রফিক সাহেব, তৃতীয় শ্রেণীর একজন সরকারি কর্মচারি। দুই ছেলে ও দুই মেয়ের জনক। বড় ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে স্কলারশিপ নিয়ে এখন কানাডায়।
কানাডিয়ান এক মেয়ে বিয়ে করে সে ওখানেই থাকে। তাদের সুখের সংসারে আট বছরের সন্তান আরিক। পৃথিবীর সমস্ত আলো নিয়ে যেন আরিকের জন্ম।
মেয়ে দুটো উচ্চ শিক্ষিত। বিয়ে হয়েছে।বেশ ভালোই আছে। মেঝো মেয়ে এক বেসরকারি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ায়। সেজো মেয়ের নিজের বুটিক হাউজ আছে। আর ছোট ছেলে বুয়েট থেকে কিছুদিন আগে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে দেশে বড় একটি কোম্পানিতে ভালো চাকরি করছে।
বড় ছেলের স্কলারশিপের খবরটা তাকে যতটানা না আনন্দ দিয়েছিলো ঠিক ততোটাই চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলো। অনেক টাকা লাগবে। এই দিকে মেঝো মেয়ের বিয়ের কথাও প্রায় পাকা। হার্ট ব্লকের অপারেশন করানোর জন্য জমানো টাকা ছিলো কিছু। গ্রামের বাড়ির সব জমিজমা বিক্রি করা ছাড়া আর কোন পথই ছিলো না রফিক সাহেবের।
সেজো মেয়ের বুটিক হাউজের জন্য শেষে এফ ডি আর-টাও ভেঙ্গেছেন তিনি। অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে, ছোট ছেলের লেখাপড়া, সংসারের খরচ, সব মিলিয়ে অস্থিত্ব টিকিয়ে রাখা ছিল তার জন্য ডু অর ডাই সিচুয়েশন। নিজের জন্য কবে একটি শার্ট কিনেছিলেন তার মনে পড়ে না।
রফিক সাহেব, এক কাপড়ে আর কতদিন?
সহকর্মী আফজাল সাহেবের এমন প্রশ্নে ঠোঁট জুড়ে স্থির হাসি ধরে রাখা ছাড়া আর কিছু করারও ছিলোনা তার। বলার অনেক কিছু থাকলেও, বুঝবে এমন কেউ কী আছে?
ব্লক অপারেশনটাও আর করা হয়ে ওঠেনি। অফিস থেকে প্রতিদিন দীর্ঘ পথের সঙ্গী ছিল ব্যস্ত নগরীর ফুটপাথ আর চশমার ফ্রেমে জুড়ে থাকা মোটা কাঁচ ছাপিয়ে শূন্য দৃষ্টি। প্রতিটি দিন মোমের মতো একটু একটু করে গলে আলোকিত করেছেন সন্তানদের।
হ্যাঁ, আজ রফিক সাহেব, সুস্থ এবং সুখি । বড় ছেলে আর সেজো মেয়ে মিলে তাকে ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছে। ছোট ছেলের টাকায় ব্লকের অপারেশনটাও হয়েছে। গ্রামে বাড়ির কাজ চলছে। প্রতিদিন সকালে পত্রিকা হাতে নিয়ে চায়ের কাপে এখন তিনি তৃপ্তির চুমুক দেন। প্রতি ঈদে তার সন্তান আর নাতি পুতিদের নিয়ে তিনি সুখি সময় কাটান।
কিন্তু এই সুখের জন্য তাকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। দুই রুমের বাসায় চার সন্তান এবং স্ত্রী নিয়ে বেশ টানাটানিতেই কাটাতে হয়েছে তাকে। হয়তো তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী হওয়ার কারণেই বুঝতেন, যে করেই হোক সন্তানদের ভালো লেখাপড়া করিয়ে এই পৃথিবীর জন্য তৈরি করে দিতে হবে।
এবং তিনি পেরেছেন। কারণ তিনি বাবা। প্রতিদিন অল্প অল্প করে নিজেকে নিঃশেষ করে সবার ঠোঁটে হাসি ফুটিয়েছেন। বাবারা বোধহয় এমনিই হয়।
বাবাদের পারতেই হয়। এক সমুদ্র অস্পষ্ট আত্ম-চিৎকার হৃদয়ে নিয়েও চাপা হাসি ঠোঁটে ধরে, নীরবে পথ চলতে হয়।
বাবা যেমনই হোক, তাদের পারতেই হয়।