দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর ২০০৮ সালে রাজতন্ত্রের অবসান হয় নেপালে। দেড় দশক কেটে যাওয়ার পর আবারও রাজতন্ত্র ফেরানোর দাবিতে রাস্তায় নেমেছে দেশটির নাগরিকরা। প্রশ্ন উঠেছে, কেন তারা আগের শাসন ব্যবস্থায় ফিরে যেতে চাইছেন। তাহলে কী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ভালো নেই সাধারণ নেপালিরা।
হিন্দু অধ্যুষিত দেশটিতে প্রায় সব ধরনের শাসন ব্যবস্থার অভিজ্ঞতা রয়েছে নাগরিকদের। তারা দেখেছেন রাজতন্ত্র, সাংবিধানিক রাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র। এর মধ্যে তারা সবচেয়ে বাজে অবস্থা দেখেছেন গণতন্ত্র নামক শাসন ব্যবস্থায়। অবশ্য ২০০৮ সালে যখন আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্তি ঘটে রাজতন্ত্রের তখন রাজনৈতিক দলগুলো অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সাধারণ মানুষকে, যার একটিও বাস্তবায়ন হয়নি।
উল্টো লম্বা সময় ধরে চলছে আন্তঃকলহ ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে মতবিরোধ। হয়নি তরুণ-তরুণীদের কর্মসংস্থান। পাশাপাশি শান্তি না ফেরায় ভাগ্যের কোনো হেরফের হয়নি নেপালিদের। অত্যন্ত ২০২৫ সাল পর্যন্ত নিজেদের দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলোর কোনোটাই বাস্তবায়ন করতে পারেনি রাজতন্ত্র বিলোপের পক্ষে কাজ করা দল বা গোষ্ঠী।

গত ৯ মার্চ ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জ্ঞানেন্দ্রকে ব্যাপক সংবর্ধনা দেয় জনতা, ছবি: আল জাজিরা
কাঠমন্ডু পোস্টের তথ্য অনুযায়ী, গণতন্ত্র প্রবর্তন হওয়ার পর বিশৃঙ্খল ও অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে দেশটি। ২০০৮ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ গত ১৭ বছরে নেপালে ১৩ বার সরকার গঠন এবং সমসংখ্যকবার ভাঙন দেখেছে মানুষ। সঙ্গে ১৩ বার বদলেছে প্রধানমন্ত্রীও। আর দুই বছরের বেশি স্থায়ী হয়নি কোনো সরকার।
এক সময় রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে হাতে অস্ত্র নেওয়া বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো এখন একে অন্যের বিপক্ষে লড়াই করছে। গত দুই দশক ধরে দেশটির রাজনীতি ঘুরপাক খাচ্ছে গুটিকয়েক রাজনৈতিক ব্যক্তিকে ঘিরে। তারা হলেন- নেপালি কংগ্রেস দলের শের বাহাদুর দেউবা, কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপালের (মাক্স-লেনিনপন্থী) কেপি শর্মা অলি, কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপালের (মাওবাদী কেন্দ্র) পুস্প কমল দহল প্রচন্ড ও নেপাল সমাজতান্ত্রিক দলের বাবুরাম ভট্টরাই।

কাঠমাণ্ডুতে অবস্থিত নারায়ণহিতি প্রাসাদ; ২০০৮ সাল থেকে এটি জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে, ছবি: উইকি পিডিয়া
দেশটিতে বেকারত্বের হার ২০ শতাংশ। আর নিজেদের ছোট ছোট সমস্যাগুলো সমাধানে ব্যর্থ হচ্ছেন রাজনীতিবিদরা। কাজের সন্ধানে গড়ে প্রতিদিন নেপাল ছাড়ছে ১৭০০ মানুষ। এদের বড় অংশ যাচ্ছে ভারত, ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যে। বেকারত্বের পর সবচেয়ে বড় সমস্যা দুর্নীতি। রাজতন্ত্রের সময় ক্ষমতা এক কেন্দ্রিক থাকায় নিত্য জীবনযাত্রায় দুর্নীতির মুখোমুখি হতে হয়নি জনগণকে। এখন দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে।
কাঠমণ্ডু পোস্টের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২৩ সালে ২৮ হাজার দুর্নীতির মামলা নিবন্ধন হয়েছে দেশটিতে। দুর্নীতির দায়ে বহু সরকারি কর্মকর্তা বরখাস্ত বা কারবরণ করেছেন।
এ ছাড়াও নানা কারণে অসন্তুষ্ট মানুষ। তারা বঞ্চিত মৌলিক সুবিধা থেকেও। পাশাপাশি ৭৩ শতাংশ নাগরিক পায় না বিশুদ্ধ পানি। আর বিদ্যুতের আওতায় আসেনি ৩৫ লাখ মানুষ। পাহাড়ি এলাকায় নেই রাস্তা-ঘাট। বলতে গেলে জীবনমানের কোনো পরিবর্তন হয়নি সাধারণ মানুষের। তাই তারা বিরক্ত হয়ে উঠেছে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার ওপর!

কাঠমাণ্ডুতে রাজতন্ত্র ফেরানোর আন্দোলনে নেপালি পতাকা হাতে সাধারণ মানুষ, ছবি: স্বরাজ ডটকম
এ জন্য তারা ফেরত যেতে চাইছেন রাজতন্ত্রে। দেশটির রাজতন্ত্রের ইতিহাস ২৫০ বছরের। যেটা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাজা পৃথ্বী নারায়ণ শাহ। তার উত্তরসূরীরা ২০০৮ সাল পর্যন্ত শাসন করে নেপাল। সর্বশেষে রাজা ছিলেন জ্ঞানেন্দ্র। আর ১৭ বছর পর আবার আগের শাসন ব্যবস্থায় ফেরত যেতে মাঠে নেমেছে রাজার অনুসারী বা জনগণ।
শাসন ভার ছাড়ার পর দেশটিতে জনপ্রিয়তা কমেনি সাবেক রাজা জ্ঞানেন্দ্রের। জনগণের বিশাল একটা অংশ এখনো তাকে সম্মান করে। সর্বশেষ গত ৯ মার্চ সারাদেশ ভ্রমণ করে তিনি যখন রাজধানী কাঠমণ্ডু আসেন তখন তাকে অভ্যর্থনা জানাতে ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকায় হাজির হয় লাখ লাখ মানুষ।
‘আমাদের রাজাকে ফেরত দাও’, ‘এই নেপাল জ্ঞানেন্দ্র’র এমন স্লোগানে তাকে বরণ করে নেয় জনতা। এমন জনসমাগম আর সমর্থনের কারণে আবারও দেশটিতে রাজাকে ফেরানোর চিন্তা-ভাবনা করছে অনেকে। রাজতন্ত্র ফেরাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র পার্টি (আরপিপি)। কাঠমণ্ডুতে জ্ঞানেন্দ্রের অভ্যর্থনার অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে দলটি।

২০০১ সালে যুবরাজ দীপেন্দ্রের গুলিতে নিহত হওয়া নেপালের রাজ পরিবারের সদস্যরা, ছবি: হাইডেন রু
রাজতন্ত্র ফেরাতে গত ২৮ মার্চে এই দলের আন্দোলন রূপ নেয় সহিংসতায়। এতে রাজতন্ত্রপন্থী ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষে নিহত হন দুইজন। পরে বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সান্ধ্য আইন (কারফিউ) দিতে বাধ্য হয় সরকার। আরপিপি ছাড়াও রাজতন্ত্র ফেরাতে সমর্থন দিচ্ছেন দেশটির ব্যবসায়ী, তরুণ সমাজ ও বিশিষ্ট নাগরিকরাও।
উল্লেখ্য, ২০০১ সালের জুন মাসে নেপালের রাজপরিবারে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডে তার বড় ভাই রাজা বীরেন্দ্র শাহসহ পুরো রাজপরিবার নিহত হন। এরপর জ্ঞানেন্দ্র শাহ সিংহাসনে বসেন। তবে ২০০৬ সালে রাজা জ্ঞানেন্দ্র ক্ষমতাচ্যুত হন।
তবে নানা সসম্যায় জর্জরিত দেশটিতে পুনরায় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা খুব সহজ হবে না। এ ব্যাপারে দেশটিতে কাজ করা ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদুত রঞ্জিত রায় জানান, আমার মনে হয় না, রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার এই আন্দোলন খুব বেশি গতি পাবে। অবশ্য আমি ভুলও হতে পারি। তবে বিষয়টি সরকার ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো কিভাবে মোকাবেলা করবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
সূত্র: ওপেনিয়ন ইন্ডিয়া, দ্য কাঠমণ্ডু পোস্ট ও দ্য ফ্রন্টলাইন