অদম্য নারী উদ্যোক্তা জেসমিন সুলতানা। তার হাতের নিপুণ ছোঁয়ায় পাটজাত পণ্য আকর্ষণীয় হয়ে উঠে। পাটের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা দেখে অনেকে তাকে ‘পাটকন্যা’ বলে ডাকেন। নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে নিজের একান্ত চেষ্টা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে আজ তিনি সফল উদ্যোক্তা। তার উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প, ব্যবসার শুরু-প্রসার, প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলাসহ নানা বিষয়ে হ্যালো বাংলাদেশের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সিনিয়র রিপোর্টার ইকবাল হোসেন।
কেন একজন উদ্যোক্তা হওয়ার ইচ্ছে জাগলো? আপনার উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্পটা জানতে চাই।
বুটিক্স নিয়ে অনেক দিন কাজ করেছি। কয়েক বছর বিদেশে থাকার পর দেশে ফিরে দেখলাম অনেকে বুটিক্স নিয়ে কাজ করছে। একঘেয়েমি লাগছিল। নতুন কিছু করার শখ জাগল। শাড়িতে, পাঞ্জাবিতে, কুর্তিতে পাট দিয়ে ডিজাইন করলাম। তখন পাট দিয়ে ডিজাইন করার তেমন প্রচলন ছিল না। সময়টা ২০১২ সাল। মাত্র ৫ হাজার টাকা দিয়ে দুইটা শাড়ি কিনে পাটের ডিজাইন করলাম। ভাই ও ভাবিকে কাজটা দেখালাম। তারা উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন। দ্বিগুণ দাম দিয়ে শাড়ি দুটো কিনে নিলেন। এতে অনেক উৎসাহ পেলাম। মনে হলো এ কাজগুলো আমি করতে পারবো। তখন থেকে আস্তে আস্তে শুরু করলাম।
ব্যবসার শুরুটা কিভাবে হয়েছিল?
আমার স্বামী সাংবাদিক। তার সূত্রে জাতীয় প্রেসক্লাবে আমার যাতায়াত ছিল। প্রেসক্লাবের তখনকার সাধারণ সম্পাদক ফরিদা আপাকে আমার কাজগুলো দেখলাম। তিনি কয়েকটা ডিজাইন দিতে বললেন। চারটা ডিজাইন জমা দিলাম। তারা সেগুলো অনেক পছন্দ করলেন। প্রেসক্লাব থেকে ৩০০ শাড়িতে পাটের ডিজাইন করার অর্ডার (ক্রয়াদেশ) পেলাম। প্রায় চার লাখ টাকার কাজ ছিলো সেটা। বিলটা হাতে পাওয়ার পর কাজ করার দারুন উৎসাহ জাগলো। এভাবে শুরু হলো আমার পথ চলা।
রাজধানীর অফিসার্স ক্লাবে জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টার বা জেডিপিসির আয়োজনে একটা মেলায় অংশ নিয়েছিলাম সেখানে স্টল বরাদ্দ পায়নি। মেলার একটা কর্ণারে আমার পণ্যগুলো নিয়ে বসার জন্য জেডিপিসির কর্মকর্তাদের অনেক অনুরোধ করেছিলাম। সবাই নিষেধ করলেও এক নারী কর্মকর্তা আমাকে বসার সুযোগ দিলেন। আমার ডিজাইন করা পণ্যগুলো ডিসপ্লে করলাম, সেগুলো দেখে সবাই ইমপ্রেস (মুগ্ধ) হলো। সবাই আমার ইউনিক আইডিয়ার প্রশংসা করল। মেলায় ফ্যাশন শোর জন্য আমার ডিজাইন করা সবগুলো ফতুয়া কিনে নিলো। জেডিপিসির এক নারী কর্মকর্তা কাজের অনেক প্রশংসা করলেন। তিনি আমাকে শতভাগ পাটের পণ্য নিয়ে কাজ করার পরামর্শ দিলেন। এতে অনেক উৎসাহ পেলাম।

ছবি: হ্যালো বাংলাদেশ
উদ্যোক্তা হওয়ার পথে কি কি প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করেছেন?
আমার স্বামী এসব কাজ পছন্দ করতেন না। অনেক কটু কথা শুনাতেন। এতে অনেক কষ্ট পেতাম। প্রথম দিকে পুঁজি অনেক কম ছিল। উপকরণ সংগ্রহ করার জন্য অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। ইমামগঞ্জ, গুলিস্তানসহ বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে পায়ে হেটে কাপড় সংগ্রহ করতাম। খরচ কমাতে রিকশায় উঠতাম না, পায়ে হেটে ও বাসে যাতায়াত করতাম। আমার স্বামী এগুলো পছন্দ করতেন না। অনেক বকা দিতেন। নিরুৎসাহিত করতেন। এতে অনেক মন খারাপ হতো।
উদ্যোক্তা হতে পরিবার, ব্যাংক বা অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো সহায়তা পেয়েছেন?
উদ্যোক্তা হওয়ার পথে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা পেয়েছি আমার ভাই ও ভাবির কাছ থেকে। আমার এক বন্ধু থাকে কানাডায়। সে অনেক সাপোর্ট দিয়েছে। জেডিপিসি আমাকে অনেক সহযোগিতা করে। প্রতিষ্ঠানটি যত ইভেন্ট আয়োজন করে সেখানে আমন্ত্রণ জানায়। আমার প্রোডাক্টগুলো জেডিপিসির কর্মকর্তারা অনেক পছন্দ করেন।
বিশ্বব্যাংকের এক প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছিলাম। সেখানে আমাকে নিয়ে করা একটা ভিডিও ভাইরাল হয়। বিশ্বব্যাংক পরে একটা মেলায় আমাকে আবার আমন্ত্রণ জানায়। সেখানে আমাকে তারা ব্র্যান্ডিং করে। মেলায় আমার ছবি দিয়ে বড় বড় ব্যানার-ফেসটুন করে। বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তারা আমাকে অনেক উৎসাহ দিয়েছেন। তাদের বিভিন্ন রপ্তানি প্রদর্শনীতে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। সংস্থাটি বিভিন্নভাবে সহায়তা করে। বিশ্বব্যাংকের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান আইএফসি নারী উদ্যোক্তাদের উন্নয়নের জন্য নেওয়া প্রকল্প থেকে আমাকে ঋণ দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে।

ছবি: হ্যালো বাংলাদেশ
আপনার ব্যবসার বর্তমান অবস্থা কেমন? কী কী পণ্য ব্যবসায় যুক্ত হয়েছে?
ব্যবসার বর্তমান অবস্থা মোটামুটি ভালো। মাসে গড়ে এক লক্ষ টাকার বেশি বেচাকেনা হয়। রাজধানীর লালমাটিয়ায় আমার বাসায় শো-রুম আছে। আমার প্রতিষ্ঠানের নাম সোনালী উঠোন। সেখানে ভালো বিক্রিবাট্টা হয়। মেলা, প্রদর্শনীসহ বিভিন্ন ইভেন্টে অংশ নিয়ে থাকি। সেগুলোতে ভালো সাড়া পাওয়া যায়। মেলা, প্রদর্শনীতে গড়ে প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা বেচাকেনা হয়। বর্তমানে গহনার বাক্স, ইকো ফ্রেন্ডলি ব্যাগ, মোম পালিস জুটের ফেন্সি ব্যাগ, পটের বিভিন্ন পুরানো চিত্র পাটের মাধ্যমে তুলে ধরি, বিভিন্ন ধরনের গহনাসহ প্রায় ৩০ থেকে ৪০টি বাহারি পণ্য রয়েছে আমার।
আপনার প্রতিষ্ঠানের তৈরি পণ্য রপ্তানি হয়?
সরাসরি রপ্তানি না করলেও, অনেকে বিদেশে শো-রুমের জন্য আমার কাছ থেকে বিভিন্ন পণ্য কিনে নিয়ে যায়। ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে আমার পণ্য যাচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পণ্য রপ্তানি জন্য চেষ্টা করেছি। একটা কোম্পানি আমাকে নিয়ে স্ট্যাডি করছে। তারা আমার কাজ নিয়ে একটা অ্যালবাম করেছে।
আগামীতে ব্যবসা প্রসারের কোন পরিকল্পনা আছে?
আগামীতে ব্যবসার প্রসারের পরিকল্পনা আছে। কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ পেলে একটা কারখানা করার ইচ্ছা আছে। ইউনিক আইডিয়া ও নিখুঁত কাজের মাধ্যমে পণ্যের মান বজায় রেখেছি।
সরকার বা কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে সফল উদ্যোক্তার স্বীকৃতি পেয়েছেন?
যখন মেলা, প্রদর্শনীসহ বিভিন্ন ইভেন্টে অংশগ্রহণ করি, তখন আমার পরনে থাকে পাটের শাড়ি-ব্লাউজ, গহনা থাকে পাটের, স্টলে থাকে শতভাগ পাট পণ্য। পাটের প্রতি এমন প্রগাঢ় ভালোবাসার দেখে বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশিরউদ্দিন আমাকে ‘পাটকন্যা’ বলে অভিহিত করেছেন। এখন আমি সবার কাছে ‘পাটকন্যা’ হিসেবে পরিচিত। বিশ্বব্যাংক ও সরকারি প্রতিষ্ঠান জেডিপিসি থেকে কাজের স্বীকৃতি হিসেবে সনদ ও অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি। বিশ্বব্যাংক আমাকে ব্র্যান্ডিং করেছে।

জেসমিন সুলতানা। ছবি: হ্যালো বাংলাদেশ
যারা নতুন উদ্যোক্তা হতে আগ্রহী তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কি?
উদ্যোক্তা হতে হলে অনেক ধৈর্য দরকার। পাশাপাশি দক্ষতা অর্জন করতে হবে। সৃজনশীল আইডিয়ার মাধ্যমে নতুন নতুন প্রোডাক্ট তৈরি করতে হবে। অনেকে নেতিবাচক কথা বলবে, সেগুলো অতিক্রম করে এগিয়ে গেলে ভালো করা যাবে। নিজের পরিবার, প্রতিবেশীসহ অনেকে কটু কথা বলবে। সেগুলোতে কান দেওয়া যাবে না। হাল ছাড়া যাবে না।
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে একজন নারী ব্যবসা করতে গেলে কি কি প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করতে হয়? এ থেকে উত্তরণের উপায় কি?
একজন নারী ব্যবসার করতে গেলে প্রথমত স্বামীর কাছ থেকে প্রতিবন্ধকতা আসে। এরপর আত্মীয়-স্বজন থেকে বাঁধা আসে। প্রতিবেশীরা অনেক কটু কথা বলে। এসব কথা না শুনে নিজের কাজটাকে ভালোবেসে এগিয়ে যেতে হবে। নেতিবাচক কথায় কখনো কান দেওয়া যাবে না।