হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে তার ভাই মুহাম্মদ জাফর ইকবাল একবার বলেছিলেন, কেউ চলে যাওয়া মানে শুধু শোকের সাথে স্মরণ করতে হবে, এমন আমরা মানি না। আমরা আমাদের বড় ভাইকে আনন্দের সাথে স্মরণ করতে চাই। প্রতি বছর ১৩ নভেম্বর হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন উপলক্ষ্যে এমনটা ভাবেন তার ভক্তরাও। আর এই নামটিকেই তারা সারা জীবন ধরে উৎসবে–আয়োজনে স্মরণ করে যেতে চান।
হুমায়ূন আহমেদ। ১৯৪৮ সালে জন্ম নেওয়া বাংলা ইতিহাসের শব্দের যাদুকর হিসেবে পরিচিত এই লেখকের প্রকৃত নাম ছিল শামসুর রহমান। তারা বাবা ফয়জুর রহমান নিজের নামের সাথে মিল রেখে এই নাম রাখেন। এদিকে মায়ের নয়নের মণি বলেই হয়তো ডাকনাম হয় কাজল। পারিবারিকভাবে তাকে কাজল বলেই ডাকা হতো। পরে তার রচিত জীবনীর মাধ্যমে জানা যায়, সেই আমলের মেট্রিক তথা বর্তমানের মাধ্যমিক পরীক্ষার সময়ে তিনি নিজের নাম নিজেই পরিবর্তন করে রাখেন হুমায়ূন আহমেদ। এর পরের হুমায়ূন নামা তো এক ইতিহাস।
তার বাবা, পুলিশ কর্মকর্তা, শহীদ হন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে। সে সময়ে হুমায়ূনের পিতা পিরোজপুর মহকুমার এসডিপিও হিসেবে কর্তব্যরত ছিলেন। তিনিও লেখালেখি করতেন। হুমায়ূন আহমেদের বিভিন্ন লেখা থেকে জানা যায়, নিত্যদিন জীবনের মাঝেই রসবোধ খুঁজে পাওয়ার যে ব্যাপারটি তার মাঝে আছে তা বাবার ‘জিন’ থেকেই পাওয়া।
ওদিকে মুহাম্মদ জাফর ইকবালও জানান, লেখালেখি আসলে তাদের পারিবারিক ব্যাপার। তাদের বোনেরাও দারুণ লেখেন। পরবর্তীকালে দেখা গেছে হুমায়ূনের সন্তানরাও লেখালেখিতে পারদর্শী। তবে এবারের এই লেখা হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে। তার যাদু নিয়ে।
সেই যাদু যে আবার তার শব্দ নিয়েই হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। যেমন- একবার কোনো এক ঘটনার প্রতিবাদে সামিল হতে হুমায়ূন আহমেদ সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। সে সেময় পুরো বাংলাদেশ থেকে সাধারণ জনতা তার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করতে সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। যেকোনো ঘটনায় হুমায়ূন আহমেদের একটি বাক্যই যেন ছিল আগুনে পোড়া অক্ষরের মতো। আর তার নাটকের প্রভাব নিয়ে আলাপ করতে গেলে সেটিই কোনা এক উপন্যাস হয়ে যাবে। কারণ সেই প্রভাব অভাবনীয়।
উদাহরণস্বরূপ বলতেই হয়, কোথাও কেউ নেই ধারাবাহিকের কথা। এই ধারাবাহিক তৎকালীস সরকারকেও বিচলিত করতে পেরেছিল। কোনো রাজনৈতিক আলাপের জন্য নয়, একটি চরিত্রের জন্য। সেটি হলো বাকের ভাই। ‘কোথাও কেউ নেই’ এর বাকের ভাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করেন আসাদুজ্জামান নূর। নাটকের শেষ পর্বে ফাঁসি হওয়ার কথা ‘ফাঁস’ হতেই গোটা দেশের বিভিন্ন শহরে থমথমে ব্যাপার। বদি চরিত্রে অভিনয় করা আব্দুল কাদের পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, অন্যরা দিশেহারা। দর্শকদের দাবি– বাকের ভাইকে ফাঁসি দেওয়া যাবে না। একই কথা বলেন তৎকালীন সরকার প্রধান। সেই কথা আমলে না নিয়ে নাটক যেভাবে শেষ করার সেভাবেই শেষ করেন তিনি।
তার নাটকে ছোট ছোট চরিত্র গুরুত্ব পায় অনেক বেশি। যেমন ‘রহিমার মা’ বা কাদের। আবার ছোটদের চরিত্রও গুরুত্ব পেয়েছে। বহুব্রীহি নাটকে ভাড়াটিয়া দুই শিশুর গুরুত্ব যেমন ছিল, ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত ‘একদিন হঠাৎ’ নাটকে কাজলের চরিত্র। সেই নাটকে শিক্ষক চরিত্রে অভিনয় করা হুমায়ূন ফরিদীর নির্দেশনায় নিজে নিজে পথ খুঁজে বাড়ি চলে আসে কাজল। উদ্দেশ্যে ছিল শিশুদের শিশুবেলা থেকেই স্বাবলম্বী করে তোলা।
তার বহুব্রীহি নাটকে ‘তুই রাজাকার’ সংলাপটি পাখির মুখ থেকে আসলেও তা এখনও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের ঝাঁঝালো স্লোগানে পরিণতও হয়েছে। কে বলবে, একটি হাস্যরসের নাটকে এভাবেও প্রতিবাদের সিলমোহর এঁকে দেওয়া যায়?
এছাড়াও তার বহুল আলোচিত বোহেমিয়ান হিমু চরিত্র তো আছেই। হিমু মানেই পাগলামির চূড়ান্ত। খালি পায়ে এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্তে ঘুরে বেড়ানো, গলা পর্যন্ত মাটিতে নিজেকে পুঁতে জোছনা দেখা, গান শুনতে ক্রোশের পর ক্রোশ পাড়ি জমানোসহ আরও কত কী। একটি প্রজন্ম হিমু হওয়ার স্বপ্ন দেখেই বড় হয়েছে- এমনটাই ভাবে তার পাঠকেরা। পাশাপাশি রূপার মতো বেশভুষায় কঠোর কিন্তু কোমল মনের মেয়ে হতেও ইচ্ছা কত মেয়ের মনে আজও। ওদিকে কবে যেন অন্ধ হয়ে যায়- এই ভয়ে বেড়ে ওঠা শুভ্রও কত যুবকের প্রতিচ্ছবি তা নিজেরাও অনেকে জানে না।
হুমায়ূন আহমেদের নাটক, উপন্যাস, গল্প বা কলাম- যেকোনো লেখার প্রতিটি চরিত্র পাঠককে টেনে আনে নিজের কাছে। সেটি বড়লোক বাবা হোক, অসহায় ‘আপা’ হোক বা হাস্যরসের দুলাভাই হোক। এমনকি তার আমেরিকার চিকিৎসাকালে লেখা কলাম পড়ে বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষ কেঁদেছেন। তিনি লিখেছেন, ছোট কন্যা বিপাশার ছোটবেলায় শিশিতে বাবার গায়ের গন্ধ ভরে রাখার স্মৃতি।
হুমায়ূন আহমেদের নাম যদি আজ অন্য কিছুও হতো, তার উপন্যাসসম জীবন সেই ইতিহাসই হতো। কারণ নামে নয়, তার পরিচয় ছিল প্রতিটা অক্ষরে অক্ষরে। তাই হুমায়ূন আহমেদ মানেই হলুদ পাঞ্জাবির হিমু, মোটা ফ্রেমের চশমাপরা শুভ্র, নীল শাড়ির রূপা, অনুসন্ধানী মিসির আলী, খেপাটে মুবিন বা নদীর বুকে দাপটে দাড়িয়ে থাকা মির্জা।