্পত্তি করা হবে তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে।
নির্মাণ সামগ্রীর মান
দেখতে যতই আকর্ষণীয় হোক, বাড়ি তৈরিতে ব্যবহৃত সামগ্রী যদি উন্নতমানের না হয় তবে কিন্তু ভবিষ্যতে পড়তে পারেন বিপদে। জানালা, দরজা, টাইলস ও অন্যান্য উপকরণ ভালোমানের কিনা সেটা যাচাই করে নেবেন কেনার আগে।
চুক্তিপত্র
কোম্পানির সঙ্গে ফ্ল্যাট কেনার যে চুক্তিটি করবেন, সেটি অবশ্যই একজন দক্ষ আইনজীবীকে দিয়ে যাচাই করে নেবেন। চুক্তির খুঁটিনাটি বিষয়গুলোও ভালোভাবে দেখে নিন। যদি কিস্তির মাধ্যমে কেনার কথা থাকে, তাহলে কয় কিস্তি এবং হস্তান্তর কবে হবে, এ বিষয়ে সুস্পষ্ট করে চুক্তিনামায় লেখা থাকতে হবে।
এছাড়া যেসব বিষয়ে জানা জরুরি- যদি ফ্ল্যাটটি পুনরায় বিক্রয় করতে চান, সেই অনুযায়ী স্থান নির্বাচন করুন এবং ফ্ল্যাটের যত্ন নিন। পুরনো ফ্ল্যাট কেনার সময় অন্যান্য ফ্ল্যাট মালিক এবং ভবনের অধিবাসীদের সম্পর্কে জানুন। ফ্ল্যাট ক্রয় চুক্তি একাধিকবার পড়ুন। ফ্ল্যাটটি ব্যাংকের কাছে ঋণের জন্য বন্ধক আছে কিনা তা বিবেচনা করা গুরুত্বপূর্ণ। যে আবাসন প্রতিষ্ঠান থেকে ফ্ল্যাট কিনবেন, সেটি রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সদস্য কি না, নিশ্চিত হয়ে নেবেন। রিহ্যাবের সদস্য নয়, এমন প্রতিষ্ঠান থেকে ফ্ল্যাট না কেনাই ভালো। কারণ, পরবর্তী সময়ে কোনো সমস্যা হলে রিহ্যাবের কাছে অভিযোগ করা যাবে না। দেশের প্রচলিত আইনের পাশাপাশি সংগঠনের নিয়মকানুন মেনে চলার কারণে সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলো জবাবদিহির মধ্যে থাকে। তা ছাড়া কোম্পানির সঙ্গে ফ্ল্যাট কেনার যে চুক্তিটি করবেন, সেটি অবশ্যই একজন দক্ষ আইনজীবীকে দিয়ে যাচাই করে নেবেন।