বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। ভোগ্যপণ্য, শিল্পের কাঁচামাল, ভোজ্য ও জ্বালানি তেল, প্রযুক্তি পণ্যের জন্য বাংলাদেশ অনেকটাই আমদানিনির্ভর। আমদানি নির্ভরতার কারণে দেশে দিনদিন সংকট বাড়ছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, শতভাগ আমদানি নির্ভরতায় যেকোনো সময় বিপর্যয়ের আশঙ্কা থাকে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং করোনা মহামারি সময় সাপ্লাই চেইনে বিপর্যয়ের সময় এই চিত্র দেখা গেছে।
গত বছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে সব মিলিয়ে ৬ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ৬৫ শতাংশ বা ৪ লাখ কোটি টাকার পণ্যই এসেছে চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, মালয়েশিয়া, রাশিয়া, জাপান ও সিঙ্গাপুর— এই ৯টি দেশ থেকে৷ এরমধ্যে আবার ৪৫ শতাংশ পণ্যই এসেছে চীন ও ভারত থেকে। ভারত থেকে বেশি আসে ভোগ্যপণ্য, আর চীন থেকে বেশি আসে প্রযুক্তিপণ্য।
গত বছর চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে মোট আমদানির প্রায় অর্ধেকই ছিল ২৫টি পণ্যের দখলে। এই ২৫টি পণ্যের বেশিরভাগ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, নির্মাণ সমগ্রী এবং অন্যান্য শিল্পের কাঁচামাল।
গত অর্থবছরে (২০২৩-২৪) দেশের প্রধান এই সমুদ্রবন্দর দিয়ে ৪ দশমিক ৬২ লাখ কোটি টাকা মূল্যের প্রায় ৮৮ দশমিক ৫ মিলিয়ন টন পণ্য আমদানি হয়েছে। আমদানি করা ৪ হাজার ৭৮৮ ধরনের পণ্যের মধ্যে মাত্র ২৫টি পণ্যের জন্য ব্যয় হয়েছে ২ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকা।
এই বন্দর দিয়ে আমদানি করা পণ্যের মধ্যে আছে— তুলা, ডিজেল, স্ক্র্যাপ জাহাজ, ফার্নেস অয়েল, পাম অয়েল, সিমেন্ট ক্লিংকার, গম, অপরিশোধিত তেল, সার, সয়াবিন, হট রোল্ড ইস্পাত, মসুর ডাল, লোহা ও ইস্পাত কাঠামো, ভাঙা পাথর এবং মটর।
গত অর্থবছরে শীর্ষ ২৫টি আমদানি পণ্যের মধ্যে ১৪টি থেকে সরকারের ২১ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় হয়েছে, বাকি ১১টি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বা রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল হওয়ায় শুল্কমুক্ত প্রবেশের অনুমতি পেয়েছে।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম ‘হ্যালো বাংলাদেশ’কে বলেন, আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে নিজস্ব উৎপাদনের মাধ্যমে চাহিদা মেটানো ও রপ্তানিযোগ্য পণ্য উৎপাদন এবং বিশ্বে নতুন নতুন বাজার তৈরির বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করা উচিত। রপ্তানি সক্ষমতা বাড়ানো ও আমদানিনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে অধিক শিল্পায়ন এবং উৎপাদনের ফলে অভ্যন্তরীণ বাজারও সম্প্রসারিত হবে, কর্মসংস্থানও বাড়বে।
কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, মোট আমদানি ব্যয়ের প্রায় ৮ দশমিক ৭ শতাংশ বা ৪০ হাজার ৮২ কোটি টাকা তুলা আমদানিতে ব্যয় হয়েছে, যা পোশাক শিল্পের মূল কাঁচামাল হিসেবে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পায়। আমদানি ব্যয়ের দিক থেকে এরপর আছে ডিজেল, ফার্নেস অয়েল ও অপরিশোধিত তেল।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৪৮ হাজার ৯০০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রায় ৯ দশমিক ৩৪ মিলিয়ন টন এই তিন জ্বালানি আমদানি করা হয়েছে, যা আগের বছর ছিল ৪১ হাজার ৫৩ কোটি টাকা মূল্যের ৯ দশমিক ৬২ মিলিয়ন টন।
এদিকে গত অর্থবছরে ২৬ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা মূল্যের ৫ দশমিক ১৯ মিলিয়ন টন ব্যবহৃত ও স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি করা হয়েছিল, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৩৩ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা মূল্যের ৬ দশমিক ৮১ মিলিয়ন টন।
একই সময়ে ৩৪ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা মূল্যের ৩ দশমিক ৪৬ মিলিয়ন টন পাম, সয়াবিন ও সয়াবিন বীজ আমদানি হয়েছে, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৩১ হাজার ২১৮ কোটি টাকার ৩ দশমিক ৮৭ মিলিয়ন টন।
এছাড়া ১২ লাখ টন সার আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ১০ হাজার ৪২১ কোটি টাকা, ১৭ দশমিক ৭ মিলিয়ন টন সিমেন্ট ক্লিংকারে ১১ হাজার ৩০৪ কোটি টাকা এবং ২৫ লাখ টন গম আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ১১ হাজার ৯৯ কোটি টাকা।
একই সময়ে ৪২ লাখ টন কয়লার জন্য ৬ হাজার ৬২৩ কোটি টাকা, ৭ লাখ টন হট রোল্ড স্টিলের জন্য ৪ হাজার ৯৪৯ কোটি টাকা, ৪ দশমিক ৯৬ লাখ টন মসুর ডালের জন্য ৪ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা এবং ১২ মিলিয়ন টন পাথরের জন্য ২ হাজার ৮৩১ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।
চীন ও ভারত থেকে বেশি আমদানি
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি ২৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ অথবা ১ হাজার ৯৩৫ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে চীন থেকে। তারপরই ভারতের অবস্থান। দেশটি থেকে আমদানি হয়েছে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১ হাজার ৩৬৯ কোটি ডলারের পণ্য, যা মোট আমদানির ২০ দশমিক ১১ শতাংশ।
চীন থেকে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি আমদানি করে শিল্পকারখানার যন্ত্রপাতি। দেশটি থেকে গত অর্থবছর ৪২৫ কোটি ডলারের যন্ত্রপাতি আমদানি হয়েছে। তারপর সবচেয়ে বেশি আমদানি হয়েছে বস্ত্র খাতের কাঁচামাল তুলা। গত অর্থবছর ২২৮ কোটি ডলারের তুলা আমদানি হয়েছে। এ ছাড়া ১৯১ কোটি ডলারের ইলেকট্রনিক পণ্য, ১৩৭ কোটি ডলারের নিট কাপড়, ১২২ কোটি ডলারের কৃত্রিম তন্তু আমদানি হয়েছে।
অন্যদিকে ভারত থেকে বর্তমানে তুলা আমদানি হচ্ছে বেশি। গত অর্থবছর দেশটি থেকে মোট আমদানির ৩১ শতাংশ ছিল তুলা। অর্থের হিসাবে ৪২২ কোটি ডলার। এ ছাড়া ২২১ কোটি ডলারের শস্য, ৭৭ কোটি ডলারের মোটরযান, ৫৭ কোটি ডলারের চিনি ও চিনিজাতীয় পণ্য, ৫৪ কোটি ডলারের জীবাশ্ম জ্বালানি আমদানি হয়েছে।
ভারত ও চীনের নানা ধরনের পণ্যের ওপর বাংলাদেশের এত নির্ভরশীলতার কারণ জানতে চাইলে বিশ্ব ব্যাংকের বাংলাদেশ অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন ‘হ্যালো বাংলাদেশ’কে বলেন, কোনো ব্যবসায়ীকে কেউ তো আর বলেনি আপনি ভারত থেকে আমদানি করেন, চীন থেকে আমদানি করেন। ব্যবসায়ীরা যেখানে সাশ্রয়ী মূল্যে পান, সেখান থেকে আমদানি করেন। এটা অর্থনীতির একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখন আমরা যদি মনে করি, এত আমদানি করব না, তাহলে চলবে না। আপনাকে প্রয়োজন অনুযায়ী আমদানি করতে হবে। সবকিছুর কাঁচামাল আপনি নিজে উৎপাদন করতে পারবেন না। তবে হ্যাঁ, আপনি যদি উৎপাদনে যেতে পারেন, সেটা তো ভালো। আগে যেমন আমরা সাইকেল আমদানি করতাম, এখন দেশে উৎপাদন করে বিদেশে রপ্তানি করছি। আবার সিমেন্টও আগে আমদানি করতাম, এখন উৎপাদন করে বিদেশে রপ্তানি করছি। এভাবে পারলে তো ভালো।

ছবি: হ্যালো বাংলাদেশ
বেড়েছে ৬ কৃষিপণ্যের আমদানি, কমেছে ৫টির
গত অর্থবছর (২০২৩-২৪) দেশে গম, মসুর ডাল, রসুন, হলুদ, জিরা ও আলুর আমদানি বেড়েছে। আর কমেছে ভুট্টা, ছোলা, মুগডাল, পেঁয়াজ ও আদার আমদানি। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে চাল বাদে প্রায় ৮৭ লাখ ১২ হাজার টন ১১টি খাদ্য ও কৃষি পণ্য আমদানি হয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে যা ছিল ৯১ লাখ ৫৫ হাজার টন। গত অর্থবছরে প্রধান খাদ্যশস্য হিসেবে গম সবচেয়ে বেশি আমদানি হয়েছে, ৬৬ লাখ ৬২ হাজার টন, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় সাড়ে ১৬ লাখ টন বেশি।
তবে এই সময়ে ভুট্টার আমদানি কমেছে। গত অর্থবছরে ভুট্টার আমদানি ছিল তিন লাখ ৮৪ হাজার টন, যা আগের অর্থবছরে ছিল ২১ লাখ ৬৩ হাজার টন।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গম ও ভুট্টার পাশাপাশি গত অর্থবছরে মসুর ডাল আমদানি ছিল প্রায় পাঁচ লাখ ২৯ হাজার টন। এ ছাড়া ছোলা এক লাখ ৮০ হাজার টন, মুগ ডাল প্রায় সাত হাজার টন, পেঁয়াজ পাঁচ লাখ ৯৭ হাজার টন এবং রসুন আমদানি করা হয় এক লাখ টন।
অন্যান্য পণ্যের মধ্যে আদা ৮৯ হাজার টন, হলুদ ৩০ হাজার টন, জিরা ৩৩ হাজার টন এবং আলু আমদানি করা হয় ৯৭ হাজার টন। যদিও গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে আলু আমদানি করা হয়নি।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত কয়েক বছরের ব্যবধানে এসব খাদ্যপণ্যের আমদানি কমে আসছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট আমদানির পরিমাণ ছিল ৯২ লাখ ৩৩ হাজার টন, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছিল ৯১ লাখ ৫৫ হাজার টন।
তবে গত অর্থবছরে আমদানি কমার পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে ভুট্টা। এক বছরের ব্যবধানে ভুট্টার আমদানি কমেছে প্রায় ১৮ লাখ টন। দেশে এসব পণ্যের উৎপাদনে ঘাটতি থাকায় আমদানি করতে হচ্ছে। এতে প্রচুর বৈদেশিক অর্থ ব্যয় হচ্ছে।
এ বিষয়ে কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম ‘হ্যালো বাংলাদেশ’কে বলেন, জনসংখ্যা বা মানুষের খাদ্যপণ্যের চাহিদা যে হারে বাড়ছে, সেই হারে কৃষি ও খাদ্যপণ্যের উৎপাদন বাড়ছে না। এ জন্য অমদানিনির্ভর হতে হচ্ছে। সব পণ্য আমরা উৎপাদন করতে পারব না, কিন্তু যেসব পণ্যের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব, সেটি করতে হবে। তবে এখানে কয়েকটি বাধা রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম কৃষকের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া। এতে কৃষক অনেক সময় নিরুৎসাহ হয়। ফলে দেশীয়ভাবে উৎপাদনে সক্ষম থাকলেও হয়তো সেই সুযোগ কাজে লাগানো যাচ্ছে না। তাই আমদানি বিকল্প পণ্য উৎপাদনে জোর দিতে হবে। এ জন্য কৃষকের সহায়তা আরো বাড়াতে হবে।
২৫ লাখ টনের বেশি ভোজ্যতেল আমদানি
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালে প্রায় ২৫ লাখ সাত হাজার টন সয়াবিন ও পাম তেল আমদানি করা হয়। বাংলাদেশে ভোজ্যতেলের বার্ষিক চাহিদা ২৫ লাখ টনের বেশি। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানির মাধ্যমে এই চাহিদার প্রায় ৪৫ শতাংশ পূরণ হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোর হিসাবে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে সয়াবিন আমদানি বাড়ছে। ইউএসএসইসির তথ্য অনুসারে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ এক দশমিক ৮৯ মিলিয়ন টন সয়াবিন, খাবার ও তেল আমদানি করেছে।
জানা গিয়েছে, পাম ও সয়াবিন তেল পরিশোধিত ও অপরিশোধিত আকারে আমদানি হয়। আমদানি করা সয়াবিন তেল স্থানীয়ভাবে পরিশোধনের পর বাজারজাত করা হয়। তবে দেশের বাজারে ব্যবহার ও আমদানি বেশি হয় প্রধানত পরিশোধিত পাম অয়েল। পাম অয়েলের ক্ষেত্রে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া— এ দুই দেশের ওপর নির্ভরতা রয়েছে দেশের ব্যবসায়ীদের। তবে সয়াবিন আসছে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা থেকে।