Home টপ পোস্ট মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ: পাকিস্তান পারলেও বাংলাদেশ কেন পারছে না

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ: পাকিস্তান পারলেও বাংলাদেশ কেন পারছে না

ইকবাল হোসেন
২১১ views

দুই বছরের বেশি সময় ধরে দেশে মূল্যস্ফীতির হার বেশি। এই প্রবণতা শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশেও দেখা যাচ্ছে। পার্থক্য হলো, অনেক দেশ গত এক বছরে মূল্যস্ফীতির হার কমাতে সক্ষম হলেও বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি বেড়েই চলেছে। পাকিস্তানের মতো অর্থনৈতিকভাবে দুর্দশাগ্রস্ত দেশও মূল্যস্ফীতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে। অথচ বাংলাদেশ পারছে না, বরং এখানে মূল্যস্ফীতি উল্টো বাড়ছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ত্রুটিপূর্ণ বাজার ব্যবস্থাপনা এবং বাজারে মূল্য কারসাজির প্রবণতা অর্থাৎ নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর তদারকিতে ব্যর্থতা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বল ভূমিকার কারণেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

২০২২ সালের আগস্ট মাস থেকে দেশে মূল্যস্ফীতির চাপ শুরু হয়। এর পর থেকে কোনো মাসেই মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৮ শতাংশের নিচে নামেনি। এখন তো ১১ শতাংশের বেশি। সরকারি হিসাবেই তা এতটা হলে বাস্তব পরিস্থিতি যে আরও নাজুক, তা বলাই বাহুল্য। মূল্যস্ফীতির কারণে, বিশেষ করে দরিদ্র ও সীমিত আয়ের মানুষের অবস্থা সঙ্গীন হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-জুন সময়ের মধ্যে দেশে গড় মূল্যস্ফীতির হার ৯.৭৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা ১৩ অর্থবছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। সর্বশেষ নভেম্বরে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশে ঠেকেছে, যা আগের মাসেও ছিল ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ। নভেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১৩ দশমিক ৮ শতাংশে ঠেকেছে, অক্টোবরেও যা ছিল ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশ।

 

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পাকিস্তান যেভাবে সফল

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অস্বস্তিতে ছিল পাকিস্তানের অর্থনীতি। রাজনৈতিক নানা টানাপোড়েনের মধ্যে দেশটির মূল্যস্ফীতি ৪০ শতাংশে পৌঁছে যায়। কিন্তু পরে ধাপে ধাপে নীতি পরিবর্তনের মাধ্যমে গত নভেম্বরে দেশটির মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৯ শতাংশে, অক্টোবরেও দেশটির মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ২ শতাংশ।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বড় ব্যবধানে নীতি সুদহার কমিয়েছে পাকিস্তান। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত নভেম্বরের শুরুর দিকে সুদহার ২৫০ ভিত্তি পয়েন্ট কমিয়ে ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা দেয়। মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) ২০০ ভিত্তি পয়েন্ট সুদহার কমিয়েছে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে সুদহার ১৫ থেকে ১৩ শতাংশে নেমে এসেছে। এর মাধ্যমে পাকিস্তানের ইতিহাসে রেকর্ড পরিমাণ নীতি সুদহার কমানো হলো, যার উদ্দেশ্য হলো ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতি চাঙা করা। এর আগে গত জুন থেকে চার দফায় পাকিস্তান নীতি সুদহার ৭০০ ভিত্তি পয়েন্ট কমিয়েছিল। পাকিস্তানের অর্থনীতি অনেক দিন ধরেই খারাপ অবস্থার মধ্যে রয়েছে। অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি জোরদার করতে সুদের হার কমানো প্রয়োজন।

স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান সুদের হার কমানোর পক্ষে বলেছে, বর্তমানে যে মুদ্রানীতি রয়েছে, তা পণ্য মূল্য স্থিতিশীল রাখতে সহায়ক এবং মূল্যস্ফীতি ৫ থেকে ৭ শতাংশের মধ্যে রাখতে পারবে। এটি একই সঙ্গে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা ও টেকসই ভিত্তিতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করবে। পাকিস্তান-কুয়েত ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানির সহকারী ভাইস প্রেসিডেন্ট আদনান শেখ দেশটির গণমাধ্যমকে বলেন, নীতি সুদহার প্রত্যাশার বেশি কমানোর কারণে মূল্যস্ফীতি খুব দ্রুত কমে এসেছে।

বাংলাদেশ কেন পারছে না

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি বাংলাদেশে একটি কাঠামোগত সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি দিয়ে এর সমাধান হবে না। বাজারে পণ্যের প্রকৃত চাহিদা নিরুপণ করে পর্যাপ্ত সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। মুদ্রানীতি, রাজস্বনীতি এবং বাজার ব্যবস্থাপনা- এই তিনের যথাযথ সমন্বয় ঘটাতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, এনবিআর, ট্যারিফ কমিশন, প্রতিযোগিতা কমিশন, ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ বাজারের সাথে সম্পৃক্ত সরকারি সংস্থাগুলোকে একযোগে কাজ করতে হবে। টাকা-ডলার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে হবে। শুল্ক কমানোর পরও কেন বাজারে তার প্রভাব পড়ছে না, তার কারণ খুঁজে বের করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। যেকোনো মূল্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে হবে। পণ্য পরিবহণে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে জরুরি বিষয় হচ্ছে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ও বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিক করা। তিনি হ্যালো বাংলাদেশকে বলেন, মূল বিষয় হলো চাহিদা ও সরবরাহ। কিন্তু দেশে কত চাহিদা আছে আর কত সরবরাহ হচ্ছে, সেই হিসাব নেই। অনেক সময় কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব মেলে না। বাজারে কখন ঘাটতি হতে পারে, সেই বার্তা আগেভাগেই আমদানিকারকদের দিতে হবে। সেই সঙ্গে এসব আমদানির জন্য দ্রুত এলসি খোলার ব্যবস্থা করতে হবে। ভারতে কৃষিপণ্যের মূল্য নির্ধারণে স্থায়ী কমিশন আছে, যারা সবসময় বাজার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে কৃষক ও ভোক্তা—উভয়ের স্বার্থই রক্ষা করে। কিন্তু আমাদের সে রকম কিছু নেই।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) যদি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য যথেষ্ট পরিমাণে সময়মতো আমদানি করে, তাহলে বাজারে চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে সমন্বয় থাকবে। সে জন্য তাদের আরও বেশি পণ্য আমদানি করা উচিত বলে মনে করেন মোস্তাফিজুর রহমান।

তিনি বলেন, দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা আছে। মূল বিষয়য় হলো, চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা। এ ক্ষেত্রে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হলে বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যায়। আমাদের দেশে অনেক ক্ষেত্রেই কৃত্রিমভাবে ভারসাম্যহীনতার পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়। সমস্যা হলো, এসবের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।

তিনি আরও বলেন, অর্থনৈতিকভাবে অনেক নাজুক অবস্থায় থাকলেও পাকিস্তানের বাজার ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশের চেয়ে শক্তিশালী। সে কারণে তারা মূল্যস্ফীতি কমাতে পেরেছে। অন্যান্য যেসব দেশ মূল্যস্ফীতি কমাতে পেরেছে, তাদের বাজার ব্যবস্থাপনাও শক্তিশালী। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে।

আরও যা পড়তে পারেন

কমেন্ট করুণ