দিল্লি ক্যাপিটালসের অন্য ক্রিকেটারদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে গ্র্যান্ড স্ট্যান্ডে বসে খেলা দেখছিলেন অ্যালিসা হিলি। হঠাৎ একে একে নিভে গেল স্টেডিয়ামের তিনটি ফ্লাডলাইট টাওয়ার, ক্রিকেটারদের মাঠ থেকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হলো। শুরুতে কিছু বুঝে উঠতে পারছিলেন না হিলি। পরে জানতে পারলেন ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা। ধরমশালার ওই রাতের অভিজ্ঞতা শোনালেন দিল্লি ক্যাপিটালসের অস্ট্রেলিয়ান পেসার মিচেল স্টার্কের স্ত্রী ও অস্ট্রেলিয়া নারী দলের এই ক্রিকেটার।
গত বৃহস্পতিবার রাতের ঘটনা এটি। সীমান্তে ভারত ও পাকিস্তানের হামলা-পাল্টা হামলার মধ্যেই চলছিল আইপিএল। ধরমশালার হিমাচল প্রদেশ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন স্টেডিয়ামে চলছিল দিল্লি ক্যাপিটালস ও পাঞ্জাব কিংসের ম্যাচ। পাঞ্জাবের ইনিংসের মাঝপথে ফ্লাডলাইট নিভে যাওয়ার মিনিট দশেক পরই ম্যাচ পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়।
তখন ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিসিআই) পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে বলা হয়, হিমাচল প্রদেশ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন স্টেডিয়ামে ‘গুরুতর কারিগরি ত্রুটির’ কারণে খেলা বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু বাস্তবে ঘটনা ছিল ভিন্ন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর আসে, জম্মুসহ সীমান্তবর্তী ভারতের কয়েকটি জায়গায় মিসাইল হামলা চালিয়েছে পাকিস্তান, এরপরই স্টেডিয়ামের আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়।
ধরমশালা থেকে খুব বেশি দূরে নয়, এমন একটি জায়গায় ‘এয়ার সাইরেন’ বেজে উঠেছিল। মূলত নিরাপত্তা শঙ্কায় ম্যাচটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। ওই সময় সামাজিক মাধ্যমে আসা একটি ভিডিওতে দেখা যায়, হাতের ইশারায় দর্শকদের স্টেডিয়াম ছেড়ে চলে যাওয়ার অনুরোধ করছেন আইপিএল চেয়ারম্যান অরুন ধুমাল।
পরদিন এক সপ্তাহের জন্য স্থগিত করা হয় আইপিএল। অন্য অনেক বিদেশি ক্রিকেটারের মতো স্টার্কও তার স্ত্রীকে নিয়ে ফিরে যান দেশে। সেখান থেকেই মঙ্গলবার হিলি ভয়াবহ সেই রাতের কথা তুলে ধরলেন ‘উইলো টক’পডকাস্ট’-এ।
“পরাবাস্তব এক অভিজ্ঞতা ছিল। হঠাৎ কিছু লাইট টাওয়ার নিভে গেল, আমরা তখন ওপরে বসে অপেক্ষা করছিলাম। একটা বড় গ্রুপ ছিল আমাদের- পরিবার ও অতিরিক্ত সাপোর্ট স্টাফদের। যে লোকটি সাধারণ আমাদের বাসে তুলে দেন, এক মিনিট পর তিনি এলেন, তার মুখ ছিল একেবারে ফ্যাকাশে। তিনি যেন বলছিলেন, ‘আমাদের এখনই যেতে হবে।’”
এই কিপার-ব্যাটার বলেন, দিল্লির দক্ষিণ আফ্রিকান ব্যাটসম্যান ফাফ দু প্লেসি যখন ড্রেসিং রুমে পৌঁছান, তখন তার পায়ে জুতাও ছিল না।
“তারপর আরেকজন লোক এলেন, তার মুখও ছিল ফ্যাকাশে, তিনি এক বাচ্চাকে ধরে বললেন, ‘আমাদের এখনই চলে যেতে হবে।’ আমরা মনে মনে বলছিলাম, ‘হচ্ছেটা কী?’ আমাদের কিছুই বলা হয়নি। আমাদের কিছুই জানা ছিল না। পরের মুহূর্তে আমাদের একটা ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো… সব খেলোয়াড়রা সেখানে ছিল। ফাফ দু প্লেসির পায়ে জুতাও ছিল না। আমরা সবাই সেখানে অপেক্ষা করছিলাম, সবাই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিল।”
হিলি তখন ঘটনার কারণ জানতে চান স্বামী স্টার্কের কাছে। “আমি মিচকে (স্টার্ক) জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হচ্ছে?’ সে বলল, ৬০ কিলোমিটার দূরের শহরে মিসাইল আঘাত হেনেছে, তাই এলাকাটি পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে গেছে। সে কারণেই আলো নিভে গেছে, কারণ তখন ধারামশালা স্টেডিয়াম যেন একটা আলোক সঙ্কেত হয়ে উঠেছিল। এরপর হঠাৎ আমাদের গাড়িতে তোলা হলো এবং হোটেলে ফিরিয়ে আনা হলো।”
ভারত ও পাকিস্তানের উত্তেজনাময় পরিস্থিতিতে সীমান্তবর্তী কয়েকটি বিমানবন্দর বন্ধ রেখেছিল ভারত। ধরমশালার একমাত্র বিমানবন্দর এবং পার্শ্ববর্তী কাংড়া ও চান্ডিগাড় বিমানবন্দরও বন্ধ ছিল।
পরদিন দুই দলের ক্রিকেটার থেকে শুরু করে আইপিএল সংশ্লিষ্ট সবাইকে কঠোর নিরাপত্তায় হোশিয়ারপুর হয়ে জলন্ধার রেল স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে বিশেষ ট্রেনে তাদের দিল্লি নেওয়ার ব্যবস্থা করে বিসিসিআই। ওই সময়ের অভিজ্ঞতাও শোনালেন হিলি।
“যখন আমরা দক্ষিণ-পশ্চিম (পাকিস্তান) সীমান্তের দিকে যাচ্ছিলাম, তখন কিছুটা ভয়ের ছিল। মিচ ও আমি অনেক বেশি ‘কল অব ডিউটি’ (ভিডিও গেম সিরিজ) খেলেছি, সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল সাইটগুলো দেখে আমরা চিনতে পারছিলাম। এগুলো রাডার-চালিত সিস্টেম, যা বিমানে মিসাইল ছোড়ে। আমরা ছোট শহরের পথে এগুলোর কয়েকটি দেখতে পেলাম।”
“গ্রামের কিছু লোক দিনের মাঝামাঝি সময় আতশবাজি ফোটাল। আমার মনে হয়, দুপুরের খাবারের সময় সবাই হিমশীতল হয়ে গেল, ঘুরে তাকাল, যেন বলল, ‘ওহ মাই গড!’ তারপর আমি স্পষ্ট করে বলতে পারলাম, আতশবাজি দেখতে পাচ্ছি। আমার মনে হয়, ওটা একটা বিয়ের আয়োজন ছিল। আশা করি, তাদের বিবাহিত জীবন সুখের হবে, কিন্তু সময়টা একদম ভালো ছিল না। একই সঙ্গে আতঙ্ক আর দুশ্চিন্তার মধ্যে ছিলাম, তবে মনে হচ্ছিল আমরা ঠিক থাকব, কারণ আমরা সরাসরি ফায়ারিং লাইনে ছিলাম না।”
পাল্টাপাল্টি হামলার চার দিনের মাথায় গত শনিবার যুদ্ধবিরতিতে যায় ভারত ও পাকিস্তান। স্থগিত হওয়া আইপিএল আবার শুরু হবে আগামী শনিবার। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবর, স্টার্ক আসরের বাকি অংশের জন্য আর ভারতে ফিরবেন না।
সূত্র: রয়টার্স