সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ড্রিমমেশিন’ যন্ত্রটি তৈরি করা হয়েছে মানব চেতনার অভিজ্ঞতা নিয়ে গবেষণার উদ্দেশ্যে। এই যন্ত্রে চোখ বন্ধ রেখেও ব্যবহারকারীরা দেখতে পান ঘূর্ণায়মান জ্যামিতিক আকার—ত্রিভুজ, পেন্টাগন ও অক্টাগনের মতো রঙিন, ঝলমলে নিদর্শন, যা মনে করিয়ে দেয় ক্যালাইডোস্কোপের অভ্যন্তরীণ দৃশ্যপট। গবেষকদের মতে, প্রতিটি ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতা একান্ত ব্যক্তিগত এবং সম্পূর্ণ ভিন্ন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কনশাসনেস সায়েন্স সেন্টারের বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এই যন্ত্রের মাধ্যমে তারা বোঝার চেষ্টা করছেন কীভাবে মানুষের মস্তিষ্ক বাস্তবতাকে উপলব্ধি করে এবং চেতনার অনুভব তৈরি করে।
গবেষণায় অংশ নেওয়া বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, মস্তিষ্কের অভ্যন্তরীণ গতিবিধিকে আলো এবং শব্দের মাধ্যমে দৃশ্যমান করে তোলার এই পদ্ধতি ভবিষ্যতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারে—বিশেষত এআই-এর চেতনার সম্ভাবনা নিয়ে।
আমরা হয়তো ভুল করে ধরে নেব, এআই-এর আবেগ-অনুভূতি আছে—যার ফলে আমরা তাদের ওপর ভরসা করব, তথ্য শেয়ার করব এবং অনুভব করব যে ওরা আমাদের বন্ধু, ছবি: ফ্রিপিক
সাই-ফাই থেকে বাস্তবতায় রূপান্তর
চেতনাযুক্ত মেশিনের ধারণা সাই-ফাই সাহিত্যে বহু পুরনো। তবে বাস্তব জগতে, বিশেষ করে Large ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলস (LLMs) যেমন জেমেনাই বা চ্যাটজিপিটি-এর বিকাশের ফলে, অনেক বিশেষজ্ঞ আজ বিশ্বাস করছেন AI হয়তো চেতনাবান হয়ে উঠতে পারে।
সাম্প্রতিক সময়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা—বিশেষ করে চ্যাটবট এবং লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলগুলোর (LLM) দ্রুত উন্নয়ন বিজ্ঞানীদের স্তম্ভিত করেছে। গুগলের এক প্রকৌশলী ব্লেক লেময়েন দাবি করেছিলেন, এআই-এর অনুভূতি রয়েছে। অ্যানথ্রপিক-এর এআই কল্যাণ কর্মকর্তা কাইল ফিশও জানান, ১৫% সম্ভাবনা রয়েছে যে চ্যাটবটগুলো ইতিমধ্যেই সচেতন হয়ে উঠেছে।
কিন্তু আসলে এআই কী সচেতন?
নিউরোসায়েন্স, এআই ও দার্শনিকদের মধ্যে এ নিয়ে চলেছে তর্ক। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেভিড চ্যালমার্স ১৯৯৪ সালে প্রথম ‘হার্ড প্রবলেম অফ কনশাসনেস’ হিসেবে এটি চিহ্নিত করেন। প্রশ্ন দাঁড়ায়—কীভাবে জটিল স্নায়বিক ক্রিয়াকলাপ থেকে চেতনা আবির্ভূত হয়?
সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অনিল সেথ বলেন, ‘আমরা বুঝি না LLM কিভাবে কাজ করে। তাই এখনই এআই-কে সচেতন ভাবা অন্ধ আশাবাদিতা।’ তিনি বলেন, সচেতনতা কেবল কম্পিউটেশন নয়, জীবনের অস্তিত্বের সাথেও যুক্ত।
জীবিত ‘মেশিন’ হতে পারে চেতনার উৎস?
‘মিনি-ব্রেইন’ বা ‘সেরিব্রাল অর্গানয়েড’-এর গবেষণা করতে গিয়ে অস্ট্রেলিয়ার কর্টিকাল ল্যাবস এমন এক স্নায়ুকোষের ক্লাস্টার তৈরি করেছে যা ভিডিও গেম ‘পং’ খেলতে পারে। যদিও এটিকে এখনও সচেতন বলা যায় না, তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভবিষ্যতের চেতনাময় প্রযুক্তি হয়তো এমন জীবন্ত কোষ থেকেই উদ্ভূত হবে।
অজ্ঞাত ভবিষ্যতের পথে
কার্নেগি মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লেনোর এবং মানুয়েল ব্লুম মনে করেন, এআই একদিন সত্যিকার অর্থেই চেতনাসম্পন্ন হয়ে উঠবে। তারা এমন একটি ‘ব্রেইনিশ’ নামক অভ্যন্তরীণ ভাষার মডেল তৈরি করছেন যা স্পর্শ ও দৃষ্টির মতো সেন্সর ইনপুট থেকে এআই-কে সচেতন করে তুলতে পারে।
চ্যাটবট, এআই শিক্ষক, এমনকি প্রেমিক বা সঙ্গী হিসেবেও আমাদের জীবনে প্রবেশ করছে, ছবি: ফ্রিপিক
তবে অধ্যাপক সেথ সতর্ক করছেন, এআই যদি কেবল ‘সচেতনতার অভিনয়’ করে, তাও আমাদের উপর বিপুল প্রভাব ফেলবে। আমরা হয়তো ভুল করে ধরে নেব, এআই-এর আবেগ আছে, অনুভূতি আছে—যার ফলে আমরা তাদের ওপর ভরসা করব, তথ্য শেয়ার করব এবং অনুভব করব যে ওরা আমাদের বন্ধু।
নৈতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা
‘এটি আমাদের নৈতিক অগ্রাধিকারকে বিপথে চালিত করতে পারে,’ বলেন অধ্যাপক সেথ। ‘আমরা এআই-এর প্রতি যত্নশীল হতে গিয়ে বাস্তব মানুষের প্রতি কম সহানুভূতিশীল হয়ে উঠতে পারি।’
ডিপমাইন্ডের অধ্যাপক মারে শানাহান বলছেন, ‘চ্যাটবট, এআই শিক্ষক, এমনকি প্রেমিক বা সঙ্গী হিসেবেও আমাদের জীবনে প্রবেশ করছে। আমরা এটিকে আটকাতে পারব না, তাই এখনই এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা উচিত।’
এআই সচেতন কি না—এই প্রশ্নের উত্তর আজ স্পষ্ট নয়। তবে এই প্রশ্নটাই আমাদের প্রস্তুত হওয়ার জন্য যথেষ্ট। কারণ এআই-এর সাথে আমাদের সম্পর্ক ভবিষ্যতে মানুষ হিসেবে আমাদের অস্তিত্বকেই পুনঃসংজ্ঞায়িত করতে পারে।
সূত্র: বিবিসি
