Home টপ পোস্ট অনিশ্চয়তায় বিনিয়োগে স্থবিরতা

অনিশ্চয়তায় বিনিয়োগে স্থবিরতা

ইকবাল হোসেন
১৪৪ views
বিনিয়োগ

নানা অনিশ্চয়তায় ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগ করছেন না। ক্ষমতা পরিবর্তনের পর বড় ব্যবসায়ীদের কয়েকজন কারাগারে রয়েছেন। অনেকে গা ঢাকা দিয়েছেন, বিদেশে পালিয়ে গেছেন কেউ কেউ। এমন পরিস্থিতিতে দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি কমে ৯ শতাংশে নেমে এসেছে, যা তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। নতুন বিনিয়োগের অন্যতম প্রধান নির্দেশক মূলধনি যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি) আমদানি তলানিতে নেমেছে। শিল্পের কাঁচামাল আমদানিও কমছে। দেশে শিল্প স্থাপনের নতুন উদ্যোগ ও ব্যবসা সম্প্রসারণ স্থবির হয়ে আছে, ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের মধ্যে ভয়-আতঙ্ক বিরাজ করছে। মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে নীতি সুদহার বাড়িয়েই চলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা এখন ১০ শতাংশ। ব্যাংক ঋণের সুদের হার ১৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। সব মিলিয়ে বিনিয়োগে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।

বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ৩৬ মাসে সর্বনিম্ন
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ব্যবসার পরিবেশে অনিশ্চয়তা আর ব্যাংক ঋণে উচ্চ সুদহারের প্রভাবে গত সেপ্টেম্বর মাসে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ৩৬ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গত বৃহস্পতিবার (৭ নভেম্বর) প্রকাশিত ‘উইকলি সিলেক্টেড ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস’ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

এতে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে বেসরকারি ঋণ খাতে বিতরণের পরিমাণ আগের বছর একই সময়ের তুলনায় ৯ দশমিক ২০ শতাংশ বেড়েছে। সবশেষ ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে এ খাতে এর চেয়ে কম, ৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। এরপর আর কখনও তা ৯ দশমিক ২০ শতাংশের নিচে নামেনি।

অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস আগস্টে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ, প্রথম মাস জুলাইয়ে এই প্রবৃদ্ধি ছিল দুই অঙ্কের ঘরে (ডাবল ডিজিট), ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৯ দশমিক ৮০ শতাংশ। সে হিসাবে সেপ্টেম্বরের প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে দশমিক ৬০ শতাংশীয় পয়েন্ট কম।

কিন্তু যে মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদহার বাড়িয়ে বেসরকারি ঋণে লাগাম দিয়েছে, সেই মূল্যস্ফীতি অক্টোবরে ফের দুই অংকের ঘরে পৌঁছেছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বৃহস্পতিবার মূল্যস্ফীতির হালানাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, অক্টোবর মাসে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে এই হার ছিল এক অঙ্কের ঘরে (সিঙ্গেল ডিজিট) ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। তার আগের মাস আগস্টে মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ। তারও আগে জুলাই মাসে দেশে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ, যা ছিল এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ।

অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে যাওয়ার মানে হলো, ব্যবসা ক্ষেত্রে বিনিয়োগ কমে যাবে। সেই সঙ্গে কমবে নতুন শিল্প স্থাপন বা শিল্প সম্প্রসারণের গতি। অবধারিতভাবে তার প্রভাব পড়বে কর্মসংস্থানে।

গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর ৮ আগস্ট থেকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু আইনশৃংখলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। এখনও স্বস্তি ফেরেনি সাধারণ মানুষের মধ্যে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ২০২২ সালের আগস্টে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ১৪ দশমিক শূন্য সাত শতাংশে উঠেছিল। এরপর থেকে কমছেই।

এডিপি বাস্তবায়ন তলানিতে
২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রথম প্রান্তিকে সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) অর্থ ব্যয় হয়েছে মোট বরাদ্দের মাত্র ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ; আগের ২০২৩-২৪ অর্থবছরে যা ছিল ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) সম্প্রতি এডিপি বাস্তবায়নের এই তথ্য প্রকাশ করেছে।

জুলাই ঘিরে আন্দোলন, নৈরাজ্য আর আগস্টে ক্ষমতার পালাবদলে তৈরি হওয়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে থমকে যাওয়া উন্নয়ন কাজের প্রভাবে এডিপি বাস্তবায়নের হার ১৫ অর্থবছরের মধ্যে সর্বনিন্মে নেমেছে।

আইএমইডি’র ওয়েবসাইটে ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে তথ্য পাওয়া যায়। এতে দেখা যায়, ওই অর্থবছর থেকে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে এর থেকে কম এডিবি বাস্তবায়ন হয়নি।

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার চলতি অর্থবছরে এডিপিতে ২ লাখ ৭৮ হাজার ২৮৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা বরাদ্দ রেখে বাজেট পাস করেছিল।

এছাড়া বিদেশি বিনিয়োগও কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ৩০ কোটি ডলারের নিট এফডিআই (সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ) এসেছে দেশে। গত অর্থবছরের একই সময়ে এই অঙ্ক ছিল ৩৫ কোটি ৩০ লাখ ডলার। এ হিসাবে এই তিন মাসে এফডিআই কমেছে ১৫ শতাংশ।

মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি কমেছে ৪১%
চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) পণ্য আমদানির এলসি (ঋণপত্র) খোলার তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে দেখা যায়, এই তিন মাসে বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য মোট ১ হাজার ৫৫৯ কোটি ১১ লাখ (১৫.৫৯ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খুলেছেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ কম। নিস্পত্তি কমেছে ২ দশমিক ৪০ শতাংশ।

২০২৩-২৪ অর্থবছরের এই তিন মাসে ১৬ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল। গত অর্থবছরের পুরো সময়ে এলসি খোলার পরিমাণ কমেছিল ৮ দশমিক ২৯ শতাংশ।

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে নতুন শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় ক্যাপিটাল মেশিনারি (মূলধনি যন্ত্রপাতি) আমদানির এলসি কমেছে ৪০ দশমিক ৯০ শতাংশ, নিস্পত্তি কমেছে ২৫ শতাংশ।

শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্য (ইন্টারমিডিয়েট গুডস) আমদানির এলসি কমেছে ৭ দশমিক ২২ শতাংশ, নিস্পত্তি কমেছে ১৩ দশমিক ৩৮ শতাংশ। জ্বালানি তেল আমদানির এলসি কমেছে ২৬ শতাংশ, নিস্পত্তি কমেছে ৭ দশমিক ১৬ শতাংশ। এই তিন মাসে শিল্পের কাঁচামাল আমদানির এলসি কমেছে ৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) সভাপতি আব্দুল হাই সরকার হ্যালো বাংলাদেশকে বলেন, মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ধারাবাহিকভাবে সঙ্কোচনমুখী মুদ্রানীতি গ্রহণ করছে। ফলে সকল ধরনের ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধিও কমে গেছে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনেরও একটা প্রভাব পড়েছে বলে জানান তিনি।

আরও যা পড়তে পারেন

কমেন্ট করুণ